You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা (নোয়াখালী) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা (নোয়াখালী)

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা (নোয়াখালী) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আবদুল মালেক উকিল (মাইজদী), খাজা আহমেদ (ফেনী), নূরুল হক মিয়া (চৌমুহনী-১), এ বি এম তালেব আলী (সোনাগাজী) প্রমুখ নোয়াখালী অঞ্চলে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে আবদুল মালেক উকিল, খাজা আহমেদ ও নূরুল হক মিয়া জাতীয় পরিষদ এবং এ বি এম তালেব আলী প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে ছাত্রনেতাদের মধ্যে চৌমুহনীর মুস্তাফিজুর রহমান, মো. শাহজাহান, মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, ভিপি জয়নাল, জয়নাল হাজারী এবং কোম্পানীগঞ্জের আবু ছালেহ গোলাম মহিউদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, ওবায়দুল কাদের, খিজির হায়াত, মো. মোস্তফা, কেফায়েত উল্যাহ, আবু নাছের প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩রা মার্চের জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে ২রা মার্চ কোম্পানীগঞ্জের ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল বের করে। ঐদিনই কোম্পানীগঞ্জ থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন আবু নাছের চৌধুরী এমপিএ, আলী ইমাম চৌধুরী, মাস্টার আহছান উল্যা, নূরুল হুদা, আহছান উল্যা খান, এমদাদুল হক খান, জহুরুল হক, নূর মোহাম্মদ সওদাগর, ননী গোপাল গোস্বামী, মনির আহমেদ, মুজাফ্ফর মেকার (রামপুর), বেলায়েত হোসেন (চরপার্বতী), কামাল পাশা চৌধুরী (চরহাজারী), সিরাজ আলম (চর ফকিরা) সাইদুল আলম (শাহদাতপুর), বেচু ডাক্তার (রামপুর), সাফি উল্যা (বাতা সফি), অধ্যাপক মাইনুদ্দিন আহমেদ, আবদুল মালেক মিয়া, আবু সালেহ গোলাম মহিউদ্দিন প্রমুখ। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, খিজির হায়াত, তরুণ তপন চক্রবর্তী প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির কন্ট্রোল রুম ছিল কোম্পানীগঞ্জ সদরের বসুরহাট দক্ষিণ বাজার হাবিব ব্যাংকের পেছনে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার সার্কেল অফিসার আবুল কালাম লস্কর (বরিশাল) এবং হাবিব ব্যাংকের ম্যানেজার এ জেড এম সাদেকুর রহমান জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। বসুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন আবদুল খালেক। হাবিব ব্যাংকের ম্যানেজার ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরীর বন্দুকটি প্রশিক্ষণের জন্য প্রদান করেন। ২২শে মার্চ জেলা সদরের ছাত্রনেতা মমিন উল্যা বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা বসুরহাটে নিয়ে আসেন। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে বসুরহাটের দোকানপাট ও অফিস-আদালতে পাকিস্তানের পতাকার বদলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর পূর্বে ১৮ই মার্চ বসুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর নায়েক সুবেদার ওবায়দুল হক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এলাকার ছাত্র-যুবকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। ২৫শে মার্চের পর আবু নাছের চৌধুরী এমপিএ ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ আলী ইমাম চৌধুরী ভারতে যান এবং অত্র এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক (পরবর্তীতে থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার)-এর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-এর একটি দল প্রশিক্ষণের জন্য কানকিরহাট হয়ে মিয়ারবাজার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। সেখানে চোত্তাখোলা, উদয়পুর ক্যাম্প হয়ে আগরতলা ক্যাম্পে এবং পরে হাফলং, দেরাদুনসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে তাঁরা গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা -মুজিব বাহিনীর একটি দল নিয়ে কোম্পানীগঞ্জে প্রবেশ করে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গেরিলা যোদ্ধারা সেনবাগ, ছাগলনাইয়া, চৌমুহনী, মাইজদী ও কবিরহাট রাজাকার- ক্যাম্পে সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ সময় এলাকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন তাদের মধ্যে নূর মোহাম্মদ সওদাগর, সিরাজুল আলম, বংকবিহারী ভৌমিক, মুহাম্মদ ইউসুফ ও বজলুর রহমানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যে-সকল তরুণ মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যেতে পারেননি, তাঁরা দেশের ভেতরেই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শাহ আলম বিএসসি, মাস্টার আহছান উল্যাহ, আবু তাহের, এনামুল হক, আহছান উল্যাহ পাটোয়ারী, মাহফুজুর রহমান, সফিউল্যাহ, আমিন উল্যাহ, আবদুল হাই বাহার, গোলাম মাওলা, আবদুল মালেক, ইসমাইল, মনিরুল ইসলাম, আবুল খায়ের, আইয়ুব আলী, এমদাদুল হক, আবদুল হালিম, ডা. বেলায়েত হোসেন, আবু সালেহ গোলাম মহিউদ্দিন প্রমুখ এ প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেন। কোম্পানীগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আবদুর রাজ্জাক ও নূর নবীর নেতৃত্বে বিএলএফ এবং মোশাররেফ হোসেনের নেতৃত্বে এফএফ বাহিনী সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে ২নং সেক্টরের অন্তর্গত নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ ‘ডি’ জোনের আওতাভুক্ত ছিল। ‘ডি’ জোনের কমান্ডার ছিলেন রফিক উল্যাহ। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার যুদ্ধকালীন (বিএলএফ) কমান্ডার ছিলেন আবদুর রাজ্জাক (পিতা আবদুল মালেক), ওবায়দুল কাদের (আওয়ামী লীগ-এর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সরকারের সড়ক, পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী; পিতা মোশারেফ হোসেন) ও নূর নবী (পিতা আবদুল ছামাদ) এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন খিজির হায়াত (পিতা মজিবল হক), আবুল খায়ের (পিতা বদিয়াজ্জমান) ও বাহার মিয়া। সুধারাম ইউনিটের বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ডাকসুর সমাজকল্যাণ সম্পাদক অহিদুর রহমান অদুদ।
কোম্পানীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য সংগঠকরা হলেন- আবু ছায়েদ (পিতা মো. ইদ্রিছ মিয়া), কেফায়েত উল্যাহ (পিতা ছেলামত উল্যাহ), অমিয় ভূষণ দাস (পিতা নকুল চন্দ্ৰ দাস), তরুণ তপন চক্রবর্তী (পিতা হরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী), শহীদ উল্লাহ, (পিতা নূর মো. সওদাগর), মিজানুর রহমান (পিতা ছাদেক মিয়া), মো. আহছান উল্যা (পিতা মুজাফফর আহমেদ), হামিদুল হক (পিতা শামছুল হক), আলি আহম্মদ (পিতা এয়ার আলী), আজিজুল হক (পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল) প্রমুখ।
মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী কোম্পানীগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে। এখানে তারা কোনো স্থায়ী ক্যাম্প করেনি। থানা ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে পাকবাহিনীর একটি দল যুক্ত হয়ে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করত।
জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ এর উদ্যোগে ১৭ই এপ্রিল কোম্পানীগঞ্জ থানা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ২৫শে এপ্রিল রাজাকার বাহিনী কোম্পানীগঞ্জ থানা ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরদিনই তারা বাজারের সংখ্যালঘুদের দোকানপাটসহ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দোকানপাট লুট করে এবং গনিমতের মাল জায়েজ বলে প্রচার করে। একই দিন তারা বাজার থেকে হাসপাতালের দক্ষিণ বাড়ির দেলওয়ার হোসেন, মাবুল হক ও নির্মল মাস্টারসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং পরে তাদের গুলি করে হত্যা করে। কোম্পানীগঞ্জে রাজাকাররা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। এখানকার প্রশাসন ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। কোম্পানীগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার ছিল এফরান মিয়া (সিরাজপুর ইউনিয়ান, পরবর্তীতে মুজিব বাহিনীর হাতে নিহত)।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- অধ্যাপক গোলাম ছারওয়ার (সিরাজপুর ইউনিয়ন, জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা; বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী), মাওলানা আবদুর রহিম (মুছাপুর ইউনিয়ন, জামায়াত নেতা; লন্ডন প্রবাসী), মাওলানা আবদুল আউয়াল (চরকাঁকরা ইউনিয়ন, জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা; লন্ডন প্রবাসী), আ না ম আবদুস জাহের (চরকাঁকড়া ইউনিয়ন, জামায়াত সমর্থিত পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি; ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান; মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতার এড়াতে দেশত্যাগ ও লন্ডন প্রবাসী), নেজাম উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী (সিরাজপুর; লন্ডন প্রবাসী) এবং ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রাজ্জাক (চরফকিরা ইউনিয়ন, জামায়াতের সক্রিয় সদস্য)।
পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় কৈলাস কর্মকার, নির্মল কুমার সূত্রধর, রায় মোহন (ইব্রাহিমপুর), মাহবুবুল হক মিয়া (রামদী), দেলু মিয়া ও আবুল বাসার একরামকে (চরহাজারী) নির্যাতন করে হত্যা করে। বসুরহাট পৌরসভার পাশে হরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তীর বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করে এবং তার পুত্রবধূ, কন্যা ও স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালায়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে বসুরহাট হাইস্কুলের ৫ জন ছাত্র এবং চরকাঁকড়া গ্রামের ২ জন গ্রামবাসী প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাওয়ার সময় জমিদারহাটে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে রাজাকাররা তাদের হত্যা করে। এটি জমিদারহাট গণহত্যা নামে পরিচিত ২৮শে জুলাই অপরাহ্ণে ছাত্রনেতা আবু সালেহ গোলাম মহিউদ্দিনকে গ্রেফতার করতে গিয়ে রাজাকাররা মেরীন একাডেমির ক্যাডেট আজাদকে হত্যা করে। এর কয়েকদিন পর ডা. নগেন্দ্র কর্মকারের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পিতা ৮৫ বছর বয়স্ক কৈলাশ কর্মকারকে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে তারা ডা. নগেন্দ্র কর্মকারের স্ত্রীকেও হত্যা করে। রাজাকাররা চরকাঁকড়ার নজিরসহ আরো কয়েকজনকে হত্যা করে। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের ধর্ষণ করে। রাজাকাররা জুগিদিয়ার রীণা চক্রবর্তীকে বাড়ি থেকে ধরে এনে চৌমুহনী পাকসেনাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়।
কোম্পানীগঞ্জ থানা ভবনে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এছাড়া বামনীতে সাবেক থানা ভবন ও চাপরাশিরহাট রাজাকার ক্যাম্পেও তারা লোকজন ধরে এনে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত।
রাজাকাররা কোম্পানীগঞ্জ থানাকে তাদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। ভোরবেলা অর্ধমৃত ও মৃত মানুষদের থানার সামনে শংকরবংশী খালে ফেলে দিত। শংকরবংশী খালে বহু মুক্তিযোদ্ধার লাশ পচে যায়। ১৬নং সুইজ গেইটে বেড়ী বাঁধের ওপর একটি গণকবর রয়েছে, যা কোম্পানীগঞ্জ বেড়িবাঁধ গণকবর হিসেবে পরিচিত।
১৩ই আগস্ট গভীর রাতে হানাদারদের পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি পণ্ড করার জন্য সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা থানা ভবনের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। থেমে-থেমে প্রায় একঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর ৬০-৭০ জন নিহত হয়। অপরদিকে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ২ জন আহত হন। এটি কোম্পানীগঞ্জ থানা ভবন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন নামে পরিচিত।
৪ঠা সেপ্টেম্বর পেশকার হাটের দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ১৬নং সুইস গেইটের নিকট মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এটি কোম্পানীগঞ্জ বেড়িবাঁধ সুইস গেইট যুদ্ধ – নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ছালেহ আহমদ মজুমদার (চৌমুহনী), আবদুর রব বাবু (সোনাপুর), আক্তারউজ্জামান লাতু (চৌমুহনী), ফারুক (বেগমগঞ্জ), ইসমাইল (বসুরহাট) ও মোস্তফা কামাল ভুলু (বামনী) শহীদ এবং আবু নাসের আহত হন।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিবাহিনী চাপরাশির হাট পূর্ববাজারে কৃষিবীজ গুদামে রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে রাজাকাররা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং তারা পালিয়ে বামনী রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। এটি চাপরাশির হাট রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন নামে পরিচিত। ১৩ই নভেম্বর মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বামনী তাল মোহাম্মদ হাট রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন – পরিচালনা করেন। এ অপারেশনে ১০-১২ জন পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সুধারাম ইউনিটের কমান্ডার অহিদুর রহমান অদুদ শহীদ হন। এটি বামনী রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন হিসেবে পরিচিত। সুধারাম থানার করমবক্স ও কবিরহাটের মাঝামাঝি স্থানে রাজাকারদের অতর্কিত আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক উল্যাহ শহীদ হন।
৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বসুরহাট বাজার চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে থানা আক্রমণের উদ্যোগ নেন। এ খবর থানায় পৌঁছলে ওসি হান্নানসহ রাজাকাররা আত্মসর্পণের প্রস্তাব দেয়। এ-সময় ডেপুটি কমান্ডার খিজির হায়াতের মাধ্যমে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকের কমান্ডার আবদুর রাজ্জাকের নিকট আত্মসমর্পণ করে। পাকবাহিনী এর আগেই বসুরহাট থেকে পালিয়ে যায়। পরদিন ৭ই ডিসেম্বর যুদ্ধের কমান্ডার ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কোম্পানীগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূরুল হক, বীর উত্তম (পিতা আব্দুল কাদের, সিরাজপুর), আবুল হাসেম, বীর প্রতীক (পিতা আলী আজম, চরফকিরা), আব্দুল মান্নান, বীর প্রতীক (পিতা মো. সফি উল্লাহ, মোহাম্মদনগর)।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নূরুল হক, বীর উত্তম (২৮শে নভেম্বর সিলেটের রাধানগর যুদ্ধে শহীদ), সিরাজপুর ইউনিয়নের মো. ইসমাইল (পিতা মো. বাচ্চু মিয়া) ও মজিবল হক (পিতা আবদুল কাদের), চরপার্বতীপুর ইউনিয়নের এরফান মিয়া (পিতা ইব্রাহিম খলিল), তোফাইল আহম্মদ (পিতা আবদুল জব্বার), আবদুল মুনাফ (পিতা সোনা মিয়া), মনির আহম্মদ (পিতা নজির আহম্মদ), চরহাজারী ইউনিয়নের মহিব উল্যাহ (পিতা সফিউল্যাহ), মো. হানিফ (পিতা আলী আকবর), রুহুল আমিন (পিতা সেরাজুল হক ছুকানী), সিদ্দিক উল্যাহ (পিতা আবুল কালাম), ফকির আহম্মদ (পিতা মোবারক আলী), আবদুল খালেক (পিতা আবদুল জব্বার) ও এলাহি বক্স (পিতা দরবেশ আলী), চরফকিরা ইউনিয়নের ওবায়দুল হক (পিতা ফজলের রহমান), আলী আজ্জম (পিতা আলী আহমেদ), মো. ইউসুফ (পিতা আহম্মদ), গোলাম মাওলা (পিতা আবদুর রশিদ), রামপুর ইউনিয়নের মিজানুর রহমান (পিতা আবদুল মালেক), নুর আলম (পিতা ওমর আলী), মো. হানিফ (পিতা মোজাফফর আহম্মদ) ও অহিদুর রহমান ওদুদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা)।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ২০০৮ সালে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সামনে একটি স্মৃতিভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। লায়ন শেখ মহিউদ্দিনের উদ্যোগে চরফকিরার ১৬ নং সুইজ গেইটে বেড়িবাঁধের ওপর বাজারে (বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাবাজার) শহীদদের গণকবরকে চিহ্নিত করে পাকা করা হয়। পরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে তা পুনর্নির্মাণ করা হয় (যেখানে এখন প্রতিবছর ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এবং ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুষ্পমাল্য ও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়)। চৌমুহনী কলেজের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ সালেহ আহম্মদ মজুমদার কলেজ। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে চাপরাশির হাট ব্রিজের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আবদুর রহমান ব্রিজ। মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক উল্ল্যাহর স্মৃতি রক্ষার্থে এলাকাবাসী চরকাঁকড়ার একটি বাজারের নামকরণ করেছে সিদ্দিকবাজার। কোম্পানীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ভুলুর নামে নোয়াখালী জেলা ফুটবল স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে ভুলু স্টেডিয়াম। [মোহাম্মদ মকছুদের রহমান মানিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড