You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে খানসামা উপজেলা (দিনাজপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে খানসামা উপজেলা (দিনাজপুর)

খানসামা উপজেলা (দিনাজপুর) দিনাজপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঘোষিত বাঙালির মুক্তিসনদ ৬-দফার পক্ষে সারা দেশে তীব্র আন্দোলনের যে ঢেউ বয়ে গিয়েছিল, খানসামা উপজেলায়ও তার স্পর্শ লাগে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এও এ উপজেলার মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘৭০-এর নির্বাচনে খানসামার সংগ্রামী জনতা আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. গোলাম রহমানকে এমপিএ নির্বাচিত করে। ‘৬৬ থেকে ‘৭১-এর মার্চ পর্যন্ত এই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়ই এখানে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর থেকেই খানসামায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ মিছিল-মিটিং ও আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে থাকে। সাতই মার্চের ভাষণ-এ বঙ্গবন্ধু ‘প্রত্যেক গ্রাম ও মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন’ এবং যার ‘যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত’ থাকার নির্দেশ দেন। তাঁর সেই নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৮ই মার্চ পাকেরহাটের আব্দুল জব্বার হেডমাস্টারের বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক সভায় মো. গোলাম রহমান এমপিএ-কে আহ্বায়ক করে খানসামায় ২১ সদস্য- বিশিষ্ট একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের সদস্যদের মধ্যে মো. নাসির উদ্দিন শাহ (খানসামা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি), অমিয় কুমার গুহ (খানসামা থানা আওয়মী লীগের সাধারণ সম্পাদক), এডভোকেট জহির উদ্দিন শাহ (হাসিমপুর), শাহ মো. আব্দুল জব্বার (ভাবকী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), আব্দুল জব্বার হেডমাস্টার (পাকেরহাট), মইনউদ্দিন আহমেদ (পাকেরহাট), জিন্নত হোসেন চৌধুরী (হাসিমপুর), আব্দুল লতিফ চৌধুরী (আঙ্গারপাড়া), দলিল উদ্দিন চৌধুরী (দুহসুহ), আকবর আলী শাহ (আলোকডিহি), আজম আলী শাহ (আঙ্গারপাড়া), তমিজ উদ্দিন সরকার (গোবিন্দপুর), খোকারাম রায় (ডুবুলিয়া), হাজি তাজিম উদ্দিন (গোবিন্দপুর), ফজলার রহমান (ডাঙ্গাপাড়া), আফাজ উদ্দিন শাহ (মারগাঁও), ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় (সাবেক গুলিয়ারা), আব্দুল জব্বার সরকার (দুহসুহ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মো. গোলাম রহমান ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণপুরুষ। তিনি দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া করার সময় ছাত্রলীগ করতেন। তিনি ছিলেন একজন তুখোড় বক্তা ও সংগঠক। একবার তিনি ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর ইউনিয়ন প্রেসিডেন্টদের ভোটে দিনাজপুর জেলা পরিষদের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তাঁদের মধ্যে হাফিজ উদ্দিন শাহ (সাবেক গুলিয়ারা), ফজর উদ্দিন আহমেদ (আলোকঝারি), আশিকুর রহমান (আলোকঝারি), ফজর আলী মেম্বার (পরমেশ্বরপুর), শশধর গোস্বামী (টংগুয়া), বশির উদ্দিন পাটোয়ারী (শরহদ্দ), শুকুর শাহ (আঙ্গারপাড়া), বাউলা শাহ (আঙ্গারপাড়া), ভ্রমর চন্দ্র রায় (ছাতিয়ানগড়), প্রমোদ চন্দ্র রায় (ছাতিয়ানগড়), আব্দুল গফুর শাহ (হাসিমপুর), আলিম উদ্দিন (গোয়ালডিহি), বজর উদ্দিন শাহ (হাসিমপুর), সুকুমার রায় (আলোকঝারি), আজিমউদ্দিন আহমেদ (গোবিন্দপুর) নমির উদ্দিন (টংগুয়া), নয়া মিয়া (হোসেনপুর), মজিবর রহমান (সুবর্ণখুলি), মো. তমিজউদ্দিন (ছাতিয়ানগড়), আব্দুল মজিদ (ছাতিয়ানগড় উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক), আকবর আলী শাহ (গোলাম রহমানের ভগ্নীপতি, মুক্তিযুদ্ধের পর রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান), ডা. শাফিয়ার রহমান (যুগিরঘোপা), মো. সিরাজ উদ্দিন (যুগিরঘোপা), আব্দুল লতিফ চৌধুরী (দুহসুহ), ময়েনউদ্দিন সরকার (দুহসুহ), গফুরুল্লাহ শাহ (কাচিনিয়া), আজিজুর রহমান ধুলু (আগ্রা), মো. হামিদউদ্দিন হামিদ (আগ্রা), এডভোকেট জহিরউদ্দিন (গোয়ালডিহি), খোকারাম রায় (ডুবুলিয়া), আব্দুল জব্বার ডিলার (পশ্চিম হাসিমপুর), রাজেন্দ্রনাথ রায় (হাসিমপুর), হাজী মো. খতিবুদ্দিন (পশ্চিম হাসিমপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাকেরহাটের আব্দুল জব্বার হেডমাস্টারের বাড়ি থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। এ বাড়ি, আঙ্গারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ মাঠ ও খানসামা হাইস্কুল মাঠ থেকে অধিকাংশ সময় মিছিল বের করা হতো। মারগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন আওয়ামী লীগ নেতা ও স্কুল শিক্ষক শাহ মো. আব্দুল জব্বার (ভাবকী)। তিনি কলেজ জীবনে পিএনসিসি (পাকিস্তান ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) ও সিভিল ডিফেন্সে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তাঁর ছাত্র আব্দুল মজিদ (পাকেরহাট)-এর নিকট থেকে দুটি রাইফেল সংগ্রহ করে তিনি ১০-১২ জন যুবককে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের প্ৰশিক্ষণ দেন।
উপজেলায় মুজিব বাহিনীর যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন শামসুল হক চৌধুরী (পিতা আব্দুল লতিফ চৌধুরী, গুলিয়ারা; ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পাঠচক্র সম্পাদক), ডেপুটি কামন্ডার ছিলেন আব্বাস আরেফিন (পিতা জমির উদ্দিন, গোয়ালডিহি) ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (পিতা দলিল উদ্দিন চৌধুরী, গুলিয়ারা)
খানসামার সংগ্রামী জনতা সীমান্তবর্তী চিরিরবন্দরের রাণীরবন্দর ও ভূষিরবন্দর, নীলফামারীর দারোয়ানী বাজার এবং খানসামার গোবিন্দপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধযুদ্ধে সহযোগিতা করে। বিহারি অধ্যুষিত শহর সৈয়দপুরে ২০শে মার্চ থেকে অবাঙালিরা বাঙালিদের ওপর হামলা, তাদের হত্যা ও তাদের ঘরবাড়িতে লুটপাট চালাতে থাকে। এ সংবাদে সৈয়দপুরের নিকটবর্তী চিরিরবন্দর থানার ২নং সোনাতলা (বর্তমানে ১২নং আলাদীপুর) ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহতাব বেগের নেতৃত্বে কয়েক হাজার জনতা সৈয়দপুরের বিহারিদের প্রতিহত করতে গেলে খানসামার সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে খানসামার সাধারণ মানুষও অংশ নেয়। তারা প্রতিরোধকারীদের সাহায্যার্থে খাবার (চিড়া, মুড়ি, ডিম, কলা ইত্যাদি) সঙ্গে নিয়ে যায়। ২৩শে মার্চ বিহারিদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে মাহতাব বেগ শহীদ হন। এমতাবস্থায় সেখানে খাদ্যসামগ্রী দেয়া সম্ভব না হওয়ায় ভূষিরবন্দরে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট তা পৌছে দেয়া হয়। ২৬শে মার্চ থেকে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত দিনাজপুর জেলা সদর ও ঠাকুরগাঁও জেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরাজিত হয়। কিন্তু সৈয়দপুরে ক্যান্টনমেন্ট থাকায় সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে পারেননি। বরং পাকবাহিনী সৈয়দপুরে শক্তি সঞ্চয় করে ৫ই এপ্রিল থেকে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে অগ্রাভিযান শুরু করে। ৯ই এপ্রিল তাদের সাঁড়াশি আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমাগত পিছিয়ে দশমাইল-ঠাকুরগাঁও সড়কের ভাতগাঁও ব্রিজে ডিফেন্স নেন। একই সঙ্গে পাকবাহিনী নীলফামারীর দিকে অগ্রসর হয় এবং ইপিআর সুবেদার আব্দুল হাফিজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নীলফামারীর দারোয়ানীতে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে এসে ১৩ই এপ্রিল খানসামার পশ্চিম গোবিন্দপুরে আত্রাই নদীর তীরে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ ব্যূহ রচনা করেন। পাকবাহিনী ভাতগাঁও ব্রিজ দখলে ব্যর্থ হয়ে আত্রাই নদী পার হয়ে পেছন দিক দিয়ে ব্রিজ আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী দু-কোম্পানি সৈন্যসহ ভাতগাঁওয়ের দিকে অগ্রসর হয়। তারা আত্রাই নদীর তীরে পশ্চিম গোবিন্দপুরে পৌঁছামাত্র সেখানে অবস্থানরত সুবেদার আব্দুল হাফিজের বাহিনী তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এতে অনেক পাকসেনা হতাহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী দারোয়ানী ও চিরিরবন্দর দিয়ে খানসামায় অনুপ্রবেশ করে এবং ডাকবাংলো, থানা, খানসামা হাইস্কুল ও আলোকডিহি হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। তাছাড়া খানসামার আত্রাই নদীকে কেন্দ্র করে নদীতীরবর্তী ৩-৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পাকবাহিনী স্থায়ী ডিফেন্স গড়ে তোলে। এছাড়া ১নং আলোকঝারি ইউনিয়ন কাউন্সিল কার্যালয়, ২নং ভেরভেরী ইউনিয়নের টংগুয়া দাখিল মাদ্রাসা, ৩নং আঙ্গারপাড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল কার্যালয়, ৪নং খামারপাড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল সংলগ্ন একটি ঘর, ৫নং ভাবকী ইউনিয়নের কাচিনিয়া হাইস্কুল এবং ৬নং আলোকডিহি ইউনিয়ন কাউন্সিল কার্যালয়ে -রাজাকার- ক্যাম্প স্থাপিত হয়। নীলফামারী জেলা সদর থেকে খানসামার দূরত্ব কম (১৫ কিলোমিটার) হওয়ায় পাকিস্তানি সেনারা নীলফামারী থেকেও খানসামাকে নিয়ন্ত্রণ করত। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই মুসলিম লীগ-এর ছত্রছায়ায় পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি – ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। খানসামা থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মো. বশির উদ্দির মাস্টার (আঙ্গারপাড়া; মুসলিম লীগ নেতা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আয়োজিত উপনির্বাচনে এমএনএ নির্বাচিত হয়)। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সাইফুদ্দিন আহমেদ (ভেরভেরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কুখ্যাত রাজাকার), মো. সিরাজ উদ্দিন আহমেদ (৬নং গোয়ালডিহি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কুখ্যাত রাজাকার), ইয়াসিন কাজী (গোয়ালডিহি), জমির উদ্দিন (আঙ্গারপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান), মজিবর রহমান চৌধুরী (৪নং খামারপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কুখ্যাত রাজাকার), কফুর আলী সরকার (বালাডাঙ্গি), আজিজুল হক চৌধুরী (বালাডাঙ্গি), নূর মোহাম্মদ (খানসামা ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার), কিনু মিয়া (পানুয়াপাড়া), আব্দুল হাই (খানসামা বাজার), মাজার উদ্দিন (খামারবাইস), ইজার উদ্দিন (শুশুলি), আব্দুর রশিদ (বাসুলি), আব্দুল বশির (বাসুলি), আব্দুল কাদের (হোসেনপুর), ফয়েজ উদ্দিন (গোলাদীঘি), মসির উদ্দিন (কৈলাশপুর), আবুল হোসেন (খানসামা), ইয়াসিন (খানসামা), আব্দুল ওয়াদুদ (দক্ষিণ জয়দেবপুর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নূর মোহাম্মদ এলাকায় মেজর হিসেবে পরিচিত ছিল। তার নেতৃত্বে অন্য রাজাকাররা যুবতীদের ধরে এনে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিত। সে নিজে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন করত।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে গণহত্যা চালালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র উপেন্দ্র নাথ রায় (পিতা মদন মোহন রায়, গুলিয়ারা) শহীদ হন। পাকবাহিনীর ভয়ে খানসামা থানা সংগ্রাম কমিটির নেতা ও খানসামা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অমিয় কুমার গুহ গোয়ালডিহি ইউনিয়নের ডুবুলিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা খোকারাম রায়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। জুলাই মাসে শান্তি কমিটির নেতা মো. সিরাজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী ঐ বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। তারা তাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে খাটামারী ব্রিজের নিকট বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে হত্যা করে।
মো. গোলাম রহমান এমপিএ-এর ছোটভাই শাহ মাহতাব উদ্দিন (পিতা জমির উদ্দিন শাহ, গোয়ালডিহি) রসায়নশাস্ত্রে মাস্টার্স পাস করে ভিয়েনাতে এমফিল করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে দেশে ফিরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। তিনি ও তাঁর ভাতিজা মো. সুজা (পিতা শাহ আফতাব উদ্দিন, গোয়ালডিহি) এলাকার ব্রিজের কয়েকটি ছবি তুলে নিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে চিরিরবন্দর এলাকায় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকবাহিনী ভাটিয়াপাড়া ও গোবিন্দপুর গ্রামের অনেক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
খানসামা উপজেলায় দুটি গণহত্যা সংঘটিত হয়- রায়পাড়া গণহত্যা ও গোবিন্দপুর গণহত্যা। মে মাসে সংঘটিত রায়পাড়া গণহত্যায় ১৪ জন এবং ১৩ই ডিসেম্বর সংঘটিত গোবিন্দপুর গণহত্যায় ৮ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।
খানসামা থানা, খানসামা ডাকবাংলো, খানসামা হাইস্কুল ও আলোকডিহি হাইস্কুলে স্থাপিত হানাদার ক্যাম্প এবং খাটামারী ব্রিজ পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রাজাকার ক্যাম্পগুলোতেও নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও আওয়ামী লীগের নেতা- কর্মীদের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে দিনের পর দিন এসব ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়।
খানসামার অনেক সাধারণ মানুষকে নীলফামারী ও চিরিরবন্দরে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। খানসামা ডাকবাংলো ছিল পাকবাহিনীর নারীনির্যাতনের প্রধান কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক যুবতীকে ধরে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হয়। ১৪ই ডিসেম্বর খানসামা হানাদারমুক্ত হওয়ার দিন এখান থেকে ৭ জন নির্যাতিতা নারীকে উদ্ধার করা হয় এবং ১০-১২ জন নারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, যাদের শরীরে পাশবিক নির্যাতন ও গুলির চিহ্ন ছিল।
খানসামা ডাকবাংলো ও আত্রাই নদীর তীর অঞ্চল ছিল বধ্যভূমি। রাজাকারদের সহগযোগিতায় পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত লোককে ধরে এনে এখানে হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে ফেলে দিত। ডাকবাংলোতে যুবতীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে তাদের লাশ ডাকবাংলো চত্বরের বাংকারে ফেলে দিত। গোবিন্দপুর গ্রামের রায়পাড়া গণহত্যায় শহীদের লাশ ঘটনাস্থলেই মাটিচাপা দেয়া হয়। পশ্চিম গোবিন্দপুর গণহত্যায় শহীদদের লাশ বাংকারে ফেলে দেয়া হয়। পরে নদীভাঙ্গনে সেগুলো বিলীন হয়ে যায়।
খানসামা উপজেলার গোবিন্দপুরে ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়। এটি ছিল প্রতিরোধযুদ্ধ। এতে মুক্তিযোদ্ধারা শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করেন এবং বীরগঞ্জ পাকসেনাদের দখলে চলে যায়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও সদর ও দিনাজপুরের বীরগঞ্জ মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী একত্রে খানসামার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ই ডিসেম্বর গোবিন্দপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। গোবিন্দপুর যুদ্ধ-এ ১১ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১৭ জন ধরা পড়ে। বাকি পাকসেনারা পিছু হটে নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
খানসামার গ্রামাঞ্চল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই মুক্ত হয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর তৎপরতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে শুধুমাত্র প্রশাসনিক এলাকার মধ্যে। ১৪ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী অভিযান চালায়। তীব্র যুদ্ধের পর ১৪ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পাকসেনারা নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। ফলে এদিনই খানসামা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
খানসামা উপজেলায় দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন হায়দার আলী চৌধুরী (পিতা হাফেতুল্লাহ চৌধুরী, ভেরভেরী) ও ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা (পিতা হাজী মির্জা শাফিয়ার রহমান, ছাতিয়ানগড়; যশোর প্রতিরোধযুদ্ধে শহীদ)।
২০১৫ সালে দিনাজপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে পাকেরহাট ডিগ্রি কলেজ মোড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে খানসামা উপজেলার ৯১জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ইউনিয়নভিত্তিতে খোদাই করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আকবর আলী শাহ স্মরণে ১৯৮৮ সালে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে পাকেরহাটে ‘আকবর আলী শাহ উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভারতে যাওয়ার পথে চিরিরবন্দর এলাকায় রাজাকারদের হাতে শহীদ শাহ মাহতাব উদ্দিনের পুত্র শাহ মো. আবু হাসান টুটুল গোয়ালডিহিতে ‘বাংলা ভাষা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। [লাভলী আজাদ লিজা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৩য় খণ্ড