খয়েরগনি গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর)
খয়েরগনি গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ২০শে জুলাই। এতে প্রায় অর্ধশত সাধারণ লোক শহীদ হন। নবাবগঞ্জ উপজেলা থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বদিকে খয়েরগনি গ্রাম অবস্থিত। ৭নং দাউদপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত এ গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার ও আলবদররা নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়। এর কারণ, এ গ্রামের জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়; মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য- সহযোগিতা করে এবং যুবকদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে চলে যায়। জুলাই মাসের প্রথম দিক থেকে পাকসেনারা গ্রামটিতে প্রায়ই টহল দিতে আসত। তারা তাদের দোসর রাজাকার- আলবদরদের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে ও যুবসমাজকে সন্ত্রস্ত রাখতে প্রায়ই হানা দিত এমনকি হানাদার বাহিনী গ্রামের বাড়িঘরে লুটতরাজে রাজাকারদের সহযোগিতা প্রদান করে। এসব রাজাকারদের কয়েকজন হলো- জালাল উদ্দিন, আবুল মাস্টার, রিয়াজ উদ্দিন এবং ফয়েজ মাস্টার। এদের সহায়তায় পাকবাহিনী গ্রাম থেকে যুবতীদের তুলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালাত।
১৯শে জুলাই রাত ৩টার দিকে পাকসেনারা অতর্কিতে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং পরের দিন ভোর থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত তল্লাশি চালায়। তাদের তল্লাশির ফাঁকে বেশকিছু নারী-পুরুষ গ্রাম থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাকিদের পাকসেনারা জোর করে গ্রামে প্রবেশপথের পাশের এক মাঠে জড়ো করে। সেখানে যুবক, মধ্যবয়সী আর বৃদ্ধ মিলিয়ে ৬০-৭০ জনের মতো গ্রামবাসীকে হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ফেলে রাখা হয়। তারপর পাকসেনারা তাদের লাথি আর বেয়নেট দিয়ে অবিরত খোঁচাতে থাকে। এভাবে নির্যাতন চালাতে-চালাতে সকাল ১১.৩০টার দিকে হানাদার বাহিনী অতর্কিতে বন্দিদের ওপর এলএমজি দিয়ে ফায়ার করে।
এতে দুজন প্রাণ হারায় এবং অনেকে আহত হয়। এরপর পাকবাহিনী প্রায় ৩০ জনকে রেখে আহত কয়েকজনসহ বাকিদের ছেড়ে দেয়। দুপুর ১২টার দিকে তাদের বিরামপুরের উদ্দেশে গাড়িতে তোলা হয়। হঠাৎ হানাদার বাহিনী তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে বহুদূর পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। তারপর আবার গাড়িতে তুলে পুণ্যের দহ ব্রিজের নিচে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সে-সময় গ্রামের অনেক মহিলা খয়েরগনি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়ার শাখানদীর পাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের দু- একজন এই নিষ্ঠুর গণহত্যার সাক্ষী হয়ে খয়েরগনি গ্রামে এখনো বেঁচে আছেন।
একইদিন ১১টার দিকে পাকবাহিনী খয়েরগনি গ্রামের রিফুজিপাড়ায় বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। খয়েরগনি গণহত্যায় যেসব শহীদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- আইজুল (পিতা নেজাম পাটুরি), মো. মোকছেদ হোসেন (পিতা বাবর মণ্ডল), আমজাদ হোসেন (পিতা বাবর মণ্ডল), বদিউজ্জামান (পিতা মনিরউদ্দিন), আফতাব মাস্টার (পিতা খয়ার মণ্ডল), ঘুটটু (পিতা খয়ার মণ্ডল), মোজাহার (পিতা দারাজ উদ্দিন মণ্ডল), তোজাহার (পিতা দারাজ উদ্দিন), আব্দুল লতিফ (পিতা ইছার উদ্দিন মণ্ডল), আলকাস আলী (পিতা আকবার আলী), আব্বাস আলী (পিতা আকবার আলী), মাহাতাব উদ্দিন (পিতা খয়ের উদ্দিন), কাফি (পিতা আব্বাস মণ্ডল), আবজাল (পিতা তমিজ পাটুরি), কিনা (পিতা ঈসমাইল মণ্ডল), গমির মণ্ডল (পিতা গুড়া মণ্ডল), নইমউদ্দিন (পিতা এমাজউদ্দিন), বকাই মুন্সি (পিতা হাবিবুল্লাহ), ময়েজ উদ্দিন, আবু বক্কর (পিতা বাচ্চান), আকালু (পিতা ওকির পরামাণিক, সারিয়াকান্দি, বগুড়া), আনোয়ারা (পিতা আমজাদ হোসেন), সাজ্জাদ মণ্ডল (পিতা তমিজ উদ্দিন মণ্ডল), সাইফুদ্দিন (পিতা মো. আহমদ আলী), আব্দুল গফুর (পিতা সেরাফত আলী), রইছ উদ্দিন (পিতা সেরাফত আলী), গুদা, এবং রিয়াজ উদ্দিন (পিতা মো. আহমদ আলী)। সেদিন যারা আহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- জেলেখা (পিতা আবজাল), মহাসেন মণ্ডল (পিতা এজাম পাটুরি), মকলেছার রহমান (পিতা মহাসিন), আনোয়ারা (পিতা আমজাদ হোসেন) এবং সব্দুল হোসেন (পিতা নছের ঘরমি)। [মাসুদুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড