বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী খান আবদুল গাফ্ফার খান
খান আবদুল গাফ্ফার খান ভারতরত্ন (১৮৯০- ১৯৮৮) পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী। তিনি ১৮৯০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের (বর্তমান পাকিস্তানের) খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চরসাদ্দা জেলার উটমানজাইতে জন্মগ্রহণ করেন। পাকিস্তানে তিনি বাচ্চা খান ও ভারতে সীমান্ত গান্ধী নামে অধিক পরিচিত। তিনি অধ্যয়নের জন্য পেশোয়ারের এডওয়ার্ড মিশন স্কুল, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমন করলেও ততটা সফল হতে পারেননি। তিনি ১৯১১ সালে পশতুনের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগদান করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনে (১৯১৯- ১৯২১) যোগদান করেন, কিন্তু আন্দোলনে বারংবার ব্যর্থ হয়ে পশতুনদের জন্য হিতকর সামাজিক কর্মকাণ্ড ও সংস্কার সাধনের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে ১৯২১ সালে আফগান রিফর্ম সোসাইটি ও ১৯২৭ সালে যুব আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯২৯ সালে তিনি খুদাই খিদমতগার আন্দোলন (লাল শার্ট আন্দোলন) গড়ে তোলেন এবং এ আন্দোলনে সাফল্যের ফলে ব্রিটিশ সরকার তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শুরু করে। তিনি দীর্ঘদিন ভারতীয় কংগ্রেস দলের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন, কিন্তু কমিটির যুদ্ধ পরিকল্পনা নীতির কারণে ১৯৩৯ সালে তিনি পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তীকালে দলীয় নীতি সংশোধনের ফলে পুনরায় দলে যোগ দেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে একত্রে ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে তিনি নতুন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন (১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি)। ১৯৪৮ সালের ৮ই মে তিনি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আজাদ পাকিস্তান পার্টি গঠন করেন, যা ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়। জীবনে বহুবার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। সমাজসেবায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮৭ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘ভারতরত্ন’ খেতাবে ভূষিত হন। তিনি ১৯৮৮ সালের ২০শে জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্দেশ উপেক্ষা করে গাফ্ফার খান বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে উপর্যুপরি বিবৃতি প্রদান করেন। এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের বিবৃতি প্রদানের পর পাকিস্তানে ও আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানি সরকারের স্বরূপ প্রকাশ পায় এবং তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। এর ফলে তিনি সামরিক শাসকের রোষানলে পড়েন এবং সামাজিকভাবে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। আফগানিস্তানের কাবুলে অবস্থান করে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন এবং বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার জন্য আফগান সরকারকে উপর্যুপরি আহ্বান জানান। পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া বহু বাঙালিকে তিনি গোপনে সীমান্ত অতিক্রম করে আফগানিস্তান হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১লা অক্টোবর ২০১৩ খান আবদুল গাফ্ফার খান-কে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড