You dont have javascript enabled! Please enable it!

খালিশপুর প্লাটিনাম জুটমিলস্ বয়লার হত্যাকাণ্ড (খুলনা শহর)

খালিশপুর প্লাটিনাম জুটমিলস্ বয়লার হত্যাকাণ্ড (খুলনা শহর) এক বীভৎস ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারিরা এ মিলের জ্বলন্ত বয়লারে মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার সমর্থক শ্রমিক ও অন্যান্যদের নিক্ষেপ করে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করত।
খালিশপুর জুটমিলটি ছিল একটি ভয়াবহ মৃত্যুপুরি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারিরা এ মিলের জ্বলন্ত বয়লারে মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার সমর্থক শ্রমিক ও অন্যান্যদের নিক্ষেপ করে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করত। খালিশপুর বর্তমানে খুলনা মহানগরীর অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানটি ছিল খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৫ কিমি উত্তরে খুলনা-যশোর রোডের পশ্চিম পার্শ্বে। এর পূর্বদিক দিয়ে ভৈরব নদী প্রবাহিত। এখানে অনেকগুলো পাটকল, নিউজপ্রিন্ট মিলস, হার্ডবোর্ড মিলস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা রয়েছে। এ কারণে এটি শিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত। উনিশশ সাতচল্লিশ পরবর্তীকালে এখানে একে-একে এসব কারখানা গড়ে ওঠে। পাশাপাশি এ শিল্প এলাকায় গড়ে ওঠে নতুন বসতি। সেখানে ঠাঁই হয় ভারত থেকে আসা মোহাজেরদের, যারা সাধারণভাবে বিহারি নামে পরিচিত। উর্দুভাষী এসব মানুষ স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানের প্রতি আস্থাশীল ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব থেকেই গোটা খালিশপুর এলাকায় বিহারিদের কর্তৃত্ব বহাল ছিল। মিলগুলোর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা উভয়ই ছিল পাকিস্তানিদের হাতে। তাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় বিহারিরা সব সময় পাকিস্তান সরকারের পাশাপাশি তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়ে আসে।
একাত্তরের ২৫শে মার্চ পাকহানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে ঢাকায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে একই সময়ে খালিশপুরে বিহারিরাও বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। বাঙালিরা প্রতিরোধে এগিয়ে আসার চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারেনি। গোটা মুক্তিযুদ্ধকালে বিহারিরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ধরে-ধরে হত্যা করেছে, তাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়েছে, বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। হত্যার কৌশলও ছিল নৃশংস। অত্যাচার করে, জবাই করে, জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। খালিশপুরে সারি-সারি পাটকল ও নিউজপ্রিন্ট মিলে ছিল বয়লার। এ বয়লারগুলো ছিল এক-একটি জ্বলন্ত বধ্যভূমি। প্লাটিনাম জুট মিলসের বয়লারটি ছিল একটি ভয়াবহ মৃত্যুপুরি। পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও বিহারিরা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক শ্রমিক ও অন্যান্যদের এ মিলের ভেতর ধরে এনে প্রথমে তাদের ওপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতন চালাত। এরপর অর্ধমৃত অবস্থায় তাদের মিলের জ্বলন্ত বয়লারে ছুড়ে ফেলা হতো। এমনকি জীবন্ত মানুষদেরও ধরে ঐ বয়লারে ছুড়ে ফেলে অগ্নিদ্বগ্ধ করে হত্যা করত। মুক্তিযুদ্ধকালে এমন বীভৎস ঘটনা দিনের পর দিন ঘটতে থাকে। এমনও ঘটেছে যে, একদিনেই ৬০ জনের মতো শ্রমিককে এভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। মোট কতজনকে হত্যা করা হয়েছে এবং কী তাদের পরিচয় তা উদ্ঘাটন করা কখনোই সম্ভব নয়। তাদের ৪ জনের নাম জানা সম্ভব হয়েছে। তারা হলেন- হারুন, হেমায়েত, হাসু মোল্লা ও আজিজ।
স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালে খালিশপুর এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ খালিশপুরের প্লাটিনাম ও পাশের পিপলস্ জুট মিলসের শ্রমিক কলোনি ও সেখানকার সেফটি ট্যাংকের মধ্য থেকে দুহাজারেরও বেশি নরকঙ্কাল উদ্ধার করে। মানুষের দেহের এসব কঙ্কাল থেকে দেখা যায় যে, হত্যার পূর্বে তাদের হাত-পা বাঁধা ছিল। খালিশপুর ময়দানের একটি পুকুরের নিকটবর্তী স্থানে অপর একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। এখানেও অসংখ্য নরকঙ্কাল ও মানুষের হাড়-গোড় পাওয়া যায়। এভাবে প্লাটিনাম জুটমিলস্ ও পার্শ্ববর্তী মিলসের বয়লার এবং অন্যত্র মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা অনেক বাঙালিকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে। জ্বলন্ত বয়লারে জীবন্ত মানুষ ছুড়ে হত্যার ঘটনা ঠাকুরগাঁয়ে বাঘের খাঁচায় মানুষ হত্যা-র লোমহর্ষকর ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। খুলনা শহরে প্রতিষ্ঠিত ৭১-এর গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর-এ খালিশপুর প্লাটিনাম জুটমিলসের সেই অভিশপ্ত ও ভয়াবহ বয়লারের অংশবিশেষ সংরক্ষিত রয়েছে। [গৌরাঙ্গ নন্দী]

তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ৩রা ফেব্রুয়ারি ১৯৭২; প্লাটিনাম জুটমিলসের অশীতিপর সাবেক শ্রমিক আব্দুর রশিদ হাওলাদারের সাক্ষাৎকার, তারিখ ১৫/০১/২০১৯, ৭১-এর গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভস ও জাদুঘর, খুলনা; সুকুমার বিশ্বাস, একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, অনুপম প্রকাশনী, ২০১০, পৃ. ৩১৩

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!