You dont have javascript enabled! Please enable it!

কোদালিয়া গণহত্যা (নগরকান্দা, ফরিদপুর)

কোদালিয়া গণহত্যা (নগরকান্দা, ফরিদপুর) ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার চাঁদহাট যুদ্ধে পাকবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর ৩০শে মে থেকে ১লা জুন পর্যন্ত তিনদিন এ থানার কোদালিয়ায় পাকিস্তানি সেনারা নারকীয় তাণ্ডব ও গণহত্যা পরিচালনা করে। এদিন মুকসুদপুর, ভাঙ্গা, নগরকান্দা ও কাশিয়ানী থেকে বহু সংখ্যক পাকসেনা গুলি করতে-করতে নগরকান্দা থানার দিকে অগ্রসর হয়। তারা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। কয়েকটি হেলিকপ্টার থেকেও তারা শেলিং করে। এর আগে অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পাকসেনারা নগরকান্দা ও ঈশ্বরদীতে গুলি করে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী গণহত্যা সংঘটিত হয় কোদালিয়ায়। কোদালিয়ায় তখন অনেক ব্যবসায়ীর বসবাস ছিল। তাদের মালামাল বাড়িতে রাখা ছিল। বাইরের কিছু ব্যবসায়ীও সেখানে মালামাল গচ্ছিত রেখেছিল। স্থানীয় -রাজাকার-রা এসব মালামাল লুট করার পর অনেকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ৫০-৬০টি বাড়ি ভস্মীভূত হয়। এদিকে গ্রামবাসীদের এনে মাঠের মধ্যে জড়ো করে রাখা হয়। সেখান থেকে তারা দেখছিল তাদের বাড়িঘর ভস্মীভূত হওয়ার করুণ দৃশ্য। এরপর শুরু হয় তাদের জীবনের ওপর আক্রমণ। প্রথমে গ্রামবাসীদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম ভাগে বয়স্ক পুরুষ, দ্বিতীয় ভাগে শিশু-কিশোর এবং তৃতীয় ভাগে রাখা হয় মহিলাদের। মহিলাদের কারো-কারো কোলে ছিল দুগ্ধপোষ্য শিশু। বয়স্ক পুরুষদের চাঁদহাট যুদ্ধে নিহত পাকসেনাদের লাশ ও লুটের সামগ্রী বহনের কাজে নিয়োজিত করা হয়। শিশু- কিশোরদের বিলের ওপারে নিয়ে বন্দুক তাক করে বসিয়ে রাখা হয়। তারা গুলির শব্দ শুনে আঁতকে ওঠে। তারা অনেক অনুনয়-বিনয় ও কান্নাকাটি করে, কিন্তু তাতে তাদের পাষাণ হৃদয় গলেনি। বিকেল ৫টা পর্যন্ত এভাবে আটকে রাখা হয়। তারপর এসব শিশু-কিশোরদের ছেড়ে দিয়ে বলা হয়, ‘তোমাদের মায়েরা তোমাদের জন্য রান্না করে বসে আছে, যাও, গেলেই খেতে পাবে। তারা এসে দেখতে পায় মাদ্রাসার মাঠে তাদের মায়েদের হত্যা করে লাশগুলো কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কারও মাথা নেই, কারও হাত নেই। চারদিকে রক্তের বন্যা বইছে। এদিন এক সঙ্গে ১৮ জন নারী হত্যার শিকার হন। বুলেটবিদ্ধ তিনটি শিশুসহ ৫- ৬ জন বেঁচে যায়।
১৯৯৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর সেই দুঃসহ ও অবর্ণনীয় ঘটনার বর্ণনা দেন ছয়টি বুলেটের ক্ষত নিয়ে বেঁচে যাওয়া রহিমা খাতুন নামে এক নারী। তিনি রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের মাদ্রসার মাঠে নিয়ে গেল। একথা বলার পর তিনি অঝোরে কাঁদলেন। বলতে পারছিলেন না তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের কথা। সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা চেপে রেখে কেবল বললেন, ‘গুলি করার আগে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোমরা কি পানি খেতে চাও?’ আমরা বলি, ‘না, তোমরা কাফের, তোমাদের হাতের পানি আমরা খাব না।’
তিনদিন ধরে পাকসেনারা কোদালিয়া, ঈশ্বরদী, ঝাটুরদিয়া, চুড়িয়ার চর, বাগাট, নগরকান্দা বাজার, খাড়দিয়া, কুমারকান্দা, আলমপুরা, বাউসখালী, সোনাতুন্দী, বল্লভদী, নগরকান্দা, রথখেলা, গোপালকরদী, আটকাহনীয়া, বনগ্রাম, গোয়ালদী, মেহেরদিয়া, পুড়াপাড়া, ঘুনাপাড়া, দফা, চাঁদহাট, ঘোনাপাড়া প্রভৃতি গ্রামে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হেলিকপ্টার থেকে পলায়নরত নর-নারী-শিশুদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনদিনে তারা নগরকান্দায় সব নিয়ে দুশতাধিক লোককে হত্যা করে। আর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং সেই সঙ্গে নারীধর্ষণের অসংখ্য ঘটনাও ঘটে।
পাকসেনাদের এই অপারেশনে কোদালিয়ার রহিমুন্নেসা, হামিদা, ফিরোজা বেগম, কলি, ফুলজান বেগম, আফজাল মিয়া, রাবেয়া খাতুন, নূরজাহান বেগম, আকরামুন্নেসা,। সুফিয়া বেগম, চেলা বেগম, পারভীন আক্তার, আমেনা বেগম, আসফরদীর খোরশেদ মিয়া, হানিফ মিয়া, গফুর আলী মীর, মোহাম্মদ আলী মীর, বাদশা মীর, জব্বার আলী মীর, ফেলু শেখ, আজাহার মোল্লা, কানফরদীর আবদুল মালেক মাতুব্বর, আবদুল বারেক মাতুব্বর, ঈশ্বরদীর আবদুল মাজেদ, মাজু খাতুন, আবদুস সালাম, ফুলজান, আলেকজান, কাইচালের রোমন মিয়া, আবদুস সাত্তার মিয়া, ধলা মিয়া, জগদিয়াবালিয়ার ক্ষুদিরাম মণ্ডল, যাদব সরকার, দহিসারার ইসমাইল মোল্লা, চাঁদহাটের মোতালেব মোল্লা, রতন মাতুব্বর, মনসুর তালুকদার, বাগাটের আইয়ুব আলী, রতন মাতুব্বর, মালেক মাতুব্বর, আমজেদ মুন্সী, মঞ্জু রানী, ব্রাহ্মণডাঙ্গার সদু রাজবংশী, মোহন মিয়া প্রমুখ নিহত হন। কোদালিয়াতে শহীদদের দুটি গণকবর রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামে শহীদদের বিচ্ছিন্নভাবে পুঁতে রাখা হয়। [আবু সাঈদ খান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!