You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কোটালীপাড়া উপজেলা (গোপালগঞ্জ)

কোটালীপাড়া উপজেলা (গোপালগঞ্জ) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর অসহযোগ আন্দোলন-এর উত্তাল দিনগুলোতে কোটালীপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়। ২৬শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু পাকবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন, তা গোপালগঞ্জ মহকুমা সদরসহ কোটালীপাড়া থানা সদরে এসে পৌঁছানোর পর এখানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। কোটালীপাড়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সতীশ চন্দ্র হালদার এমপিএ, সহ-সভাপতি চিত্তরঞ্জন গাইন, কাজী আশরাফ উদ্দিন (টুক্কু কাজী), কাজী আকরাম উদ্দিন আহম্মেদ (এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি), সন্তোষ কুমার বিশ্বাস (সাবেক এমপি), লক্ষ্মীকান্ত বল (শশিকর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক), অম্বরীষ জয়ধর, গফুর পাইক, কাজী ফিরোজ রশিদ, আবদুল আজিজ, কানাইলাল গৌতম, শেখ সেকান্দার আলী, কমলেশ চন্দ্র বেদজ্ঞ প্রমুখ নেতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠিত করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। এ উপজেলার হিজলবাড়ী বি কে আদর্শ হাইস্কুল মাঠ, বালিয়াভাঙ্গার কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশন মাঠ এবং সিকির বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলে মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহী ছাত্র-যুবকদের কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বি কে আদর্শ হাইস্কুল মাঠ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক ছিলেন বান্ধাবাড়ির আবদুল গফুর পাইক এবং মান্দ্রা গ্রামের সাবেক পুলিশ কনেস্টেবল বাবুল মিয়া। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কলাবাড়ি গ্রামের ডা. রেনূ ভূষণ বাড়ৈ, মধুসূদন হালদার, সহদেব বৈদ্য, সাংবাদিক রবীন্দ্র নাথ অধিকারী, ডা. সিদ্ধেশ্বর মজুমদার এবং চিত্তরঞ্জন ওঝাসহ কয়েক শত ছাত্র-যুবক প্রশিক্ষণ নেন। আওয়ামী লীগ নেতা চিত্তরঞ্জন গাইন, বি কে আদর্শ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তরণীকান্ত অধিকারী, শুকদেব বৈদ্য প্রমুখ এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া জুন মাসের শেষদিকে কোটালীপাড়া থানার নারিকেলবাড়ী মিশন হাইস্কুল মাঠে একটি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এখানে প্রশিক্ষণ নেন আশালতা বৈদ্যসহ বেশকিছু নারী। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন কোটালীপাড়া থানা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শেখ আবদুল আজিজ এবং ডা. লাল মোহন বিশ্বাস। জহরেরকান্দি হাইস্কুল মাঠে <হেমায়েত বাহিনীর কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে এ-সময় একটি মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মহানন্দ বিশ্বাস, বিশ্বেশ্বর বিশ্বাস প্রমুখ। উপদেষ্টা ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত বল। তখন শেখ জাবেদ আলী (বিমান বাহিনীর প্রাক্তন সার্জেন্ট) এবং ইঞ্জিনিয়ার শেখ মালেকসহ ১৭ জন সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যের তত্ত্বাবধানে বিমান হামলা প্রতিরোধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নাম দিয়ে জহরের কান্দি গ্রামে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খোলা হয়।
কোটালীপাড়া উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন সিকির বাজার স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক কমলেশ বেদজ্ঞ। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আবদুল মালেক মিলু, আজিজুল হক মাস্টার (স্কুল শিক্ষক) প্রমুখ। এছাড়া কোটালীপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সরদার আবদুল মালেক, লুৎফর রহমান, শামসুল হক, ডেপুটি কমান্ডার মুজিবুল হক প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হেমায়েত উদ্দিন ক্যান্টনমেন্টে হাবিলদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৬ই এপ্রিল তিনি ১৯ জন সৈনিক নিয়ে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। নানা পথ ঘুরে মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর চান্দার বিল, টেকেরহাট, কলাবাড়ী হয়ে ২৬শে এপ্রিল তিনি কোটালীপাড়া থানার বিরামকান্দিতে এসে পৌঁছান এবং তাঁর বাহিনী তৈরি করেন। হেমায়েত বাহিনী শুধু কোটালীপাড়ায়ই নয়, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, কাশিয়ানী, মকসুদপুর, আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, উজিরপুর, নাজিরপুর, মাদারীপুর, রাজৈর, কালকিনিসহ বিস্তির্ণ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁর বাহিনীতে সক্রিয় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ৫,৫৫৮ জন এবং কোম্পানি ৪৩টি।
১৪ই মে পাকবাহিনী কোটালীপাড়া উপজেলার উত্তর এলাকার হিন্দু গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। তারা কলাবাড়ি গ্রামে হামলা চালালে ঐ গ্রামের সুভাষ সরকার এবং মতিলাল সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তীর-ধনুকসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করে। কলাবাড়ির প্রতিরোধ যুদ্ধ-এ পাকহানাদার বাহিনী গ্রামবাসীদের ওপর গুলি চালালে সুভাষ ও রতিকান্ত শহীদ হন। একই সময় পার্শ্ববর্তী কালকিনি ও আগৈলঝাড়া উপজেলার নবগ্রাম ও দোনারকান্দি গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে গ্রামবাসীদের এ প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন নবগ্রামের অনিল চন্দ্র মল্লিক। তাঁর সহযোগী ছিলেন প্রফুল্ল হালদার, গোকুল মণ্ডল, চিত্ত রঞ্জন বল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। নবগ্রাম- দোনারকান্দি যুদ্ধ এ অনিল চন্দ্র মল্লিক শহীদ হন।
৩০শে এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী গোপালঞ্জের সিও অফিস প্রাঙ্গণে (বর্তমান উপজেলা পরিষদ) একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করে। এখান থেকে পাকবাহিনীর একটি দল ১৪ই মে লঞ্চযোগে কোটালীপাড়ায় প্রথম অনুপ্রবেশ করে এবং ঘাঘর বাজার সংলগ্ন নদীর দুপাড়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ২২শে জুন তারা দ্বিতীয়বার কোটালীপাড়ায় অনুপ্রবেশ করে তারাইল ও ধারাবাসাইলসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং অসংখ্য নারী-পুরুষকে পুড়িয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। জুলাই মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী কোটালীপাড়া থানাসংলগ্ন ডাকবাংলোয় একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে কোটালীপাড়ায় পাকবাহিনীর দোসররা সংগঠিত হতে থাকে। তারা রাজাকার, আলশামস ও আলবদরদের পৃথক বাহিনী গঠন করে। এ-সময় কাকডাঙ্গা-গোপালপুর মাদ্রাসায় স্থাপিত হয় একটি বৃহত্তম রাজাকার ক্যাম্প। ১৬ই জুন ঘাঘর বাজারে রাজাকার-আলবদরদের একটি সভা হয়। ঐ সভার সিদ্ধান্ত এবং তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসররা ২২শে জুন তারাইল বাজার থেকে ধারাবাসাইল-তারাকন্দর পর্যন্ত নিম্নবর্গের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে বাইনোকুলার দিয়ে দেখে-দেখে অসংখ্য লোককে গুলি করে হত্যা করে।
স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে এ উপজেলায় মুসলিম লীগ (কাইয়ুম), কনভেশন মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও জামায়াতে ইসলামী সক্রিয় ছিল। দক্ষিণ কোটালীপাড়ার পিঞ্জুরী, কুশলা, আমতলী, ঘাঘর, কান্দি প্রভৃতি ইউনিয়নে শান্তি কমিটি-র তৎপরতা ছিল। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালাত এবং পাকবাহিনীর পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করত। পাকবাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর গোপন আস্তানা, অবস্থান ও তাদের সংখ্যা সম্পর্কে খবর পাঠাত কান্দি ইউনিয়নের রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল চান মিয়া। রাধাগঞ্জ ইউনিয়নের রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল শওকত হোসেন (এরা দুজনই পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়)। এছাড়া কোটালীপাড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে জয়নাল আবেদীন (কুরপালা), আব্দুস সোবহান হাওলাদার (কেডি গোপালপুর), লোকমান শেখ (কুরপালা), শেখ আফতাব উদ্দিন (কেডি গোপালপুর), বেলায়েত ফকির (কুরপালা), সুলতান হোসেন সিকদার (কেডি গোপালপুর), শেখ আহম্মদ আলী (কেডি গোপালপুর) এবং মাওলানা সিরাজুল হক খান (কেডি গোপালপুর) খুবই সক্রিয় ছিল।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কুশলা গ্রামের সারাফাত হোসেন চৌধুরী (গোপালগঞ্জ মহাকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কনভেশন মুসলিম লীগের মনোনয়নে সাইকেল প্রতীকে এমএনএ পদে ফরিদপুর ৮ আসনে নির্বাচন করে) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৪ই মে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা উত্তর কোটালীপাড়া গ্রামে হামলা চালায়। তারা ঘাঘর বাজার, রাধাগঞ্জ, খেজুরবাড়ী, গাছবাড়ী, মান্দ্রা, চিতলিয়া, বুরুয়া, কালিগঞ্জ ভাঙ্গারপাড়, কলাবাড়িসহ নদীর দুপাশের শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে শ্মশানে পরিণত করে। কলাবাড়ি গ্রামের তরণীকান্ত বালা, মতিলাল বাড়ৈ, সুচিত্রা বাড়ৈ, রাজেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ফটিক লাল মাঝি, সুভাষচন্দ্র সরকার, রতিকান্ত সরকারসহ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২২শে জুন পাকহানাদার বাহিনী তারাইল ও ধারাবাসাইলসহ দক্ষিণ কোটালীপাড়ায় কয়েকশ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারীধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড চালায়। গোপালগঞ্জের মিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে একাধিক গানবোটে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারাইল বাজারে সাপ্তাহিক হাটের দিনে হামলা ও গণহত্যা চালায়। তারাইল বাজার গণহত্যায় বহু লোক নিহত হয়।
১২ই অক্টোবর মধুমতি নদী থেকে পাকহানাদার বাহিনীর একটি কার্গো হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কলাবাড়ি গ্রামে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে পাকবাহিনী ১৩ই অক্টোবর গ্রামবাসীর ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। শতাধিক গ্রামবাসীকে ধরে এনে চোখ ও হাত-পা বেঁধে বেয়োনেট চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করে কার্গো থেকে বাবুর খালে ফেলে দেয়। শুধু ‘কালু’ নামে এক যুবক হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নদী থেকে উপরে উঠে এসে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। শতবর্ষী অম্বিকাচরণ বাড়ৈও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। কলাবাড়ি গণহত্যায় গোপালচন্দ্র অধিকারী, বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী, অনুষচন্দ্র হালদার ও নিমাই ওঝাসহ শতাধিক লোক শহীদ হন।
কোটালীপাড়া থানায় পাকবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পই ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। পাকবাহিনী বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও মুক্তিকামী মানুষদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন করত। নারীদের ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত।
এ উপজেলার রুথিয়ারপাড় গ্রামে একটি গণকবর রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নিহতদের এখানকার একটি পুকুরপাড়ে গণকবর দেয়া হয়, যা রুথিয়ারপাড় গণকবর হিসেবে পরিচিত।
এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মোট ৫ বার কোটালীপাড়া থানা অপারেশন করেন। ২৮শে এপ্রিল প্রথম হেমায়েত উদ্দিন তাঁর দল নিয়ে কোটালীপাড়া থানা অপারেশন করে পুলিশের নজরবন্দিতে থাকা ২৫-২৬ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এরপর পাকবাহিনী কোটালীপাড়া থানার পুলিশের সহায়তায় হেমায়েত উদ্দীনের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিলে ৪ঠা মে তিনি থানা আক্রমণ করেন। এটি ছিল দ্বিতীয়বার কোটালীপাড়া থানা অপারেশন। এ অপারেশনে হেমায়েত উদ্দিনের বাহিনী ৫৪টি রাইফেল ও বেশকিছু গুলি নিজেদের দখলে নেয়। ৮ই সেপ্টেম্বর হেমায়েত বাহিনী পুনরায় কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে। দিনব্যাপী উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। এ-যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী কোটালীপাড়া ছাড়তে বাধ্য হয় এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ হেমায়েত বাহিনীর দখলে আসে। এর দুদিন পর পাকবাহিনী কোটালীপাড়া থানার দখলে নেয় এবং ১৫ই সেপ্টেম্বর হেমায়েত বাহিনী পুনরায় থানা আক্রমণ করে তা পুনর্দখল করে। ১৪ ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রেশনসামগ্রী হেমায়েত বাহিনীর দখলে চলে আসে। দুদিন পর পাকবাহিনী পুনরায় থানায় অবস্থান নেয়। ২রা ডিসেম্বর হেমায়েত বাহিনী শেষবারের মতো থানায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। দুদিনব্যাপী এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যাহত আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে ১২৭টি রাইফেল, ২টি এলএমজি ও ১০ হাজার গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয় এবং কোটালীপাড়া থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
১৪ই জুন হরিণাহাটিতে পাকবাহিনীর সঙ্গে হেমায়েত বাহিনীর যুদ্ধ হয়। হরিণাহাটি যুদ্ধ-এ পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা ১৭ই জুন ২০টি লঞ্চ নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে হেমায়েত বাহিনীর রাজাপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে। কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিনও তাঁর বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করেন। আক্রমণের মুখে পাকবাহিনী সাঁতলা গ্রামসংলগ্ন বাঁক ধরে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। এটি রাজাপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৪ই অক্টোবর পাকবাহিনীর তিনটি দল হেমায়েত বাহিনীর চলবল (কালকিনি উপজেলার অন্তর্গত) ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ- সময় তাদের একটি দল রামশীল গ্রামে ঢুকে পড়লে হেমায়েত উদ্দিন ও তাঁর সহযোগী কমলেশ বেদজ্ঞ মাত্র ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রামশীল যুদ্ধ-এ হেমায়েত উদ্দিনের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী নায়েক মকবুল শহীদ হন এবং তিনি নিজে গুরুতর আহত হন। শত্রুর একটি গুলি নায়েক মকবুলের মাথার খুলি ভেদ করে চলে যায় এবং অন্য একটি গুলি হেমায়েতের মুখে বামপাশ দিয়ে ঢুকে ডান চোয়ালের একটি দাঁত সহ বেরিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে হেমায়েত ডা. রাজেশ্বর রায়, ডা. সুরেন্দ্রনাথ সরকার, ডা. বেলায়েত হোসেনের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন এবং পরে মুকসুদপুরের বানিয়াচর মিশনের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেন। মিশনের ফাদার মারিনো রিগন- তাকে চিকিৎসা প্রদান করেন। ৪৫ মিনিট স্থায়ী এ যুদ্ধে ১৫৮ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হেমায়েত বাহিনীর দখলে আসে। ৩রা ডিসেম্বর কোটালীপাড়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম- (পিতা মুন্সি আবদুল করিম, টুপারিয়া)।
কোটালীপাড়ার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- গোলাম আলী হাওলাদার (পিতা ছৈজ উদ্দিন হাওলাদার, ডহরপাড়া), বেলায়েত হোসেন শেখ (পিতা মো. মালু শেখ, মাঝবাড়ি, আনসার সদস্য), আবু তালেব (পিতা জয়েনউদ্দিন কাজী, সিতাইকুণ্ডু), মো. মোক্তার হোসেন (পিতা আব্বাস আলী খান, গোপালপুর), রতিকান্ত সরকার (কলাবাড়ি, কলাবাড়িতে শহীদ হন), সুভাষ সরকার (কলাবাড়ি, কলাবাড়িতে শহীদ হন), আবুল বাশার, রতন কুমার, মোয়াজ্জেম হোসেন, ওসমান শেখ, তৈয়ব আলী, মোতাহার হোসেন খান, মোক্তার হোসেন দাঁড়িয়া (আশুতিয়া) ও মো. মিলু চৌধুরী (কুশলা)।
অন্যান্য অঞ্চলের যেসব মুক্তিযোদ্ধা কোটালীপাড়ার যুদ্ধে শহীদ হন তাঁরা হলেন- বেলায়েত হোসেন (টুঙ্গিপাড়া), ইব্রাহিম খান (গাজীপুর, রামশীলের যুদ্ধ শহীদ), মকবুল হোসেন (কালকিনি), আবদুস সালাম তালুকদার (কালকিনি), সাত্তার মৃধা (গৌরনদী), সেকেন্দার আলী (গৌরনদী), নূরু ব্যাপারী (গৌরনদী), পরিমল শীল (গৌরনদী), পরিমল চন্দ্র মণ্ডল (গৌরনদী), আলাউদ্দিন বক্স (গৌরনদী), সৈয়দ আবুল হাসেম (গৌরনদী), মোখতার হোসেন (গৌরনদী), মোয়াজ্জেম হোসেন তালুকদার (আমতলী), নায়েক মকবুল (গাজীপুর, রামশীলের যুদ্ধে শহীদ), ওসমান ওসমান শেখ (নলছিটি), কদভানু বিবি (বিরামকান্দি), তৈয়াব আলী বকতিয়ার (আগৈলঝাড়া), মো. আকরামুজ্জামান (মানিহার, গোপালগঞ্জ), মো. বজলু মোল্লা (মানিহার), মনসুর আলী শেখ (মানিহার) ও রাজামোল্লা (মানিহার)। কোটালীপাড়ার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই হেমায়েত বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
কোটালীপাড়ার জহরেরকান্দিতে হেমায়েত বাহিনীর প্রশিক্ষণ স্থলে ভাস্কর্যসহ একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কোটালীপাড়া উপজেলার পশ্চিমপাড়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের পার্শ্বে হেমায়েত বাহিনী স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম ১৯৯১ সালের ১৫ই জানুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন। ফলকটিতে লেখা রয়েছে হেমায়েত বাহিনীর ১৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, ৯ জন আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং অপারেশন এলাকার নাম। হেমায়েত উদ্দিনের জন্মস্থান টুপুরিয়া গ্রামে তাঁর দানকৃত জায়গায় সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হেমায়েত বাহিনী স্মৃতি জাদুঘর। এখানে রয়েছে হেমায়েত বাহিনীর ব্যবহৃত বিভিন্ন যুদ্ধ সরঞ্জাম এবং যুদ্ধকালীন সময়ে হেমায়েত বাহিনী সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্র- পত্রিকার রিপোর্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটালীপাড়ার অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে এর উদ্বোধন করেন। কলাবাড়ি গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে কালিগঞ্জ বাজারে ২০১৩ সালে নির্মিত হয়েছে কলাবাড়ি ইউনিয়ন স্মৃতিসৌধ। [রবীন্দ্রনাথ অধিকারী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!