You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক খায়রুল জাহান

খায়রুল জাহান, বীর প্রতীক (১৯৪৯-১৯৭১) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রুপ কমান্ডার। তিনি ১৯৪৯ সালের ২১শে জুলাই কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার লতিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল হাই তালুকদার ওরফে মেন্দি মিয়া এবং মাতার নাম শামসুন নাহার বেগম। আব্দুল হাই তালুকদার তাঁর পরিবার নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের শোলাকিয়া এলাকার খড়মপট্টিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। খায়রুল জাহান ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকে খুব সাহসী ও মেধাবী ছিলেন। তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং এইচএসসি পাসের পর ময়মনসিংহ কারিগরি মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। খায়রুল জাহান পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য মনোনীত হন। ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে তাঁর কাছে চিঠি আসে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে অকুতোভয় খায়রুল জাহান পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
খায়রুল জাহান ছাত্রজীবন থেকে বাঙালিদের প্রতি অবাঙালিদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ ছিলেন। ময়মনসিংহ শহর ও কিশোরগঞ্জে পাকিস্তানি রাষ্ট্র, শাসন-শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বাঙালিদের তীব্র আন্দোলন এবং মিছিল-সমাবেশে তিনি অংশ নিতে থাকেন। ৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে খায়রুল জাহান তাতে অংশ নেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মার্চের শেষ সপ্তাহে তিনি ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জে যান। সেখানে কিছুদিন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করেন। এরপর সেখান থেকে ভারতের আগরতলায় গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনস্থ ২ নম্বর সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত হন। এ সেক্টরের তত্ত্বাবধানে মেলাঘর থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণে সাহস, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়ায় তাঁকে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের গ্রুপ কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। নিজের দল নিয়ে খায়রুল জাহান দেশের ভেতরে বেশ কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। নভেম্বর মাসে কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি তাঁর দল নিয়ে গ্রামের বাড়ি লতিবপুর এলাকায় আসেন। কিশোরগঞ্জ- হোসেনপুর রোডের প্যাড়াডাঙ্গা নামক স্থানে তাঁরা অবস্থান নেন। তাঁরা রাজাকারদের ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে খায়রুল জাহান ও তাঁর দলের খবর পেয়ে ২৬শে নভেম্বর ভোরে কিশোরগঞ্জ শহর থেকে পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি বিরাট দল এসে তাঁদের আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। মো. সেলিম, বীর প্রতীক ঘটনা স্থলে শহীদ হন। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে দলনেতা খায়রুল জাহান নিজ দলের সদস্যদের শত্রুদের গুলি থেকে রক্ষা করার কৌশল গ্রহণ করেন। তিনি নিজে এগিয়ে গিয়ে পাকসেনাদের প্রতি মেশিনগানের গুলি ছুড়তে থাকেন। এ অবস্থায় তিনি আহত হন এবং শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ার উপক্রম হয়। প্রচণ্ড সাহসী ও আত্মমর্যাদাশীল খায়রুল জাহান শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চেয়ে শহীদ হওয়াকে অধিক শ্রেয় মনে করে নিজের হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। তাঁর এ সিদ্ধান্তে দলের অন্য সদস্যরা রক্ষা পান। খায়রুল জাহান শহীদ হলেও পাকসেনা ও রাজাকারদের জিঘাংসা প্রশমিত হয়নি। তারা তাঁর মৃতদেহ বেয়নেট দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে। রাজাকার- মাওলানা মুসলেহ উদ্দীনের ছেলে মো. হোসেইন খায়রুলের রক্তমাখা পরিধেয় বস্ত্র তাঁর মায়ের সামনে ফেলে বীভৎসতা প্রদর্শন করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ ও সহসাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর সরকার খায়রুল জাহানকে ‘বীর প্রতীক’ (মরণোত্তর) খেতাবে ভূষিত করে। শহীদ খায়রুল জাহানের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কিশোরগঞ্জে শহীদ খায়রুল স্মৃতি সংসদ, হোসেনপুরের প্যাড়াভাঙ্গা যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে তিনি শহীদ হন সেখানে শহীদ খায়রুল স্মৃতিফলক নির্মাণ, ময়মনসিংহ কারিগরি কলেজের একটি ছাত্রাবাসের শহীদ খায়রুল ছাত্রাবাস নামকরণ ইত্যাদি। প্রতিবছর ২৬শে নভেম্বর কিশোরগঞ্জ শহরে শহীদ খায়রুল দিবস হিসেবে।পালিত হয়। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!