জব্বার ইঞ্জিনিয়ার নামে পরিচিত আব্দুল জব্বার মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরােজপুরের মঠবাড়িয়ায় রাজাকার বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার ছিল। তার বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরােধী সুনির্দিষ্ট অভিযােগ। ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট ৫টি অভিযােগ গঠনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। শুরু হয় তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধ মামলার কার্যক্রম।বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হােসেন ও বিচারপতি আনােয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ অভিযােগ গঠনের আদেশে বলেন, স্থানীয়ভাবে ‘জব্বার ইঞ্জিনিয়ার’ নামে পরিচিত আসামির জন্ম পিরােজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার খেতাছিরা গ্রামে। ১৯৬৪ সালে সে মুসলিম লীগ থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে সে জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। সর্বশেষ সে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাে। একাত্তরে সে মঠবাড়িয়া শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাে এবং তার পরামর্শে মঠবাড়িয়ায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে মঠবাড়িয়ায় শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের সহযােগী বাহিনী হিসেবে কাজ করে এবং মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটন করে। একাত্তরের ১৬ মে বিকেলে জব্বারের নির্দেশ অনুসারে রাজাকাররা ফুলঝুড়ি গ্রামের। আবদুর রাজ্জাক বিশ্বাস ও মােতালেবের বাড়িতে হামলা করে ও নির্বিচারে গুলি। চালায়। গুলিবিদ্ধ রাজ্জাক তিন দিন পর মারা যান, মােতালেব গুরুতর আহত হন। একই দিন সন্ধ্যায় রাজাকাররা নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার শতাধিক বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযােগ করে। একাত্তরের ১৭ মে ৩০-৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৪০-৪৫ জন সশস্ত্র ।
রাজাকারকে নিয়ে জব্বার ফুলঝুড়ি গ্রামে হামলা চালায়। তার নির্দেশে রাজাকাররা। সারদা কান্তি পাইককে গুলি করে হত্যা করে। এরপর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ওই গ্রামের প্রায় ৩৬০টি ঘরবাড়ি লুট করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। একাত্তরের ২২ মে জব্বারের নেতৃত্বে রাজাকাররা মঠবাড়িয়ার নলীগ্রামে হামলা চালায়। জব্বার পিস্তল দিয়ে সুখনাথকে গুলি করে হত্যা করেন, তাঁর নির্দেশে সহযােগীরা ১১ জন হিন্দুধর্মাবলম্বীকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় জব্বারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযােগ আনা হয়েছে। একাত্তরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ফুলঝুড়ি গ্রামের প্রায় ২০০ হিন্দুকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে জব্বার। একাত্তরের ৬ ও ৭ অক্টোবর জব্বারের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে রাজাকাররা। আঙ্গুলকাটা ও মঠবাড়িয়া থেকে ৩৭ জন হিন্দুধর্মাবলম্বীকে অপহরণ করে, যার মধ্যে ২২ জনকে পরে হত্যা করা হয়। বাকি ১৫ জন নির্যাতনের শিকার হন।
ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ১২ মে জব্বারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযােগ আমলে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ৮ জুলাই তাকে পলাতক। ঘােষণা করে মামলার কার্যক্রম শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ সালে মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে আবদুল জব্বার আত্মগােপনে রয়েছে।
জব্বারের যত অপরাধ
মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরােজপুরের মঠবাড়িয়ার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৯ মে তদন্ত শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করেন তদন্ত সংস্থা। ওই প্রতিবেদনের নথিপত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণসহ যাবতীয় বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ১১ মে জব্বারের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযােগে ৭৯ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযােগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়। জব্বারের বিরুদ্ধে ৩৬ জনকে হত্যা, ২০০ জনকে ধর্মান্তর, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে ৫৫৭টি বাড়িঘর ধ্বংস করার অভিযােগ আনা হয়েছে। তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, জব্বার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বসবাস করছে।
সাক্ষী শােয়েবুর রহমান তার সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ মে সকালে আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩০-৩৫ জনের একটি দল নিয়ে ফুলঝুড়ি গ্রামে ঢােকে। ওই সময় শারদা কান্ত পাইক দৌড়ে পালানাের চেষ্টা করলে তাঁকে দেখে জব্বার ইঞ্জিনিয়ার বলে, “ওই মালাউন যায়, ওকে গুলি কর।’ তখন পাকিস্তানি সেনারা সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে।’ সাক্ষী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর জব্বারের নির্দেশে রাজাকার কমান্ডার ইস্কান্দার মৃধার নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন রাজাকার আঙ্গুলকাটা গ্রামসহ মঠবাড়িয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ৩৭ জন হিন্দু লােককে আটক করে তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের পর সাতজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে তাদের মধ্য থেকে ২২ জনকে সূর্যমণি গ্রামের নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। আটজন গুলিবিদ্ধ হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। সাক্ষী শােয়েবুর রহমান পিরােজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটির দায়িত্ব নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার জব্বার স্থানীয় ইস্কান্দার আলী মৃধাকে রাজাকার কমান্ডার হিসেবে নিয়ােগ দেয়। সে সময় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মঠবাড়িয়া থানার বিভিন্ন হাট-বাজারে সভা-সমাবেশ করে আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার। সভাসমাবেশে সে বলতাে, “হিন্দুদের সম্পত্তি ও মালামাল গনিমতের মাল । মুসলমানরা এসব ব্যবহার করতে পারবে। হিন্দুদের এ দেশে থাকতে হলে মুসলমান হয়ে থাকতে হবে।
সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ মে সকাল ১১টার দিকে আসামি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার তুষখালী হাই স্কুল মাঠে এক সভা করে। ওই সভায় মঠবাড়িয়া থেকে আসা জামায়াত এবং শান্তি কমিটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের বক্তব্যের পর আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার বক্তব্য দেয়। ওই সভা থেকে ফুলঝুড়ি গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস ও মােতালেব শরীফকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় তাঁর সামনে হাজির করার জন্য ইস্কান্দার আলী মৃধাকে নির্দেশ দেয় জব্বার। নির্দেশ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস ও মােতালেব শরীফকে ধরার জন্য সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী নিয়ে ইস্কান্দার ফুলঝুড়ি গ্রামে যায়। ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে সাক্ষী খবর পান, ওই দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া তার নির্দেশে পরদিন সন্ধ্যায় তুষখালীর কুলুপাড়া, নাথপাড়ায় গিয়ে রাজাকার বাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর লুট করার পর জ্বালিয়ে দেয়। একই সময়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা মিলে গ্রামের ৩৬০টি বাড়িঘর লুটপাটের পর জ্বালিয়ে দেয়।
সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার