বীর বিক্রম খন্দকার আজিজুল ইসলাম
খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রম (১৯৫১- ১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ডাকনাম ছিল বাবুল। তিনি ১৯৫১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতার কর্মস্থল জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার বানিয়ারা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম খন্দকার নুরুল ইসলাম এবং মাতার নাম সালেহা খাতুন। তিনি ১৯৬৬ সালে মির্জাপুরের জামুর্কী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৭১ সালে খন্দকার আজিজুল ইসলাম ঢাকা কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় -ছাত্রলীগ-এর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- থেকে শুরু করে ‘৭০-এর নির্বাচন, ‘৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন সহ সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করলে তিনি ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেরাদুন থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে দেশে এসে তিনি বিভিন্ন এম্বুশ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি পুনরায় ভারতে গিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ারফোর্সে যোগ দেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত বাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, মুজিবনগর সরকার-এর অধীনে প্রথম যে ৬১ জন কমিশনপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার যোগদান করেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খন্দকার আজিজুল ইসলাম কিছুকাল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী-র এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর তিনি বদলি হয়ে ২ নং সেক্টরের গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টরে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক-এর নেতৃত্বে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য চন্দ্রপুর-লাটুমুড়া যুদ্ধ। চন্দ্রপুর-লাটুমুড়া অঞ্চলটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হওয়ায় এর গুরুত্ব বিবেচনা করে পাকবাহিনী অক্টোবর মাসের ২২ তারিখ ২৭ ব্রিগেডের অধীনস্থ ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের এক কোম্পানি সৈন্য সেখানে মোতায়েন করে। এর ফলে সেখানে তাদের একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপিত হয়। অপরদিকে, কৌশলগত দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও এ এলাকাটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ভূখণ্ড থেকে এসে বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে অপারেশন পরিচালনা করার জন্য এ এলাকাটি দখলে রাখা তাঁদের জন্য ছিল অপরিহার্য।
১৮ই নভেম্বর সালদা নদী সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর <আব্দুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম, মেজর আইনউদ্দিন ও ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার তুলি বৈঠক করে চন্দ্রপুর-লাটুমুড়ায় অবস্থিত পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের তারিখ নির্ধারিত হয় ২২শে নভেম্বর। ঐদিন ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট হারুন ও লেফটেন্যান্ট আজিজুল ইসলামের নেতৃত্বে দুটি কোম্পানি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত হয়, ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনী সীমান্তের ওপার থেকে সাপোর্টিং ফায়ার করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজিজুল ইসলামের কোম্পানি এসল্ট লাইন অতিক্রম করার পরপরই ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনী গোলাবর্ষণ শুর করে। সঙ্গে-সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারাও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণ ও ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি গোলার এয়ারবার্স্ট স্প্রিন্টারের আঘাতে আজিজুল ইসলাম ও ভারতীয় বাহিনীর একজন শিখ মেজরসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহুসংখ্যক আহত হন। আজিজুল ইসলামের মৃতদেহ পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীপুর নামক স্থানে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার খন্দকার আজিজুল ইসলামকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৯৮, খেতাবের সনদ নং ২৩)। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাঁর নিজগ্রামে তাঁর নামে স্থাপন করা হয় ‘শহীদ বাবুল কিন্ডার গার্ডেন স্কুল’ এবং ঢাকা সেনানিবাসের অফিসারদের একটি আবাসিক এলাকার নামকরণ করা হয় ‘শহীদ আজিজ পল্লী’। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড