You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ক্ষেতলাল উপজেলা (জয়পুরহাট) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ক্ষেতলাল উপজেলা (জয়পুরহাট)

ক্ষেতলাল উপজেলা (জয়পুরহাট) উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন উপজেলা। বর্তমানে ৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে এটি গঠিত। জেলা সদর থেকে ১৪ কিমি দূরে অবস্থিত এ উপজেলার উত্তরে পাঁচবিবি উপজেলা, পূর্বে কালাই ও বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে আক্কেলপুর ও বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলা এবং পশ্চিমে জয়পুরহাট সদর উপজেলা। ৫২-র ভাষা- আন্দোলন এবং বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ক্ষেতলালের কিছু মানুষ জড়িত ছিলেন। স্বাধীনচেতা এ এলাকার দেশপ্রেমিক মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হন, কেউ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম লীগ- ও। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কতিপয় লোক এক পর্যায়ে তাদের নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন।
ক্ষেতলাল থানার মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিকভাবে দুটি স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নেন। প্রথমে ক্ষেতলাল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ১৫ জন এবং পরে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ৪০ জন যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ক্ষেতলালে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর রহিম তালুকদার (পিতা বাহারউদ্দিন তালুকদার, বানাইচ, আলমপুর)। সহকারী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন গোলাম সরোয়ার (পাচুইল) ও মোস্তাফিজুর রহমান মন্টু (সুজাপুর)।
২৭শে মার্চ পাকবাহিনী বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলা হয়ে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুরের ভেতর দিয়ে ক্ষেতলাল থানার বারইল এলাকায় প্রবেশ করে। সেখানে ক্ষেতলালের মুক্তিযোদ্ধারা সমন্তাহার গ্রামের মোহসিন আলী চৌধুরীর সহায়তায় সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে পাকহানাদার বাহিনী সেখান থেকে পিছু হটে।
২৮শে মার্চ পাকবাহিনী ক্ষেতলাল উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে তারা খোশবদন মাদ্রাসা এবং ডাকবাংলো মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকহানাদার বাহিনীর সমর্থনে ৮ই জুলাই কালাইসহ ক্ষেতলাল উপজেলায় ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান ছিল কালাই উপজেলার সাইদুর রহমান চৌধুরী (বেগুনগ্রাম; চেয়ারম্যান, জিন্দারপুর), জেনারেল সেক্রেটারি ছিল মুন্দাইল গ্রামের নুরুল ইসলাম চৌধুরী মংলা (চেয়ারম্যান, ক্ষেতলাল সদর ইউনিয়ন)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান সরদার, সহকারী সেক্রেটারি আব্দুল গফুর মণ্ডল, আব্দুল হাফিজ চৌধুরী, বজলার রহমান চৌধুরী (চেয়ারম্যান) প্রমুখ। শান্তি কমিটির সহায়তায় পরবর্তী সময়ে রাজাকার- বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের তৎপরতায় উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় লুটতরাজ ও নিরীহ লোকজনদের হত্যা করা হয়।
ক্ষেতলাল উপজেলায় অনুপ্রবেশের পর ২৮শে মার্চ পাকবাহিনী ক্ষেতলালের দিঘিপাড়া গ্রামের হলধর চন্দ্র দেবনাথ, গঙ্গাধর চন্দ্র দেবনাথ এবং নরেশ্বর চন্দ্র দেবনাথকে বর্তমান শিক্ষা অফিসের পাশে প্রাচীরের নিকট লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। মে মাসে তারা হাটশহর বড় পুকুর গণহত্যা সংঘটিত করে। গণহত্যায় অত্র এলাকার ফণিভূষণ চন্দ (পিতা ক্ষিতীশ চন্দ), প্রিয়নাথ চন্দ (পিতা ব্রজনাথ চন্দ), নিমাই চন্দ (পিতা নিতাই চন্দ), কার্তিক চন্দ (পিতা গোপাল চন্দ), প্রতাপ চন্দ (পিতা নগেন্দ্রনাথ চন্দ) প্রমুখ নিহত হয়। তাদের পাকবাহিনী গণমঙ্গল প্রাইমারি স্কুলের পাশে এবং হাটশহর বড় পুকুরের নিকট দুই লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারা বানদিঘি গ্রামের নবিরউদ্দিন, মাটিহাঁস গ্রামের নজের প্রামাণিক, আছের প্রামাণিক, ডাক্তার বুলচাঁদ ও তোফাজ্জল হোসেন তোফাকে আক্কেলপুর মহিলা কলেজের পাশে হত্যা করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা পাঠানপাড়া হিন্দু পল্লি, নওটিকা, ভূতপাড়া, সূর্যবান, বক্সীপাড়া, খলিশাগাড়ি, বানাইচ, আলিপুর, সমন্তাহার ও পৌলুঞ্জসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে।
ক্ষেতলালে পাকবাহিনীর ডাকবাংলো ক্যাম্প ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র এবং বন্দিশিবির। এখানে নির্যাতনের শিকার হন উপজেলার সূর্যবান গ্রামের শিক্ষক আজিজুর রহমান সরদার আওলাদ, ইটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, কানপাড়া গ্রামের আয়েজ উদ্দিনের পুত্র আফসার আলী প্রমুখ। পাকবাহিনী এঁদের ধরে এনে এখানে তিনদিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়।
ক্ষেতলাল উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও এখানে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বধ্যভূমি বা গণকবর চিহ্নিত করা হয়নি।
ক্ষেতলালে মার্চ মাসের শেষদিকে হিন্দা জিনার দিঘির পাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কমান্ডার আবদুর রহিম তালুকদার খোকা। যুদ্ধে এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। ১৪ই ডিসেম্বর ক্ষেতলাল উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ক্ষেতলালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন বিমান বাহিনীর সদস্য লুৎফর রহমান (পিতা সাহেব আলী, সমন্তার) এবং আফজাল হোসেন (পিতা আব্দুল জব্বার, মূলগ্রাম)।
ক্ষেতলালে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কোনো স্মৃতিসৌধ অথবা ভাস্কর্য নেই। তবে ক্ষেতলাল উপজেলার ভাসিলা চৌমুহনি থেকে ফুলদিঘি বাজার পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ নুরুজ্জামান সড়ক, ক্ষেতলাল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় গেট থেকে দিঘিপাড়া গ্রাম পর্যন্ত সড়কের নাম শহীদ হলধর চন্দ্র দেবনাথ-গঙ্গাধর চন্দ্র দেবনাথ-নরেশ্বর চন্দ্র দেবনাথ সড়ক, ক্ষেতলাল-আক্কেলপুর রাস্তার মৌসুমি থেকে সমন্তার গ্রাম পর্যন্ত সড়ক শহীদ লুৎফর রহমান সড়ক, থানা বাজার থেকে জালিয়া পাড়া হয়ে সরদার পাড়া গ্রাম পর্যন্ত অমরনাথ-খোকন নন্দী সড়ক এবং ইটাখোলা বাজার থেকে পশ্চিম দুর্গাপুর সড়কের নাম শহীদ আতাউর সড়ক নামে নামকরণ হরা হয়েছে। [আজিজার রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড