মুক্তিযুদ্ধে কোটচাঁদপুর উপজেলা (ঝিনাইদহ)
কোটচাঁদপুর উপজেলা (ঝিনাইদহ) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বতর্মান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। পরের দিন ৮ই মার্চ সেই ভাষণ শুনে কোটচাঁদপুর শহরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। ২২শে মার্চ কোটচাদপুর শহরে প্রায় চার হাজার লোকের এক মিছিল বের হয়। এর তিনদিন পর ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর সেই ঘোষণার কথা জানতে পেরে সারা দেশের মতো কোটচাঁদপুরের মানুষও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
২৬শে মার্চের পর সাবদালপুর বাজার সংলগ্ন ফুটবল মাঠে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার সুজাউদ্দিন। প্রায় দুশ জনতা ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে। প্রশিক্ষণ চলে প্রায় ২০ দিন। এরপর তাদের অনেকেই ভারতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাঝদিয়া, বানপুর, রানাঘাট, বনগাঁ, টালিখোলা, বেতাই, কল্যাণী এবং বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন মো. গোলাম মোস্তফা, মো. তাজুল ইসলাম, মো. সাবদার হোসেন, আব্দুর রহমান (সুন্দর), শেখ মো. নুরুল ইসলাম, আবুল হোসেন, মো. মফিদুল ইসলাম প্রমুখ। এছাড়া মুজিব বাহিনীর কয়েকজন সদস্যও ছিলেন। তাঁরা ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুনেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কোটচাঁদপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়রা হলেন- ময়েন উদ্দিন মাস্টার, আবদুল আজিজ, জমির উদ্দিন, মোহাম্মাদ আলী, আবদুর রশিদ, জেমস দীপক বৈদ্য (দীপু), মো. তাজুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, মো. মফিদুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, মো. গোলাম সরোয়ার, শেখ আবদুল জলিল, মো. আমির হোসেন পাঠান, সুজাউদ্দিন হাবিলদার প্রমুখ। থানা কমান্ডার ছিলেন শেখ মো. জামাল উদ্দিন এবং বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন গোলাম মোস্তফা।
যুদ্ধ চলাকালে কোটচাঁদপুর উপজেলা ছিল ৮নং সেক্টরের বানপুর সাবসেক্টরের অধীন। প্রথমে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরে ১৮ই আগস্ট মেজর মঞ্জুর এই সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বানপুর সাবসেক্টর কমান্ডার হন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।
কোটচাদপুর উপজেলায় পাকবাহিনী ২৩শে এপ্রিল প্রবেশ করে। তবে এখানে তারা কোনো স্থায়ী ক্যাম্প করেনি।
কোটচাঁদপুর পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কোটচাদপুর থানা ও পশু হাসপাতালে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে তারা অস্থায়ীভাবে অবস্থান করত এবং মহেশপুর থানা হাসপাতাল ক্যাম্প থেকে অভিযান পরিচালনা করত।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- ডা. সিরাজুল ইসলাম (আলামপুর, মহেশপুর), মো. মকবুল হাজী (সলেমানপুর, কোটচাঁদপুর পৌরসভা), মো. নবীর চৌধুরী (কোটচাঁদপুর পৌরসভা), খন্দকার কওছার আলী (কোটচাঁদপুর পৌরসভা), মো. মান্নান মিয়া (কোটচাঁদপুর পৌরসভা), হাবিলদার আবদুল খালেক (চৌগাছা পৌরসভা) প্রমুখ।
এদের নেতৃত্বে জুন-জুলাই মাসে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং এই দুই বাহিনীর সদস্যরা পাকবাহিনীকে সর্বপ্রকারে সহায়তা করে। রাজাকাররা কোটচাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, থানা, মো. কোটচাঁদপুর পশু হাসপাতাল, খাদ্য গুদাম ও সাবদালপুর রেলস্টেশনে ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের কার্যক্রম চালায়।
কোটচাঁদপুর উপজেলায় পাকবাহিনী এবং তাদের সহযোগী লন শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা জুলাই মাসের দিকে তৎপরতা শুরু করে। তারা গ্রামে-গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্য ও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ও তাদের বাড়িঘর লুট করে। তারা সলেমানপুর গ্রামের রাম শংকর শর্মা, নরেন্দ্র নাথ সাহা, বীরেন্দ্র নাথ সাহা, ফকির চন্দ্র সাহা, সুনীল শর্মা, রামপদ রায়, ফুলবাড়ি গ্রামের ফকির চন্দ্র দাস, ভদু দাস, মল্লিক দাস, কৃষ্ট চন্দ্র দাস, হাজারী দাস, আকালে দাস, বুদোই দাস, অঙ্গধর দাস, তালসার গ্রামের মো. আমির হোসেন পাঠান, ঘাগা গ্রামের ইমান আলী ন। বিশ্বাস, বলুহর গ্রামের সতীশ গড়াই এবং সাবদালপুর গ্রামের শেখ মো. আ. জলিলের বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দেয়। এমনকি কোটচাঁদপুর কালীমন্দির, সলেমানপুর শিবমন্দির, সলেমানপুর জগন্নাথ দেবের মন্দির ও রথ, কুমারেশ দত্তের বাড়ির শিবমন্দিরসহ অন্যান্য মন্দির ধ্বংস করে দেয়। তাদের এই অত্যাচার চলে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পাকবাহিনী ২৩শে এপ্রিল কোটচাঁদপুরে প্রবেশ করে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এদিন তারা মো. কওছার আলী, রবি সাহা, ফকির চন্দ্র সাহা, নির্মল শর্মা, নারান বিশ্বাস, সন্তোষ মালো, ষষ্ঠী অধিকারী, কৃষ্ট দত্ত, আবুল মণ্ডল, ইছাহাক আলী, পাগলা বাদল দাস, জামাত আলী প্রমুখকে হত্যা করে। ৪ঠা মে তাদের দোসররা তালসার ও ঘাগা গ্রামে আশু কর্মকার, হারু কুরি, কাটিরাম দাস, পঞ্চানন দাস, বুদ্ধিস্বর ঘোষ, মথুরেশ দাস, ভদু ঘোষ এবং ১৪ই মে ফুলবাড়ি গ্রামে অন্ন দাস, অঙ্গধর দাস, ভদু দাস, কিরন দাস ও সাবদালপুর গ্রামে আব্দার মণ্ডল ও বুদ্ধেশ্বর পালকে হত্যা করে। এছাড়া বলুহর, শিবনগর, সোয়াদী, শ্রীরামপুর ও ছয়খাদা গ্রামেও তারা হত্যাকাণ্ড চালায়।
পাকবাহিনী কোটচাঁদপুর পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কোটচাঁদপুর থানা ও সাবদালপুর রাজাকার ক্যাম্প নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোটচাঁদপুর উপজেলার সাবদালপুর বাজারের ডা. নুরুজ্জামানের বাড়ির কূপের মধ্যে অনেককে কবর দেয়া হয়। বর্তমানে এ বাড়িতে কেউ বসবাস করে না, তবে কূপটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিরাজমান। এছাড়া ফুলবাড়ি গ্রামের দাস পাড়ায় একটি গর্তের মধ্যে অন্ন দাস, অঙ্গধর দাস, ভদু দাস ও কিরণ দাস নামে ৪ জনকে কবর দেয়া হয়। কোটচাঁদপুর উপজেলায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবদালপুর যুদ্ধ, কোটচাঁদপুর ফুড গোডাউন যুদ্ধ বড়বামনদহ গ্রাম অপারেশন, সোয়াদীর যুদ্ধ ও শেরখালির যুদ্ধ। সাবদালপুর যুদ্ধ হয় দুই দফায়। জুলাই মাসে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধে ৫ জন রাজাকার বন্দি ও কিছু অস্ত্র উদ্ধার হয়। ৫ই নভেম্বর দ্বিতীয় যুদ্ধে ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ১ জন আহত হন। কোটচাঁদপুর ফুড গোডাউন যুদ্ধ হয় আগস্ট মাসে। গোডাউনটি রাজাকাররা ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত। এটি দখল করার জন্য ১৮-১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ করেন। রাজাকারদের সঙ্গে তাঁদের প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে কোনো পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
তবে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। বড়বামনদহ গ্রাম অপারেশন চলে ১৭ থেকে ২৩শে অক্টোবর পর্যন্ত। এতে দুটি টেলিফোন পোল ধ্বংস এবং একাধিক স্থানে রেললাইন তুলে ফেলা হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় <মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সংঘটিত ৭২ ঘণ্টাব্যাপী সোয়াদীর যুদ্ধে উভয় পক্ষে ব্যাপক হতাহত হয় এবং পাকবাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। শেরখালির যুদ্ধ হয় ঐ একই দিনে। সোয়াদীর যুদ্ধে পরাজিত পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন সৈন্য শেরখালির মাঠে ঢুকে পড়ে। এ-কথা জানতে পেরে গ্রামবাসীদের সহায়তায় মো. ফজলুর রহমান, মো. আবদুল খালেক, মো. জবেদ আলী, মো. আনসার উদ্দিন, জেমস দীপক বৈদ্য প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা তাদের আক্রমণ করেন। এ-যুদ্ধে তিনজন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের মিত্রবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। এছাড়া কোটচাঁদপুরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের তৎপরতা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা আনসারবাড়িয়া-সাবদালপুর রেল স্টেশন (১৩ই জুন) ও কালীগঞ্জ-কোটচাঁদপুর সড়কে মাইন বিস্ফোরণ (২৮শে জুন), ঘাগা গ্রাম (২রা জুলাই) ও সাবদালপুর রাজাকার ক্যাম্প রেইড (২রা অক্টোবর), সাবদালপুর ট্রেন ধ্বংস (১৩ই অক্টোবর), সাবদালপুর- আনসারবাড়িয়ায় ট্রেনে হামলা (২৫শে অক্টোবর), কালীগঞ্জ-কাশিপুর টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্নকরণ (২রা নভেম্বর) ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এতে অর্ধশতাধিক পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন রাজাকার বন্দি হয় এবং বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ৫ই ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কোটচাঁদপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- করমালি (পিতা মসলেম উদ্দিন, শিবনগর), আলফাজ উদ্দিন মোল্লা (পিতা নছিবত মোল্লা, লক্ষ্মীপুর), জাকির হোসেন (পিতা ইউছুপ আলী, কুশনা), কবির হোসেন (পিতা জাহা বক্স, কাগমারি), তমিজ উদ্দিন (পিতা আব্দুর রহমান, পারলাট), আবুল ফজল (পিতা শেখ নাজিমুদ্দিন, পাশপাতিলা), আবুল হোসেন (পিতা ফয়জুদ্দিন বিশ্বাস, পাশপাতিলা), খোন্দকার আমির হোসেন (পিতা খোন্দকার মনির উদ্দিন আহমেদ, কোটচাঁদপুর পৌরসভা), মোখলেসুর রহমান (পিতা মুন্সী আবুল মাবুদ, কোটচাঁদপুর পৌরসভা), রবিউল ইসলাম (পিতা মুন্সী আবুল মাবুদ, কোটচাঁদপুর পৌরসভা) এবং মহসীন আলী (পিতা ছলেমান আলী বিশ্বাস, শিবনগর)।
কোটচাঁদপুর উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমানের (মহেশপুর উপজেলা; ৬ই নভেম্বর সাবদালপুর যুদ্ধে শহীদ) নামে ‘শহীদ মফিজুর রহমান সড়ক’ (বলুহর বাসস্ট্যান্ড থেকে সাবদালপুর বাজার পর্যন্ত) এবং ‘শহীদ মফিজুর রহমান চারু-কারু বিদ্যাপীঠ’ (সাবদালপুর) রয়েছে। [দেব নারায়ণ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড