মুক্তিযুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা (সিলেট)
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা (সিলেট) ১৯৭৬ সালে থানার মর্যাদা পায় এবং ১৯৮৩ সালের ২রা জুলাই উপজেলায় উন্নীত হয়। উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ নদীবেষ্টিত এবং অপরাংশ হাওর-বাওর অধ্যুষিত। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি ছিল একটি দুর্গম এলাকা। বর্তমানে এলাকাটি ভোলাগঞ্জ- সিলেট সড়কের মাধ্যমে জেলা সদরের সঙ্গে যুক্ত।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণে সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট ও ছাতক উপজেলা, পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলা এবং পশ্চিমে ছাতক উপজেলা। এ তিন উপজেলার অংশ নিয়ে উপজেলাটি গঠিত। তাই এ তিন উপজেলার সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাব এ উপজেলায়ও পড়ে এবং তারই ধারাবাহিকতায় উপজেলার জনগণ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোনো ক্যাম্প ছিল না। ভারতের একেবারে সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা মেঘালয়সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রধানত দেওয়ান ফরিদ গাজী – এমএনএ-র নেতৃত্বে সিলেট অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এম এ হান্নান, ইব্রাহীম মিয়া (বর্তমানে গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি) প্রমুখ। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সাত শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
পাকবাহিনীর মূল ক্যাম্প ছিল সিলেট এয়ারপোর্টের নিকটস্থ সালুটিকরে। সেখান থেকে এসে তারা এপ্রিল মাসের প্ৰথম সপ্তাহে গোয়াইনঘাটের কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাব-ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পদুটিতে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ-এর সদস্যরা পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করত।
কোম্পানীগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলায় পাকবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় সহযোগী ছিল জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মো. নুরুজ্জামান (সিন্দ্রেরগাঁও, সালুটিকর বাজার, গোয়াইনঘাট)। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে এলাকার বাইরে অবস্থান করলেও এলাকায় তার প্রভাব ছিল। তার প্রভাবে যেসব দালাল ও রাজাকার- এলাকায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তারা হলো— মো. টুনু মিয়া (নোয়াগাঁও), রাজাকার কমান্ডার আব্দুল হাই মৌলভি (দলইরগাঁও, খাগাইল বাজার, কোম্পানীগঞ্জ), নুরুল ইসলাম (বর্ণি,) প্রমুখ। এদের সহায়তায় পাকবাহিনী কোম্পানীগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী সকল প্রকার কর্মকাণ্ড চালায়। পাকবাহিনী ও তাদের এ দোসরদের হাতে মো. রুস্তম আলী (ফুড়ারপাড়, নিজ বাড়িসংলগ্ন ফুড়ারখাল এলাকায় নিহত), একরাম আলী (পূর্ণাছগাম; খাগাইল বাজারে আহত হন, পরবর্তীতে নিজবাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন), তহশীলদার ইয়াহিয়া (পূর্ণাছগাম, সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সিরামিসিতে শহীদ), মুক্ত মিয়া (টুকের বাজার, কোম্পানীগঞ্জ), বিলাজুড় বাজার (চাতলপাড়)-এ ৫-৬ জন এবং ডেওয়ার খালসংলগ্ন ল্যাংড়াপাড়ে তিনজন জন নিহত হয়। উপজেলায় দুটি গণহত্যা সংঘটিত হয় – গৌরীনগর গণহত্যা – ও গৌখালের পাড় গণহত্যা। গৌড়নগর গণহত্যায় ৯ জন এবং গৌখালের পাড় গণহত্যায় ৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হন।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বিলাজুড়ে একাধিক বাড়িসহ ধানক্ষেতে ব্যবহৃত পাওয়ার পাম্প ও তার যন্ত্রপাতি এবং কোম্পানীগঞ্জ গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াব আলীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা টুকের বাজারে একটি দোকান ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি বাড়ি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। কোম্পানীগঞ্জ গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মজর আলী ওরফে ভালাই মিয়াকে রাজাকার আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে শিবের বাজার থেকে ধরে এনে উমাইরগাঁও সাব-ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যসহ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সহযোগিতাকারী স্থানীয় আরো অনেককে তারা নির্যাতন করে।
পাকসেনাদের গৌরীনগর ক্যাম্পে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে নারীদের ধরে এনে ধর্ষণ করা হতো। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পার্শ্ববর্তী টুকের বাজার এলাকা থেকে অনেক নারীকে ধরে এনে শিলেরভাঙ্গা গ্রামের পার্শ্ববর্তী নালীক্ষেতে ধর্ষণ করা হয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় তেলিখাল ক্যাম্পে অবস্থানরত হানাদাররা এসব মানবতাবিরোধী কাজ করে।
তেলিখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছিল ৫নং সেক্টরের অধীন ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সে-সবের মধ্যে একটি হলো বিলাজুর- বর্ণি-গৌরীনগর-দলইরগাঁও যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে ইসহাক আলীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পীযূষ কান্তি সরকার ওরফে পি কে সরকার (কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাইরের) হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাঁকে পার্শ্ববর্তী গৌরীনগর ক্যাম্পে নিয়ে ২-৩ দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এভাবে কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যুদ্ধে ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, যাঁদের দুজন কোম্পানীগঞ্জের এবং অন্যরা এ উপজেলার বাইরের। শহীদদের মধ্যে একজন ব্যতীত অন্যদের লাশ স্থানীয় টুকের বাজার সংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। ১৫ই ডিসেম্বর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন: ইসহাক আলী (পিতা আমজাদ আলী, দলইরগাঁও; নিজবাড়িতে সমাহিত), ফিরোজ মিয়া (চরারবন্দ, সুনামগঞ্জ), তেরা মিয়া (পিতা আ. জলিল, দলইরগাঁও, কোম্পানীগঞ্জ), আব্দুল হামিদ ফেলন (পিতা মজিদ উল্লাহ, কোম্পানীগঞ্জ), সাজিদ আলী (মিত্রিমহল, গোয়াইনঘাট), মুস্তফা তালুকদার (কিশোরগঞ্জ), একরাম আলী (কস-কনকপুর, জকিগঞ্জ), জুলহাস মিয়া (বাউরবাগ, গোয়াইনঘাট), ফজল হক (বাউরবাগ, গোয়াইনঘাট), সিদ্দেক মিয়া (ভিত্রিখেল, গোয়াইনঘাট), মো. আব্দুস ছোবহান (লাকী, গোয়াইনঘাট), ফরমান আলী (ইসলামাবাদ, সিলেট সদর), আমছের আলী (আসামপাড়া, গোয়াইনঘাট), রবি মিয়া (বাউরবাগ, গোয়াইনঘাট), দেলুয়ার হোসেন (নলজুরী, সুনামগঞ্জ), পীযূষ কান্তি সরকার ওরফে পি কে সরকার (সুনামগঞ্জ)। প্রথমজন ব্যতীত অন্যদের টুকের বাজার সংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়।
কোম্পানীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলা সদরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং টুকেরবাজারে সমাহিত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া টুকের বাজারে ‘শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [মো. সালাউদ্দিন বেলাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড