You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে খালিয়াজুরী উপজেলা (নেত্রকোনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে খালিয়াজুরী উপজেলা (নেত্রকোনা)

খালিয়াজুরী উপজেলা (নেত্রকোনা) নেত্রকোনা জেলার সবচেয়ে দুর্গম হাওর অঞ্চল। ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে দেশের নিম্নাঞ্চলে এটি অবস্থিত। এ থানায় বেশকিছু বড় নদী ও বিল রয়েছে। ধনু, পিয়াইন, সুরমা, চিত্রাই এখানকার বড় নদী এবং রাহুল, রুসকি, আও, করমুহুরী, গোরাইল বৃহৎ বিল। এখানে বছরের ছয় মাস থাকে বর্ষা আর বাকি ছয় মাস হেমন্ত কাল। বর্ষায় গ্রামগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকে। যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতার কারণে ১৯৭১ সালে গোটা খালিয়াজুরী মুক্তাঞ্চল ছিল। পাকবাহিনী এখানে কোনো স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করতে পারেনি। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ও সুসংগঠিত কার্যক্রম ছিল। এ দুর্গম জনপদ থেকে ১৭১ জন মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিকামী জনগণ এখানে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে।
৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে খালিয়াজুরীর মানুষ সংগঠিত হতে শুরু করে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৮শে মার্চ সিদ্দিকুর রহমান তালুকদারের নেতৃত্বে থানা সদরে ১১ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটি গঠন করে পাকহানাদারদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- হাছেন চৌধুরী (বোয়ালী), প্রমোদ ভৌমিক (সাতগাঁও), তপস্বী রায় (শালদীঘা), গণি মিয়া (লেপশিয়া), জামাল উদ্দিন (বল্লী) প্রমুখ।
১লা থেকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত খালিয়াজুরীর কাচারি মাঠে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৪ঠা এপ্রিল তাঁরা ভারতের সীমান্তবর্তী মহেশখলা ক্যাম্পে যান। ৫ই এপ্রিল তাঁরা মহেশখলা ইয়ুথ ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। পরে ভারতের তুরায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। – ছাত্রলীগ-এর মাধ্যমে সংগঠিত কর্মীরা বিএলএফ-এর আওতায় দেরাদুন এবং হাফলংয়ে আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ নেন। খালিয়াজুরীর মেন্দিপুর ইউনিয়নের বোয়ালী গ্রামে বিএলএফ একটি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে। আব্দুল মান্নান তালুকদার, জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, আব্দুল আজিজ প্রমুখ এ ক্যাম্পের নেতৃত্ব দেন। মুজিব বাহিনী-র কিছু মুক্তিযোদ্ধা এ ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত হন এবং গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। খালিয়াজুরী সদরের আওয়ামী লীগ – নেতা সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার এবং হাছেন চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক। এছাড়া জগন্নাথপুরের হাজী কেয়াজউদ্দিন, উদয়পুরের সুশীল তালুকদার, বানুয়ারীর মনফর উদ্দিন তালুকদার, খলাপাড়ার বিমল রায়, খালিয়াজুরী সদরের প্রদ্যুৎ মজুমদার, শেখ জিল্লুর রহমান, মোজাম্মেল হক, লেপশিয়ার আব্দুল গণি, সাতগাঁওয়ের প্রমোদ ভৌমিক, শালদীঘার তপস্বী রায়, বল্লীর জামাল উদ্দিন প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এঁদের নেতৃত্বেই সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হন। খালিয়াজুরীতে বিএলএফ-এর নেতৃত্বে ছিলেন বোয়ালীর আব্দুল মান্নান ও আজিজুর রহমান।
পাকবাহিনী ৬ই আগস্ট খালিয়াজুরীতে প্রথম অনুপ্রবেশ করে এবং খালিয়াজুরী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তখন খালিয়াজুরী এলাকা ছিল বর্ষার পানিতে ভরপুর। অথৈ পানি, হাওরের বিশাল ঢেউয়ের গর্জন, প্রতিকূল পরিবেশ আর বিচ্ছিন্ন যোগাযোগের কারণে পাকবাহিনী শুরুতেই শঙ্কিত ছিল। ফলে মাত্র তিনদিন অবস্থানের পর তারা এলাকা ত্যাগ করে। এরপর আর কখনো পাকবাহিনী খালিয়াজুরীতে আসেনি।
স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকেই খালিয়াজুরীতে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি দলের নেতৃত্বে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের শক্ত ভিত গড়ে ওঠে। এ কারণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এখানে কোনো অবস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। এখানে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পিডিপি প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ফলে রাজাকার, আলবদর বা আলশামস বাহিনীরও তদ্রূপ কোনো তৎপরতা ছিল না। তবে এখানে বোয়ালীর ইমাম হোসেন চৌধুরীকে আহ্বায়ক এবং আব্দুল জলিল চৌধুরী, আব্দুল খালেক, মোজাফফর চৌধুরী ও জয়নাল আবেদীন-সহ কয়েকজনকে সদস্য করে শান্তি কমিটি – গঠিত হয়। খালিয়াজুরীতে রাজাকারদের তৎপরতা কম থাকায় অন্যান্য উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন এ থানার বিভিন্ন গ্রামে এসে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস খালিয়াজুরীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। এখানকার কোথাও তারা কোনো আক্রমণও করতে পারেনি। মাত্র তিনদিন অবস্থান করে পাকবাহিনী এলাকা ত্যাগ করায় এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি কোনো যুদ্ধ হয়নি।
৬ই আগস্ট পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করে ৮ই আগস্ট এলাকা ত্যাগ করে। ফলে ৮ই আগস্টকে খালিয়াজুরী হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। খালিয়াজুরী উপজেলার ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা অন্য এলাকায় যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন। তাঁরা হলেন- অখিল চন্দ্র দাস (পিতা বঙ্কবিহারী দাস, পাথরা; সিলেটের তামাবিল যুদ্ধে শহীদ), হরিমোহন রায় (পুলিশ সদস্য, পিতা বীরচরণ রায়, চাকুয়া; বান্দরবানের চিরিঙ্গামারিতে শহীদ), সুনীল চন্দ্ৰ সরকার (পিতা সচীন্দ্র সরকার, পাথরা) এবং মমতাজ উদ্দিন (পিতা আব্দুল জব্বার, ফতুয়া)। [সঞ্জয় সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড