You dont have javascript enabled! Please enable it!

খড়রিয়া যুদ্ধ (কালিয়া, নড়াইল)

খড়রিয়া যুদ্ধ (কালিয়া, নড়াইল) সংঘটিত হয় দুবার ২রা আগস্ট ও ৮ই নভেম্বর। প্রথম যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল ইপিসিপি-র বিরুদ্ধে। উভয় যুদ্ধেই মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করেন। তবে প্রথম যুদ্ধে দুজন সাধারণ লোক শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কালিয়া থানা যশোর জেলার নড়াইল মহাকুমার অন্তর্গত ছিল। খড়রিয়া চিত্রা-নবগঙ্গা বিধৌত কালিয়া উপজেলার পেড়লি ইউনিয়নের একটি গ্রাম। ৯ই ডিসেম্বর কালিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসা পর্যন্ত এখানে অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। খড়রিয়ার যুদ্ধ সেসবের মধ্যে অন্যতম।
২৬শে মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যখন সারা দেশের মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন দেশরক্ষার জন্য কালিয়া থানার কলাবাড়িয়া গ্রামের নলিয়া নদী থেকে এক লঞ্চভর্তি মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইল ও যশোরের মাঝখানে তুলোরামপুর ব্রিজ ভাঙ্গার জন্য প্রস্তুতি নেয়, যাতে হানাদাররা নড়াইল ও কালিয়ায় গিয়ে হামলা করতে না পারে। কিন্তু নড়াইলের এসডিও কামাল সিদ্দিকীর হস্তক্ষেপে সেদিন ব্রিজ ভাঙ্গা হয়নি। উক্ত মুক্তিযোদ্ধারা অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে পরের দিন যশোর সেনানিবাস ঘেরাওয়ের জন্য ছুটে যান। যশোরের হামিদপুর, ঝুমঝুমপুর ও দাইতলা থেকে পাকবাহিনীর মোকাবেলায় তাঁরা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে যশোর শহর দখল করেন। পরে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ভারী অস্ত্র ব্যবহার ও নড়াইলে বিমান আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
খড়রিয়া গ্রামের শামসুর রহমান ওরফে শাম দারোগা পুলিশ বাহিনীর চাকরি শেষে বাড়িতে এলপিআর-এ ছিলেন। সারা দেশের মানুষের দুরবস্থা ও যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য গ্রামবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে এলাকার ছাত্রলীগ ও সাধারণ মানুষ যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য এগিয়ে আসে। মুসলিম লীগ- ও জামায়াতের সমর্থকরা হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করার পাঁয়তারা করলে তাঁর নেতৃত্বে গ্রামে পাহারা বসানো হয়। খড়রিয়ায় তখন ইপিসিপি বা পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পাটির তৎপরতা লক্ষ করা যায়। আওয়ামী লীগ-এর নেতা-কর্মীরা ভারতে গমন করলে ইপিসিপি-র লোকেরা কিছু লুটেরা ও সুদখোরকে খতম করে সাধারণ মানুষের কাছে যেতে সমর্থ হয়। এমতাবস্থায় শাম দারোগা তাঁর একটি সিভিলগান ও এলাকার ১৭ জন যুবককে নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন। প্রথম দিকে ইপিসিপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ শুরু করলেও এক পর্যায়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে শ্রেণিশত্রু খতমের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এভাবে খড়রিয়া একলাকায় ত্রিপক্ষীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটে— এক পক্ষ মুক্তিবাহিনী, দ্বিতীয় পক্ষ রাজাকার বাহিনী ও তৃতীয় পক্ষ ইপিসিপি-র গণবাহিনী। ইপিসিপি-র সদস্যরা এলাকায় নকশালপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিল।
২রা আগস্ট নড়াইলের রাজাকার বাহিনীর প্রধান কুখ্যাত সোলায়মান মওলানার ইন্ধনে গানবোটে একশত পাকসেনা ও রাজাকার খড়রিয়া বাজারে এসে নামে। তারা অনবরত গুলি ছুড়তে-ছুড়তে কমান্ডার শামসুর রহমানের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। এ সময় তারা রাস্তার দুপাশের বাড়িঘরগুলো পুড়িয়ে দেয়। হানাদারদের গোলাগুলির শব্দ শুনে হিদিয়াডাঙ্গায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দিকে গুলি করতে থাকে। এক পর্যায়ে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং হানাদাররা টিকতে না পেরে গানবোট নিয়ে নড়াইল শহরের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে খড়রিয়ার মহর মিয়া (পিতা নেয়াব আলি মিয়া) ও আবদুল হাকিম মিয়ার স্ত্রী শহীদ হন। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ হোসেন ৮ জন যোদ্ধা নিয়ে খড়রিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এসে যোগদান করেন। এ দলে আরো ছিলেন- অরুণ, সেকেন্দার, জলিল, সুশেন, নিমাই, অনীল ও আহমদ। এর ফলে ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা বেশ উজ্জীবিত হন। ইপিসিপি-র সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের ৩টি খণ্ডযুদ্ধ হয়। সবকটিতেই মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করেন।
কালিয়া মুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ অক্টোবর মাসের শেষদিকে খড়রিয়া ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা ইপিসিপি-মুক্ত করার পরিকল্পনা করেন তিনি কালিয়া থানা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প কলাবাড়িয়া থেকে ২১শে অক্টোবর পেড়লি যাত্রা করেন। তাঁর সহযোগী ছিল মুজিব বাহিনীর প্রধান সরদার আবদুল মজিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। ৮ই নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে খড়রিয়ার নিকট জামরিলডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ইপিসিপি-র প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ২৪ জন ইপিসিপি যোদ্ধা আত্মসমর্পণ করে। ফলে পেড়লি ইউনিয়ন (খড়রিয়াসহ) মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। সমগ্র এলাকা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ওমর ফারুখ, খড়রিয়া গ্রামের শওকাত হোসেন রানা, নড়াইলের আমির হোসেন, বাগডাঙ্গার নজির হোসেন, চন্দ্রপুরের জিনদার আলি, বড়নালের মোশাররফ হোসেন টুকু প্রমুখ পেড়লির এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। [মহসিন হোসাইন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!