You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ১৯৭১ সালের ১লা জানুয়ারি রামগড় থেকে মহকুমা সদর চেঙ্গী বিধৌত খাগড়াছড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এর পূর্ব পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ছিল একটি ইউনিয়ন দুর্গম পাহাড় আর অরণ্য পরিবেষ্টিত একটি অঞ্চল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরীকে সভাপতি এবং মো. নূর বক্স মিঞাকে সাধারণ সম্পাদক করে খাগড়াছড়ি মহকুমায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন- হাজী বাদশা মিঞা, জয়নাল আবেদীন খন্দকার এবং কবির আহম্মদসহ অন্যান্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এ কমিটির উদ্যোগে সকল থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় নিয়মিত মিটিং- মিছিলে মুখরিত ছিল খাগড়াছড়ি মহকুমা সদর। ২৬শে মার্চ খুব ভোরে রামগড় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহম্মদ পিসিও তারযোগে খাগড়াছড়ি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল আজিমকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর জানান। একই দিন সকাল ১০টায় সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে মিছিল সহকারে মহকুমা প্রশাসকের অফিসের পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ঐদিন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়। এমনি অবস্থায় অত্র অঞ্চলের সর্বত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনার প্রস্তুতি শুরু হয়।
এপ্রিলের প্রথম দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হোসেন তৌফিক ইমাম খাগড়াছড়িতে আসেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এর পরপরই ক্যাপ্টেন অলী আহমদ, মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-সহ কয়েকজন সামরিক অফিসার খাগড়াছড়ি আসেন। তারা দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী, মো. নূর বক্স মিঞাসহ সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন গ্রুপ কমান্ডারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শেষে রামগড় চলে যান। ২৫শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন মীর শওকত আলী খাগড়াছড়ি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। পার্বত্য এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধার্থে নাকাপা, কুমারী, পাগলাপাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যুগ্যাছলা, গাড়িটানা প্রভৃতি এলাকার গভীর অরণ্যে গোপন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। জুন মাসে শিলছড়ি ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান চৌধুরীর পরামর্শে তবলছড়ির মুক্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১৬ই জুন পাকবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প গুটিয়ে ভারতে চলে যান। এছাড়া মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য একটি ক্যাম্প ও একটি লঙ্গরখানা স্থাপন করা হয়। এ ক্যাম্প ও লঙ্গরখানার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন মহালছড়ির গ্রুপ কমান্ডার মোবারক আলী মাস্টার। যুদ্ধের কৌশলগত কারণে খাগড়াছড়ি সদর মহালছড়ির আধীনে ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে খাগড়াছড়িকে এক নম্বর সেক্টরের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খাগড়াছড়িতে যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আলহাজ্ব দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন মো. আলী আশরাফ, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা, মো. মোবারক আলী, মো. নুরুন্নবী, মংশোয়ে অং মারমা (জুলু বাবু) প্রমুখ। ২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ি অভিমুখে জলপথে অগ্রসর হয়। মহালছড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করেন এবং সেখানে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের অসীম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদত্বরণ করেন। ২৭শে এপ্রিল মহালছড়ি পতনের পর পাকবাহিনী ঐদিন খাগড়াছড়ি দখল করে নেয়। এরপর তারা গুইমারা সড়ক ধরে রামগড় দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়।
২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী খাগড়াছড়িতে অনুপ্রবেশ করে মিজোবাহিনীর সহায়তায় ভাইবোনছড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। খাগড়াছড়িতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি-র অস্তিত্ব না থাকলেও মিজোবাহিনী পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করে।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা উল্লেখযোগ্য কোনো হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ বা লুণ্ঠনের মতো ঘটনা ঘটাতে পারেনি।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় অনেকগুলো যুদ্ধ ও অপারেশনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ভাইবোনছড়া অপারেশন ও খাগড়াছড়ি অপারেশন উল্লেখযোগ্য। ভাইবোনছড়া অপারেশন পরিচালিত হয় দুদফায় অক্টোবর/নভেম্বর মাসে প্রথমবার এবং ৬ই ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার। এ অপারেশনে হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের অনেকে হতাহত হয়। খাগড়াছড়ি অপারেশন পরিচালিত হয় ১৪ই ডিসেম্বর। এ অপারেশনে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী মিজো, রাজাকার ও হিলরাজ বাহিনীর ৩০- ৪০ জনের মতো হতাহত হয়। ১৫ই ডিসেম্বর ভাইবোনছড়া থেকে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। ঐদিনই সাব-ডিভিশন কমান্ডার দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন অশোক দাসগুপ্ত, ইপিআর নায়েক সুবেদার খায়েরুজ্জামান, পুলিশের হাবিলদার আহম্মদ উল্লাহ, এফ এফ কমান্ডার মো. আলী আশরাফ, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, মো. মোবারক আলী, মংশোয়ে অং মারমা (জুলু বাবু), মো. নুরুন্নবী প্রমুখের উপস্থিতিতে খাগড়াছড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৫ই ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
খাগড়াছড়ি টাউন হলে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। মহালছড়ির প্রতিরোধযুদ্ধে (২৭শে এপ্রিল) শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (পিতা আবদুল কাদের, রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর)-এর নামানুসারে খাগড়াছড়ি শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ কাদের সড়ক। তাঁর স্মরণে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের পাশে একটি স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়েছে। [করেন্দ্র ত্রিপুরা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড