ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলাে, তা উঠে এসেছে এই রায়ে
একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার মােবারক হােসেনকে হত্যা, নির্যাতনের মতাে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর এই রায় ঘােষণা করেন। ৬৪ বছর বয়সী মােবারক একাত্তরে আখাউড়ার রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলাে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের তৈরি রাজাকারের তালিকায়ও তার নাম রয়েছে। একাত্তর পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করলেও পরে সে স্থানীয় আওয়ামী লীগে যােগ দেন। ২০১১ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। রায়ে বলা হয়, মােবারকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযােগের মধ্যে দুটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ১ নম্বর অভিযােগে আখাউড়ার। টানমাল্লাইল গ্রামের ৩৩ জনকে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৩ নম্বরে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতাকারী আব্দুল খালেককে অপহরণ করে হত্যার অভিযােগে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে মােবারক তার সহযােগী রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের মধ্য দিয়ে।
ভােল পাল্টে আওয়ামী লীগ : মাে. মােবারক হােসেন ওরফে মােবারক আলীর জন্ম ১৯৫০ সালের ১০ জানুয়ারি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল গ্রামে। তার বাবার নাম শাহাদত আলী, মা নজিবুর নেসা। ট্রাইব্যুনালের নথিপত্র অনুযায়ী, মােবারক লেখাপড়া করেছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত । পেশায় ব্যবসায়ী হলেও এলাকার মানুষ তাকে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল হিসাবেই চেনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলােতে মােবারক জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাে। তার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দু মন্দির ‘আনন্দময়ী কালীবাড়ি দখল করে রাজাকার মঞ্জিল’ নামকরণ করে এবং সেখানে বহু মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন চালায়। তার নেতৃত্বেই রাজাকার বাহিনী সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অপহরণ, লুটপাট, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধ ঘটায়। স্বাধীনতার বিরােধিতাকারী দল জামায়াত জিয়াউর রহমানের আমলে আবার রাজনীতি করার সুযােগ পেলে ইউনিয়ন জামায়াতের রুকনের দায়িত্ব পায় মােবারক। পরে সে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়ায় এবং এক পর্যায়ে আখাউড়ার মােগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়। ২০১১ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় ।
মামলার পূর্বাপর একাত্তরে মােবারক ও তার সহযােগীদের হাতে নিহত আব্দুল খালেকের মেয়ে খােদেজা বেগম ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিচারিক হাকিম আদালতে একটি মামলা করেন। ওই বছরের ১৩ মে মােবারক হাইকোর্ট থেকে ৬ মাসের আগাম জামিন নেয়। এরপর কয়েক দফা জামিনের মেয়াদ বাড়ানাে হয়। ২০১২ সালের ৬ জুন মােবারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলাটি ট্রাইব্যুনালে আসে। ওই বছরের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি। পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে তদন্ত চালায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মােবারকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযােগ দাখিল করা হয়। ১২ মার্চ অভিযােগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানাের নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২৩ এপ্রিল যুদ্ধাপরাধের পাঁচ ঘটনায় অভিযােগ গঠনের মধ্য দিয়ে মােবারকের বিচার শুরু হয়। ২০ মে মােবারক হােসেনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের মােট ১২ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। এরা হলেন- মুক্তিযােদ্ধা দারুল ইসলাম, শহীদ আব্দুল খালেকের মেয়ে খােদেজা বেগম ও ছেলে রফিকুল ইসলাম, মাে,খাদেম হােসেন খান, আলী আকবর, মাে.আব্দুল মালেক, মুক্তিযােদ্ধা ননী। গােপাল মল্লিক, আব্দুস সামাদ, শহীদজায়া ভানু বিবি, আব্দুল হামিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট চমন সিকান্দার জুলকারণাইন এবং তদন্ত কারী কর্মকর্তা শ্যামল চৌধুরী।