খানমোহনা রেলস্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম)
খানমোহনা রেলস্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তাঁর গ্রুপ এবং সুবেদার মেজর টি এম আলী বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে এ অপারেশন পরিচালনা করেন। এতে ৩ জন রাজাকার- নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও ৪ বেল্ট গুলি উদ্ধার করেন।
পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী ইউনিয়নের ডেঙ্গাপাড়া কাদেরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছিল রাজাকার ক্যাম্প। প্রতিরাতে এই ক্যাম্প থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খানমোহনা রেলস্টেশনে ৯-১০ জন রাজাকার এসে রেললাইন পাহারা দিত। নাজিরহাট থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলস্টেশনসমূহে রাজাকারদের পাহারা দেয়ার নিয়ম করা হয়। গভীর রাতে এক বগির একটি রেলে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা দোহাজারী থেকে ষোলশহর যাতায়াত করত। যাওয়ার সময় তারা পাহারা চেক করত ও পাহারায় নিয়োজিত রাজাকারদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করত।
খানমোহনা রেলস্টেশনে ডেঙ্গাপাড়া কাদেরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকাররা রেলস্টেশনটির অফিস ও ওয়েটিং রুমকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত। বিদ্যালয় থেকে রাজাকাররা এই স্টেশনে রেললাইন পাহারা দিতে এসে স্টেশনের পূর্বদিকের দক্ষিণ ভূর্ষি কেচিয়াপাড়া গ্রাম ও ধলঘাট আলামপুর এলাকার হিন্দুবাড়িতে নানা অত্যাচার, লুটপাট, নারীনির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি সংঘটিত করত। একারণে কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদ খানমোহনা রেলস্টেশন রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন।
ঘটনার দিন রাতে হাজী মাঠের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তাঁর গ্রুপের এবং সুবেদার মেজর টি এম আলী বাহিনীর কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা যৌথভাবে খানমোহনা রেল স্টেশন রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সামশুদ্দিন আহমদ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা হাজী মাঠের ক্যাম্প থেকে প্রথমে ডেঙ্গাপাড়া কাদেরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্পে আসেন। সেখানে কোনো রাজাকারকে না পেয়ে খানমোহনা রেল স্টেশনে তাঁদের ১০-১১ জন এম্বুশ গ্রহণ করেন। তাঁদের উপস্থিতি রাজাকাররা টের পেলে মুক্তিযোদ্ধা ইসহাক (পিতা খলিলুর রহমান) প্রথমে এম্বুশ থেকে স্টেশনের ক্যাম্পের দিকে গুলি ছোড়েন। একই সঙ্গে শুরু হয় এম্বুশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের স্টেশনের দিকে অবিরাম গুলিবর্ষণ। স্টেশনের পূর্ব ও উত্তরে পানিভর্তি বিল। আত্মরক্ষার্থে রাজাকারদের কেউ-কেউ স্টেশনের রুমের জানালা দিয়ে, কেউ-কেউ রুম থেকে বেরিয়ে প্লাটফর্মের ওপর দিয়ে দৌড়ে বিলে লাফিয়ে পড়ে। তাদের একটি অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে গুলি করতে থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে এইসব রাজাকাররাও দৌড়ে বিলে ঝাঁপ দিতে থাকে। যুদ্ধ চলে প্রায় দুই ঘণ্টা। রাত ২.৩০টায় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা স্টেশনের ভেতরের কক্ষে প্রবেশ করে অফিসে একজন ও ওয়েটিং রুমে ২ জন রাজাকারকে নিহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও ৪ বেল্ট গুলি উদ্ধার করেন।
এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপ থেকে কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদ (পিতা মো. আবদুল মন্নান, পশ্চিম গোবিন্দারখীল), গাজী আবদুস সবুর (পিতা গাজী আলী চান সওদাগর, পটিয়া সদর), আবুল বশর (পিতা আবুল খায়ের, করল), আবুল কালাম (পিতা আবদুস সালাম, পটিয়া সদর), কবির আহমদ (পটিয়া সদর), আহমদ ছফা চৌধুরী (উত্তর গোবিন্দারখীল, সেনাসদস্য), আবু জাফর চৌধুরী (পিতা নজির আহমদ চৌধুরী, উত্তর গোবিন্দারখীল), জহুরুল হক চৌধুরী (উত্তর গোবিন্দারখীল), আবদুস সোবহান মিস্ত্রি (উত্তর গোবিন্দারখীল) এবং লুবেদার মেজর টি এম আলী বাহিনী থেকে ইসহাক (পিতা খলিলুর রহমান, সেনাসদস্য) ও মাকরান ইসহাক (পিতা আমজু মিয়া) প্রমুখ। [শামসুল আরেফীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড