You dont have javascript enabled! Please enable it!

কোলাহাট যুদ্ধ (বদলগাছী, নওগাঁ)

কোলাহাট যুদ্ধ (বদলগাছী, নওগাঁ) নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার কোলাহাট ইউনিয়নের কোলাভাণ্ডারপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক যুদ্ধ হয়। সেসব যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী শহীদ হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর কোলা এলাকায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কোলা গ্রামের বিজলী সংঘকে সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্র করা হয়। কোলা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ২৩শে মার্চ নূরুল ইসলাম দুলু, আবু বকর সিদ্দিক, অধ্যাপক আব্দুস সামাদ, হাবিলদার কফিল উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান ও স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। কোলা এলাকায় সংগ্রাম পরিষদকে সহযোগিতা করেন এডভোকেট বায়তুল্লাহ (স্বাধীনতার পরে ডেপুটি স্পিকার), আতোয়ার রহমান তালুকদার ও মুক্তিযুদ্ধে উত্তর বঙ্গের অন্যতম প্রধান সংগঠক আব্দুল জলিল ৷ মূলত এঁদের উৎসাহ, সমর্থন ও নেতৃত্বে কোলা এলাকা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে যারা শরণার্থী হিসেবে এদিক দিয়ে ভারতে যাচ্ছিলেন, তাদের বিশ্রাম ও আহারের ব্যবস্থা করে।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে কোলা এলাকার ভোলারপালশা গ্রামের ডা. আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কাদেরের সহায়তায় গঠিত রাজাকার বাহিনী ও পাকসেনারা কোলা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রাজাকাররা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের তালিকা তৈরি করে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক, মকলেছুর রহমান, আব্দুল আজিজ, মুনসুর, এমদাদুল এবং আত্রাই ও রাণীনগর এলাকার কিছু মুক্তিযোদ্ধা কোলা এলাকায় অবস্থান নেন। ৮ই নভেম্বর পাকসেনারা রাজাকারদের সহায়তায় ১০টি গাড়ির বহর নিয়ে নওগাঁ থেকে কোলার উদ্দেশে রওনা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আক্কেলপুর- বদলগাছী সড়কের বিষ্ণুপুর নামক স্থানে এম্বুশ করেন। দুপুরের আগে পাকবাহিনী এ স্থানে পৌঁছামাত্র সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৫-৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা মকলেছুর রহমান পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়লে তাঁকে আক্কেলপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ-যুদ্ধের পর শত্রুসেনাদের কাছে কোলা এলাকা মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত হয়।
নভেম্বরের শেষদিকে পাকসেনারা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর উদ্দেশ্যে কোলার দিকে রওনা হয়। এ খবর পেয়ে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কোলা ও পুখুরিয়া অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে ভাণ্ডারপুর বাজারের দক্ষিণে কামাড়পাড়া নামক স্থানে এম্বুশ করেন। বেলা ১১টায় পাকসেনারা কোলায় আসার পর দুপক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। ভারী অস্ত্রের গুলির আওয়াজে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ-যুদ্ধে ৮-১০ পাকিস্তানি সৈন্য প্রাণ হারায়। মৃতদের লাশ নিয়ে অন্য পাকসেনারা পিছু হটে। অপরপক্ষে রাণীনগর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মোকছেদ আলী, ইসাহাক আলী, ফরমান আলী ও আজাহার আলী শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হন হাবিলদার কফিল উদ্দিন। শহীদ ৪ মুক্তিযোদ্ধাকে আক্কেলপুর গ্রামের ডা. মুনসুর আলীর বাড়ির পার্শ্বে সমাধিস্থ করা হয়। এ রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ১৮-২০ জনের একটি দল পুখুরিয়া গ্রামে অবস্থান নেয়। তাঁদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হাবিলদার কফিল উদ্দিনকে হুদড়া কুড়িগ্রামের দীঘিরপাড় নামক স্থানের আখক্ষেত থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। পরদিন সকালে পুনরায় পাকসেনা ও রাজাকাররা এ এলাকা ঘিরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধরপাকড় শুরু করে। কোলাহাট হাইস্কুলে তারা ক্যাম্প করে অবস্থান নেয়। এরপর তারা এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। প্রায় ৭ দিন ধরে মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানোর পর তারা এলাকা ত্যাগ করে। যাওয়ার পূর্বে ক্যাম্পে আটক ১১ জন লোককে তারা জবাই করে হত্যা করে। ক্যাম্পে ধরে আনা কয়েকজন নারী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। কোলা এলাকার যুদ্ধে কিনার উদ্দিন মণ্ডল, আজিম উদ্দিন, আমজাদ হোসেন মণ্ডল, গোলাম সাকলায়েন, আমিরুল ইসলাম, আব্দুল কাশেম, মোজাহার আলী, কমলা ফকির প্রমুখ শহীদ হন।
এ এলাকার রাজাকার আব্দুল হাকিম ছদ্মবেশে পালিয়ে যাবার সময় সাগরপুর গ্রামে ধরা পড়ে। নাকে বড়শি লাগিয়ে ও গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে তাকে এলাকা ঘুরানো হয় এবং পরে সে নিহত হয়। কয়া ভবানীপুরের রাজাকার ইব্রাহীম আলী মাস্টারকেও নাকে বড়শি লাগিয়ে এলাকায় ঘুরানো হয়। পাকিস্তানিদের আরেক দোসর দয়েব মৌলভী (মাদ্রাসা শিক্ষক) পাকবাহিনীকে সহায়তার অপরাধে অভিযুক্ত হয়। বিচারে তার একটি কান কর্তন করা হয়। কোলা এলাকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে নূরুল ইসলাম (দুলু) ও হাবিলদার কফিল উদ্দিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি গ্রামকে আদর্শ গ্রাম ঘোষণা করেন। নওগাঁ জেলার কোলা আদর্শ গ্রামের মর্যাদা পায়। এ গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি বাড়িতে একটি করে পাকাঘর নির্মাণ করা হয়। তবে কোলায় এখনো কোনো স্মৃতিফলক, স্মৃতিস্তম্ভ বা নামফলক স্থাপিত হয়নি। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!