বীর উত্তম খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়া
খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়া, বীর উত্তম (১৯৪৯-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার মালোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আ. লতিফ ভূঁইয়া ও মাতার নাম তাবেন্দা আখতার খাতুন। ৭১ সালে খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমকম পাশ করার পর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ কন্ট্রোলার অব একাউন্টস পদে চাকরিরত অবস্থায় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ৭০-এর নির্বাচনে বাঙালিদের পক্ষের রায় বাঞ্চালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ষড়যন্ত্রের আশ্রয়গ্রহণ, অগ্নিঝরা মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ইত্যাদি খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়ার তরুণ মনকে ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত করে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লে খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়া নীরব থাকতে পারেননি। দেশমাতৃকার মুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে নিজ গ্রামের বাড়ি মালোপাড়া থেকে মার্চ মাসেই ভারতের আগরতলায় যান। সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ৪নং সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার মাহবুব রব সাদীর নেতৃত্বে বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি সাহসিকতাপূর্ণ অবদান রাখেন। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর সাহসিকতা ও সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে মন্তাজগঞ্জ ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সিলেট জেলার কানাইঘাট, মন্তাজগঞ্জ, ভরামাইদ, নন্দিপাড়া, মনিপুর, সড়কের বাজার, সিলেট শহর ইত্যাদি স্থানে বীরত্বের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে বহু পাকসেনা ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার-দালালদের হত্যা করেন। নিজামুদ্দিন তাঁর বাহিনী নিয়ে মাহবুবুর রব সাদীর নেতৃত্বে আগস্টের শেষ সপ্তাহে এক ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে সারোপার দখল করে নেন। এতে শত্রুবাহিনীর সিলেট থেকে কুলাউড়া আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ২রা সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধের পর তাঁরা লুবাছড়া চা বাগান দখল করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল চা বাগানগুলো তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রেখে চা উৎপাদন ও রফতানির মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ রুদ্ধ করা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লুবাছড়া চা বাগান পুনর্দখলের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে, কিন্তু তাদের বারংবার আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অবশেষে ৪ঠা সেপ্টেম্বর তারা বড় ধরনের সামরিক শক্তি নিয়ে লুবাছড়া চা বাগান দখলে আক্রমণ পরিচালনা করে। তাদের ঐ আক্রমণ বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করা অবস্থায় হঠাৎ শত্রুর ছোড়া গোলার আঘাতে নিজামুদ্দিন ভূঁইয়া শহীদ হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান ও আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁইয়াকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে (মরোণোত্তর) ভূষিত করে। তিনি ছিলেন অবিবাহিত। [শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড