খলিশাখালী গণহত্যা (চিতলমারী, বাগেরহাট)
খলিশাখালী গণহত্যা (চিতলমারী, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ২০শে জুন। বাগেরহাট জেলার চিতলমারী থানার খলিশাখালী গ্রামে পাকবাহিনী, রাজাকার- এবং স্থানীয় ও বহিরাগত দালালদের যৌথ আক্রমণের পর এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এদিন সকাল ১০টায় চিতলমারীর দশ মহলে রাজাকার ও পাকসেনারা চতুর্মুখী আক্রমণ চালায়। দশ মহল হলো চিতলমারী উপজেলার বেশকিছু গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি বিশাল হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। দশ মহলের একটি গ্রাম খলিশাখালী। গ্রামটি চিতলমারী বাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত। এখানে শতাধিক নিরীহ মানুষ নিহত হয়।
পিরোজপুর থেকে ভারতে যাওয়ার পথে অনেক শরণার্থী খলিশাখালীতে আশ্রয় নেয়। প্রধানত তারাই খলিশাখালী গণহত্যার শিকার হয়। ২০শে জুন গোপালগঞ্জ থেকে এসে পাকবাহিনীর একটি দল চিতলমারীর বড়গুনিতে ঘাঁটি স্থাপন করে। পরিকল্পনা অনুসারে পিরোজপুর থেকে পাকবাহিনীর অন্য একটি দল কুরামখালী নদী দিয়ে গানবোটে দশ মহলের দক্ষিণ সীমান্ত কালিগঞ্জ বাজারে আসে। অন্য একটি দল পিরোজপুরের হুলারহাট থেকে তালেশ্বর নদী দিয়ে মাঠিভাঙ্গা হয়ে দশ মহলের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বাবুগঞ্জ বাজারে পৌছে। আরেকটি দল বাগেরহাটের মুনিগঞ্জ-কান্দাপাড়া- দেপাড়া-ফুলতলা-সন্তোষপুর হয়ে দশ মহলের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে চিতলমারীতে আসে। প্রত্যেক দলের সঙ্গে ছিল বহিরাগত ও স্থানীয় বহু রাজাকার, আলবদর- ও দালাল। কালিগঞ্জের দলটি পিপড়াডাঙ্গার মধ্য দিয়ে খাসেরহাট বাজারের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে অনেক হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পথে তারা ৭-৮ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ক্ষীরদ চন্দ্র রায় নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। এ-সময় নারীনির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। পাকবাহিনী কর্তৃক সুনীতি মণ্ডল, পুতুল বালা সরকার প্রমুখ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন এবং তাদের শ্লীলতাহানি ঘটানো হয়। পাকসেনারা চরবানিয়ারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নগেন্দ্রনাথ বড়ালের বাড়িসহ অনেক বাড়িতে আগুন দেয়। তাদের সঙ্গে থাকা রাজাকাররা চরবানিয়ারী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ও লুটতরাজ চালায়। মুনিগঞ্জের দলটি কান্দাপাড়া-দেপাড়া-সন্তোষপুর হয়ে চিতলমারী আসার সময় এলোপাতাড়ি গুলি করতে-করতে অগ্রসর হয়। তারা অনেক বাড়িতে আগুন দেয় এবং লুণ্ঠন চালায়। বাবুগঞ্জ বাজারের দলটি খলিশাখালীর পূর্ব প্রান্ত দিয়ে কাঁচা রাস্তা বরাবর চিতলমারীর দিকে অগ্রসর হয় এবং অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ-সময় সঙ্গে থাকা বহিরাগত ও স্থানীয় দালাল ও রাজাকাররা লুটতরাজ চালায়। স্থানীয় রাজাকারদের মধ্যে ছিল চর শৈলদা গ্রামের কটা মুন্সী এবং নালুয়া বাজারের দেলোয়ার হোসেন দিলু।
এখানে আশ্রয় নেয়া অনেক শরণার্থী পাকবাহিনীর আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পাট ও ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। রানা নামে এক ব্যক্তি পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। তারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। নির্মল চন্দ্র রায় নামে এক ব্যক্তি তার শিশুকন্যা ও স্ত্রী-সহ ধানক্ষেতে লুকানোর চেষ্টাকালে পাকসেনারা তাকে পানির মধ্যে চুবিয়ে ও পরে গুলি করে হত্যা করে। তার শিশুকন্যা ও স্ত্রীর সামনে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাকসেনারা বাবু মণ্ডল নামে একজনকে পাটক্ষেত থেকে ধরে এনে তার স্ত্রীর সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এভাবে বাবুগঞ্জ বাজার থেকে খলিশাখালী গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে-যেতে তারা শতাধিক আশ্রয়প্রার্থী বহিরাগত মানুষকে হত্যা করে। বাইরে থেকে আগত বলে নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি। তবে খলিশাখালী গ্রামের যারা নিহত হন, তারা হলেন— খোকাই মণ্ডল (পিতা রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডল), গুরুদাস বৈরাগী (পিতা মনোহর বৈরাগী), নির্মল চন্দ্র রায় (পিতা মধাব চন্দ্র রায়), জিতেন্দ্রনাথ মাঝি (পিতা ত্রৈলক্ষ মাঝি), প্রমথনাথ রাণা (পিতা নটবর রাণা), কালিপদ রায়, ভদ্রকান্ত হীরা, প্রহ্লাদ চন্দ্র মণ্ডল, সুধন্য মণ্ডল, বাবু মণ্ডল (পিতা ভদ্রকান্ত মণ্ডল) এবং লালমতি মণ্ডল (পিতা প্রিয়নাথ মণ্ডল)। [মনীন্দ্র নাথ বোস] খলিষাকুণ্ডি গণহত্যা (দৌলতপুর, কুষ্টিয়া) সংঘটিত হয় অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক খলিষাকুণ্ডি ইউনিয়নের খলিষাকুণ্ডি ব্রিজের ওপরের এ গণহত্যায় ২৫ জন মানুষ শহীদ হন।
হানাদার বাহিনী অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আশপাশের এলাকা থেকে নিরীহ মানুষজন ধরে এনে খলিষাকুণ্ডি মাথাভাঙ্গা নদীর ভাঙ্গা ব্রিজের ওপরে গুলি করে তাদের লাশ পানিতে ফেলে। এ গণহত্যায় খলিষাকুণ্ডির ফজলুর রহমানসহ অন্তত ২৫ জন মানুষ শহীদ হন। দূর-দূরান্ত থেকে ধরে আনা সকলের পরিচয় জানা যায়নি। [মো. ছাদিকুজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড