You dont have javascript enabled! Please enable it! স্থানীয় মুক্তিবাহিনী খায়রুল আলম কোম্পানি (চিলমারী, কুড়িগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

স্থানীয় মুক্তিবাহিনী খায়রুল আলম কোম্পানি (চিলমারী, কুড়িগ্রাম)

খায়রুল আলম কোম্পানি (চিলমারী, কুড়িগ্রাম) একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। কুড়িগ্রাম জেলা ও ১১ নম্বর সেক্টরের মানকারচর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এ কোম্পানি গঠিত। কোম্পানি কমান্ডার খায়রুল আলমের নামে এ কোম্পানি গড়ে ওঠে। খায়রুল আলমের প্রকৃত নাম নজরুল ইসলাম। খায়রুল আলম ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রৌমারী রণাঙ্গণে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের অধীনে বেশ কয়েকটি কোম্পানি কমান্ডারদের নামে গঠন করা হয়েছিল। খায়রুল কোম্পানি এরকম একটি। এ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা মানকারচর সাব-সেক্টরের বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। কোম্পানি গঠনের পর খায়রুল আলম প্রথমে ঘুঘুমারীতে প্রধান কেন্দ্র ও পরে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে উলিপুরের অনন্তপুরে ক্যাম্প স্থাপন করেন।
নজরুল ইসলাম বৃহত্তর ঢাকার বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার কামারগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকায় ছাত্রাবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)- এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৭১-এর মার্চে মাথায় হুলিয়া নিয়ে তিনি কুড়িগ্রামে যান। কুড়িগ্রামে তিনি ছাত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ছাত্র-যুবকদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। কুড়িগ্রামে তিনি নিজেকে ‘খায়রুল আলম’ নামে পরিচয় দেন। এ নামেই তিনি কুড়িগ্রাম জেলায় পরিচিত হন। ২৮শে মার্চ কুড়িগ্রাম গওহর পার্কে তিনি নিজ হাতে তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছাত্র-জনতাকে উৎসাহিত করেন।
কুড়িগ্রাম শহর পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলে খায়রুল আলম উলিপুর-চিলমারীতে কিছুদিন অবস্থান করে সেখান থেকে রৌমারীতে যান। সেখানে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে অস্ত্র চালনা বিষয়ে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। ১লা মে তিনি স্থানীয় থানা পুলিশ কর্তৃক ধৃত হন। একই সময়ে থানা আক্রমণ করতে আসা মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হোসেন পুলিশের বেয়নেট চার্জে আহত ও আটক হন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন তাঁদের আটক করে চিলমারীতে পাকিস্তানি সৈন্যদের জানিয়ে দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিতে সাহস না পাওয়ায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দিক থেকে প্রবল চাপ থাকায় তাঁদের এক পর্যায়ে থানার ওসি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মুক্তির পর খায়রুল আলম মানকারচরে যান। সেখানে তিনি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। ভারতের তুরায় প্রথম ব্যাচে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। খায়রুল আলম ৪ঠা মে মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব এলাহী রঞ্জু, হাবিলদার মাহবুব, সুজা, রেজা, লালু, টিপুসহ ৪৩ জনকে নিয়ে রৌমারী থানা অপারেশন করেন। তাঁদের আসার খবরে পুলিশ সদস্যরা থানার অভ্যন্তরস্থ কুয়ায় সব অস্ত্র ফেলে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা থানায় ঢুকলে তারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কুয়া থেকে ১৬টি রাইফেল তুলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। পরে অস্ত্র ও বন্দি পুলিশদের নিয়ে তাঁরা মানকারচরে ফিরে যান। রৌমারী থানা অপারেশন ছিল মানকারচর সাব-সেক্টরের প্রথম সফল অপারেশন। এ অপারেশনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বেশকিছু অস্ত্র আসে। এসব অস্ত্র প্রাপ্তির ফলে খায়রুল কোম্পানির শক্তি বৃদ্ধি হয়। ৪ঠা অক্টোবরের কোদালকাটি যুদ্ধ, ১৭ই অক্টোবরের চিলমারী যুদ্ধ, অর্জুনেরডারা অপারেশন, উলিপুর হাতিয়ার যুদ্ধ, চিলমারী তহশিল কাছারি অপারেশন, লালচামার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, গাইবান্ধা ও সাদুল্যাপুর এলাকার বেশ কয়েকটি যুদ্ধে এ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেন।
খায়রুল কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন খুরশীদ আলম সাজু, তাহমীদুর রহমান চাঁদ (পরে কোম্পানির টুআইসি) ও লাল মিয়া। হেডকোয়ার্টার্স প্লাটুনে ছিলেন আব্দুল জলিল, আব্দুল হাকিম, এছাহাক আলী, কয়ছার আলী ও ডাক্তার সাজু। সেকশন কমান্ডার ছিলেন নুরল আলম, এবাদত হোসেন পচু, আব্দুল কাদের, যোগেন, গোলজার, জসিম উদ্দিন, মহেন্দ্র, এম এ আজিজ প্রমুখ। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল কোম্পানির সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেন। এ কোম্পানির সবচেয়ে কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন রমনা মণ্ডল বাড়ির মিজানুর রহমান তারা মিয়া। তাঁকে বয়সের কারণে মুক্তিযোদ্ধা দলে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলে নৌকা ছেড়ে দিয়েছিলেন খায়রুল আলম। কিশোর তারা বাধা না শুনে খায়রুল আলমের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে ভয়াল ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিতে সাঁতার শুরু করেছিলেন। পরে খায়রুল আলম মাঝ নদী থেকে তারাকে নৌকায় তুলে নেন। কিশোর তারা নানা অপারেশনে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
খায়রুল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা হিতেন্দ্র নাথ, গোলজার হোসেন, আকবর আলী, আবুল কাশেম কাচু ও নবাব আলী ১৩ই নভেম্বর হাতিয়ায় উলিপুরের যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এম্বুশে পড়ে শহীদ হন। সেক্টর কামন্ডার হামিদুল্লাহ খান স্বাধীনতা যুদ্ধে খায়রুল আলম কোম্পানি গ্রন্থের প্রাক্কথনে লিখেছেন, ‘নজরুল একজন অসীম সাহসী, সংকল্পে অবিচল এবং রণাঙ্গনের নির্ভরযোগ্য নেতা।’ [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড