You dont have javascript enabled! Please enable it!

খাগডহর প্রতিরোধযুদ্ধ (ময়মনসিংহ সদর)

খাগডহর প্রতিরোধযুদ্ধ (ময়মনসিংহ সদর) সংঘটিত হয় ২৭ ও ২৮শে মার্চ। খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে ঐ তারিখে বাঙালি ও অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের মধ্যে সংঘটিত প্রতিরোধযুদ্ধে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসসহ ১৩৮ জন অবাঙালি ইপিআর সদস্য প্রাণ হারায়। এ প্রতিরোধযুদ্ধের পর এখান থেকে ১৪শ রাইফেল, ২৮টি এলএমজি ও প্রচুর গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
ময়মনসিংহ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ছিল খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প। ১৯৭১ সালে এখানে ইপিআর- এর ২নং উইংয়ের হেডকোয়ার্টার্স ছিল। এ উইংয়ের ৪টি কোম্পানির ৩টি ছিল সীমান্ত এলাকায়। হেডকোয়ার্টার্সে তখন একটি কোম্পানি ছিল। সুবেদার ফরিদ উদ্দিন ও ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির মেজর নুরুল ইসলাম শিশুসহ বাঙালি ইপিআর-এর একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য তখন হেডকোয়ার্টার্সে ছিলেন। অপরদিকে ১৩৮ জন অবাঙালি ইপিআর সদস্য ছিল।। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস।
২৫শে মার্চ ঢাকার পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর পাকসেনারা দখলে নেয়। ২৬শে মার্চ পিলখানা থেকে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে জরুরি প্রয়োজনে খোঁজা হয়। তখন ওয়ারলেস সেটে ডিউটিতে ছিলেন একজন বাঙালি অপারেটর। জরুরি বার্তা পেয়ে ক্যাপ্টেন কমর সেটে গিয়ে বসে। দুপক্ষের কথা শুনে বাঙালি অপারেটর ফরহাদ মিয়ার সন্দেহ হয়। কথা শেষে ক্যাপ্টেন কমর সুবেদার ফরিদ উদ্দিনকে ডেকে অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রামে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশে বাঙালিদের মনে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
এদিকে সকালে একদল স্থানীয় যুবক ছাত্রনেতা ম. হামিদের নেতৃত্বে ক্যাম্পে এসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেয়। এতে বাঙালি সৈনিকরা উজ্জীবিত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাপ্টেন কমর রাতের অন্ধকারে জমাখানা থেকে প্রচুর অস্ত্র গাড়িতে লোড করে তার বাংলোর দিকে রওনা দেয়। বাঙালি সৈনিকরা পথে তাকে বাধা দেয়। ফলে দুপক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং এক সময় গুলি চলে। গুলিতে ঘটনাস্থলে বাঙালি সিপাহি দেলোয়ার হোসেন শহীদ হন। গুরুতর আহত হন সিপাহি আব্দুর রাজ্জাক। এ খবর মুহূর্তের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূঁইয়াসহ চারদিকে সবার কাছে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
ইতোমধ্যে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্যাম্পের গেটে উড়ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা, বাজছিল বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ। একজন বাঙালি সৈনিকের শহীদ হওয়ার খবর স্বাধীনতাকামী বাঙালি সৈনিকদের ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। গভীর রাতে ব্যারাক হাউজে একটানা গুলি চলছিল। ভোরে সিপাহি আফতাব সিপাহি হারুনকে মেগাফোন হাতে দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে বলেন। ‘জয় বাংলা” স্লোগান দিতে গিয়ে তাঁরা দেখেন দা, লাঠি, রামদা, ফালা, বল্লম হাতে হাজার-হাজার মানুষ চতুর্দিকে ক্যাম্প ঘিরে রেখেছে। বাঙালি সৈনিকরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। ২৭ ও ২৮শে মার্চ একটানা ১৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এতে অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা ক্যাম্প দখলে নিয়ে বাঙালিদের নিরস্ত্র ও হত্যার যে পরিকল্পনা করেছিল, তা ব্যর্থ হয়। ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসসহ ১৩৮ জন অবাঙালি ইপিআর সদস্যের সবাই প্রাণ হারায়। রণক্ষেত্রে ৩ জন সাধারণ মানুষের লাশ পাওয়া যায়। এটি ছিল খাগডহর প্রথম যুদ্ধ। এ-যুদ্ধের পর ১৪শ রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, ১ লক্ষ ৩৫ হাজার রাইফেলের গুলি, ৩৬ হাজার ৯ এমএম গুলিসহ প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী স্বাধীনতাকামী সৈনিকদের দখলে আসে। এসব অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানি ৩৬ এডহক ডিভিশনের ৯৩ ব্রিগেডের অগ্রযাত্রা এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় এক মাস ঠেকিয়ে রাখেন। [বিমল পাল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!