You dont have javascript enabled! Please enable it!

ক্য চিং ঘাটা যুদ্ধ (বান্দরবান সদর)

ক্য চিং ঘাটা যুদ্ধ (বান্দরবান সদর) সংঘটিত হয় জুন মাসের শেষদিকে। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এপ্রিল মাসে স্থানীয় বোমাং রাজা অংশৈ প্রু চৌধুরীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী বান্দরবান দখলে নেয়। এরপর তারা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও হিল রাজ বাহিনী গড়ে তোলে। পাকিস্তানি ও রাজাকাররা বান্দরবানে ব্যাপক লুটপাট ও নির্যাতন চালায়। বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। এখানে তারা মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্র-যুবক ও নিরীহ নারী- পুরুষদের ধরে এনে তাদের ওপর নির্যাতন চালাত।
রাজাকাররা ৩ গ্রুপে বিভক্ত ছিল। এক গ্রুপ ছিল সশস্ত্র রাজাকার। এরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লুটপাট ও বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিত। আরেক গ্রুপ ছিল সাপোর্টার। এরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও নিরীহ নারী-পুরুষ, ছাত্র-যুবকদের ধরে আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করত। আরেক গ্রুপ ছিল জবাইকারী রাজাকার। এরা নির্যাতন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীদের ধরে এনে নির্যাতন শেষে জবাই করে হত্যা করত। এ ৩ গ্রুপের প্রধান ছিল বোমাং রাজা অংশৈ প্রু চৌধুরী।
এদিকে প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানের শত-শত যুবক ভারতে পাড়ি জমায়। সেখানে শরণার্থী হিসেবে থেকে অনেকেই প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। দেমাগ্রীতে তাদের এক মাসের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেন ভারতীয় প্রশিক্ষক মেজর মুন্ডা। জুন মাসের দিকে গেরিলা কমান্ডার আবদুল ওহাবের নেতৃত্বে ৪৫ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল বান্দরবান আক্রমণের উদ্দেশ্যে ভারত থেকে রুমায় আসে। এ গ্রুপে হরি সাধন শুরুদাশ ওরফে লেদ্যো, সত্যেন্দ্র, প্রীতি কান্তি ত্রিপুরা, কবির আহমদ, ভুবন মোহন ভট্টাচার্য, চিত্ত রঞ্জন মল্লিক, সত্য রঞ্জন মল্লিক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রুমা বাজারে এসে তাঁদের ক্য চিং ঘাটায় যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি বা প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা কোনোটাই ছিল না। তাঁরা বান্দরবান শহরেই আক্রমণ করবেন মর্মে পরিকল্পনা করেছিলেন। যখন তাঁরা রুমা বাজারে পৌঁছেন, তখন রুমায় হাটের দিন ছিল। দুপুরের খাবার শেষে তাঁরা দুটি বোট নিয়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা করবেন। এর আগে বাজারে ম্যালেরিয়ার ওষুধ দিতে আসা কর্মীদের সঙ্গে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার বাকবিতণ্ডা হয়। এসব লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী বোটের আগেই বান্দরবান ফিরে আসে। পথে তারা ক্য চিং ঘাটায় পাকিস্তানি ও রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের খবরটি জানিয়ে যায়।
তখন থেকেই রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণের জন্য অস্ত্র নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে।
বিকেলের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি বোট নিয়ে সঙ্গ নদী দিয়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। ঐদিন আকাশ ছিল মেঘাছন্ন এবং থেমে-থেমে বৃষ্টি পড়ছিল। প্রথম বোটে কমান্ডার আবদুল ওহাবসহ ২০-২২ জন এবং বাকিরা অপর বোটে ছিলেন। দুটি বোট পাশাপাশি চলছিল। তখন বর্ষার শুরু আর নদীটি ছিল খরস্রোতা। কমান্ডার আবদুল ওহাবের বোটে মোতালেব নামে এক মাঝি ছিলেন। বৃষ্টি আর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে তিনি দিক নির্নয় করতে ভুল করেন। তাই গন্তব্যে পৌঁছাতে তাঁদের রাত হয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী বোট দুটি ক্য চিং ঘাটা আসামাত্রই আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা পাকসেনা ও রাজাকাররা গুলি ছুড়তে থাকে। শত্রুদের ছোড়া গুলিতে এলোমেলো হয়ে পড়ে মুক্তিসেনারা। একটি বোট উল্টে গেলে সবাই পানিতে পড়ে যান। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা নদীর অপর পাড়ে উঠে পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকেন। এ-যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর সুবিধা হলো, তারা সংখ্যায় ছিল বেশি আর তারা ছিল স্থলভাগে। অন্যদিকে মুক্তিসেনাদের অসুবিধা হলো, তাঁরা ছিলেন নদীতে ও নিম্নভাগে। তাছাড়া এখানে আসামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা এভাবে আক্রমণের শিকার হবেন তা ভাবেননি। এর মধ্যেও উভয় পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। প্রায় এক ঘণ্টার মতো গোলাগুলি চলে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা যে যার মতো করে পাহাড়ি পথ দিয়ে প্রাণ নিয়ে নিরাপদে সরে যান। কয়েকজনের অস্ত্র পানিতে তলিয়ে যায়।
এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ৬ জন শহীদ হন। তাঁদের ৫ জনের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন- সাখ্যাই অং (পিতা হ্ৰাসা থোয়াই, উজানী পাড়া, ৫ নং ওয়ার্ড, বান্দরবান পৌরসভা), উদয় সেন তঞ্চঙ্গ্যা (পিতা নগেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, গণেশপাড়া, বান্দরবান সদর), মো. ইদ্রিস (নোয়াখালী), শফি ও তাহের। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে রাজাকাররা অপপ্রচার করে যে, মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার আব্দুল ওহাবও যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা পরে সবাই ধোপাছড়িতে একত্রিত হন। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!