কোটালীপাড়া থানা অপারেশন (গোপালগঞ্জ)
কোটালীপাড়া থানা অপারেশন (গোপালগঞ্জ) পরিচালিত হয় ৪ঠা মে। এতে থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে এবং থানার প্রচুর অস্ত্র তাঁদের হস্তগত হয়। ৩০শে এপ্রিল সকালে কোটালীপাড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম-কে তাঁর বাহিনী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য কোটালীপাড়া থানা থেকে আহ্বান জানানো হয়। হেমায়েত তাতে সাড়া না দিয়ে তাঁর বাহিনী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অন্য একটি গ্রামের গোপন আস্তানায় অবস্থান নেন। দুদিন পর পাকবাহিনী ও পুলিশ মিলে হেমায়েতের টুপুরিয়া গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। মাত্র ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি কোটালীপাড়া থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। ৩রা মে বিকেলে একটি নৌকায় করে তাঁরা অজ্ঞাত আস্তানা থেকে হিরণ হাটের উদ্দেশে রওনা দেন। নৌকাটি খালবিল, নদী-নালা পেরিয়ে ঘাঘর নদীতে পড়তেই কুলে ভেড়ানো একটি নৌকা থেকে আওয়াজ আসে, ‘এ নৌকা কোথায় যাবে?’ হেমায়েত মেয়েলি কণ্ঠে উত্তর দেন, ‘ভাঠিয়া সাধুর বাড়ি যাবে, নৌকায় কলেরা রোগী আছে।’ ঐ নৌকা থেকে আবার আওয়াজ আসে, ‘নৌকা এখানে ভিড়াও, থানার সাহেবরা ডাকে।’ পাশেই আরো ৪-৫টি নৌকা ভেড়ানো ছিল। সেগুলোতেও লোকজন ছিল। কুলে ভিড়ে থাকা ঐ নৌকা থেকে অন্য একজন ৩০৩ রাইফেল তাক করে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘নৌকা ভিড়াও, নয়তো গুলি করবো।’ হেমায়েত অবস্থার গুরুত্ব বুঝে নৌকা ভেড়াতে বলেন। এ-সময় হেমায়েত বাহিনীর সদস্য হাবিলদার ইব্রাহিম কলেরা রোগীর মতো বমি করার ভান করেন। বমির আওয়াজ শুনে শত্রুপক্ষ বিভ্রান্ত হয়। এ অবস্থায় হেমায়েত তাদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সঙ্গীদের নিজনিজ অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে ইশারায় নির্দেশ দেন। নৌকার মাঝিকে ইঙ্গিতে অন্য নৌকার পাশাপাশি ভেড়াতে বলেন যাতে নৌকা ভেড়ানোর সঙ্গে- সঙ্গেই সামনের ও পেছনের গুলুই হয়ে নৌকাটির ভেতরে অবস্থানকারীদের একযোগে হ্যান্ডস-আপ করানো যায় মাঝি নৌকাটি পুলিশের নৌকাটির পাশে ভেড়াতেই মাঝবাড়ি নিবাসী মালেক নামের পুলিশের একজন ইনফরমার নৌকার গুলুইয়ে মাঝির পাশে এসে বসে। নৌকার ভেতরে কারা আছে জিজ্ঞেস করতে-না-করতেই নায়েক সোলায়মান ও হাবিলদার ইব্রাহিম এক লাফে অন্য নৌকার গুলুইয়ে উঠে ফায়ারিং পজিশনে চলে যান। হেমায়েত তাঁর মেশিনগানটি সেট করে ফায়ারিং পজিশনে নিয়ে যান। এ পরিস্থিতিতে নৌকার তিনজন পুলিশ অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। অন্য নৌকাগুলোতে অবস্থানকারী ২৫-৩০ জন স্থানীয় রাজাকারও অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশের ৩টি রাইফেল নিজেদের দখলে নিয়ে নদীর ওপার গিয়ে একটি হাইড আউটে অবস্থান নেন। সেখানেই তাঁরা রাত কাটান এবং পরের দিন কোটালীপাড়া থানা অপারেশনের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেন৷
পরদিন ৪ঠা মে সকাল ৭টার দিকে হেমায়েত ও তাঁর বাহিনীর সদস্যরা খাকি পোশাক, ক্যাপ এবং বুটজুতা পরে কাঁধে অস্ত্র ঝুলিয়ে থানার উদ্দেশে রওয়ানা দেন। নৌকাটি থানা থেকে কিছুটা দূরে রেখে দুই কাঁধে ক্যাপ্টেনের তারকাচিহ্নিত ব্যাজ লাগিয়ে হেমায়েত ফৌজি কায়দায় হেঁটে থানার দিকে অগ্রসর হন। পেছনে তাঁর সঙ্গীরা একই কায়দায় তাঁকে অনুসরণ করেন। থানায় প্রবেশ করে পুলিশের এক সেপাইকে দেখে ক্যাপ্টেন হেমায়েত জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা বাতাও কোনসে থানা হ্যায়?’ ক্যাপ্টেন হেমায়েত সেপাইটির আরো কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমহারা ওসিকা নাম বারেক আলী জোয়ারদার হ্যায়?’ ‘আপ বাতাও মুক্তিলোগ কিধার হ্যায়?’ সেপাই জবাব দেয়, ‘হেমায়েত সর্বনাশ করতি হ্যায় স্যার।’ ক্যাপ্টেন হেমায়েত আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা বাতাও হেমায়েত কিধার রেহেতা হ্যায়?’ সেপাই জানায়, ‘স্যার মালুম নেহি। ক্যাপ্টেন হেমায়েত ধমকের স্বরে বলেন, ‘গাদ্দার কি বাচ্চে যাও তোমহারা ওসিকে ইধার বোলাকে আও।’ সঙ্গে-সঙ্গে সেপাইটি রাইফেল কাঁধে নিয়ে ওসির বাংলোর দিকে যেতে উদ্যত হয়। হেমায়েত তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘গাদ্দার কি বাচ্চে রাইফেল ইধার রাখ দো।’ সেপাইটি রাইফেল মাটিতে রেখে দ্রুত বাংলোর দিকে অগ্রসর হয়। হাবিলদার ইব্রাহিম তাঁর চাইনিজ রাইফেলটি তাক করে দ্রুত গতিতে তার পিছু-পিছু অগ্রসর হন। সেপাই ওসির দরজায় ধাক্কা দিয়ে উচ্চ স্বরে বলে, ‘স্যার মিলিটারি এসেছে। ক্যাপ্টেন সাহেব আপনার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছেন। ওসি দরজা খুলতেই হাবিলদার ইব্রাহিমকে দেখে এটেনশন হয়ে বলে, ‘স্যার মাই আতা হ্যায়’। ইব্রাহিম রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠলো ‘জলদি বে আও।’
ক্যাপ্টেন হেমায়েত থানার লাইনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে জোরে চিৎকার করে উর্দু ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। এতে পুলিশ লাইনের সবাই ঘুম থেকে জেগে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে চলে আসে। হেমায়েত রুক্ষ কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘হাতিয়ার রাখকে জলদি ছে ফল ইন হোয়াও।’ নির্দেশমতো পুলিশের সকল সদস্য ব্যারাকের সামনের মাঠে এক লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। হেমায়েত কমান্ডিং ভয়েসে তাদের বলেন, “ইন থ্রিজ ফল ইন হো যাও।’ নির্দেশমতো তিন লাইনে সবাই এটেনশন অবস্থায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে ওসি বারেক আলী জোয়ারদার পোশাক পরে এসে এটেনশন হয়ে হেমায়েতকে সেলুট দেয়। হেমায়েত জিজ্ঞেস করেন, ‘তোম কৌন হ্যায়? তেরা নাম কেয়া হ্যায়?’ ওসি জানায়, ‘ম্যায় ওসি হ্যায়। মেরা নাম বারেক আলী জোয়ারদার হ্যায়। ভয়ে তখন ওসির পাদুটি কাঁপছিল। এ-সময় হেমায়েত উর্দুতে গালিগালাজ করে তাদেরকে বোঝান যে, তিনি বাঙালি নন। সারিবদ্ধ সকলকে তিনি পরপর তিনবার এটেনশন এবং ‘স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ’ হতে আদেশ দেন। এই ফাঁকে ইব্রাহিম এবং সোলায়মান দুটি মেশিনগানই ফায়ারিং পজিশনে নিয়ে যান। তারা নিশ্চিত হন যে, পুলিশ লাইনের ভেতরে ফল-ইন হতে আর কেউ-ই বাকি নেই। পুলিশের রাইফেলগুলো ব্যারাকের বারান্দায় ইতোমধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হেমায়েত তিন সারিতে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যদের তখন এটেনশন অবস্থায় চলে আসতে নির্দেশ দিয়েই তাঁর হাতের এসএমজি কক করে ফায়ারিং পজিশনে রেখে সকলকে উদ্দেশ্য করে বাংলায় বলে উঠলেন, ‘এই শালার বাচ্চারা, এইবার দেখবি হেমায়েতের বাড়ি পোড়ানোর মজা।’ এরপর হেমায়েত ওসিকে তাঁর পাশেই এটেনশন অবস্থায় রেখে সকল পুলিশকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে রাস্তা ধরে সোজা। পূর্বদিকে দৌড় দিতে নির্দেশ দেন। নির্দেশমতো থানার সকল পুলিশ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে দৌড়ে যেতে থাকে। এ-সময় হেমায়েতের ২ জন সহযোদ্ধা পুলিশ ব্যারাকের 5 বারান্দায় রাখা ৫৪টি রাইফেল এবং সমস্ত গোলাবারুদ একত্র করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। ওসি বারেক আলী হেমায়েতের কাছে ক্ষমা চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করলে তিনি তাকে ছেড়ে দেন।
কোটালীপাড়া থানা হেমায়েত বাহিনীর দখলে এবং তাদের অপারেশন সফল হয়েছে এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক হাজার মানুষ থানা এলাকায় এসে হাজির হয় এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। কোটালীপাড়ার মুক্তিযুদ্ধে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে আজো এলাকার জনগণ স্মরণ করে থাকে। [রবীন্দ্রনাথ অধিকারী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড