You dont have javascript enabled! Please enable it!

কেলিশহর রাজাকার অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম)

কেলিশহর রাজাকার অপারেশন (পটিয়া, চট্টগ্রাম) পরিচালিত হয় ২রা অক্টোবর। এতে ১ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের উত্তর হাইদগাঁও ও কেলিশহর ইউনিয়নের কোঁয়ারপাড়ার কতিপয় রাজাকার সর্বদা কেলিশহর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় এবং সুচক্রদণ্ডি ইউনিয়নের দক্ষিণ ভূর্ষি (দক্ষিণ ভূর্ষি এখন আলাদা ইউনিয়ন)- র কেচিয়া পাড়া গ্রামে নানা ধরনের অত্যাচার করত। তারা নারীধর্ষণ, লুটপাট, গরু-ছাগল-টাকা-পয়সা-স্বর্ণালংকার-ঘরের টিন লুট এবং ঘরে অগ্নিসংযোগ করত। এছাড়া পটিয়া পিটিআই পাকিস্তানি ক্যাম্পে উক্ত এলাকাগুলো থেকে নারী সরবরাহ করত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ লোকজনকে ধরে এই ক্যাম্পে হত্যা করাতো। তাছাড়া পাকিস্তানের দালালরা মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর সংগ্রহ করে এই ক্যাম্পে জানাত। ফলে সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।
কেলিশহর ভট্টাচার্য হাট বসত শনিবার ও মঙ্গলবার। রাজাকাররা এখানে চাঁদা তুলত এবং নানারকম উৎপাত চালাত। ২রা অক্টোবর হাটবার দিন সন্ধ্যার আগে-আগে সেখানে সামশুদ্দিন আহমদ গ্রুপ অপারেশন পরিচালিত করে। এ অপারেশন পরিচালনার উদ্দেশ্যে গ্রুপটি ১লা অক্টোবর রাতে দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রামে এক হিন্দুবাড়ির দোতলায় আশ্রয় নেয়। বাড়ির লোকজন শরণার্থী হিসেবে ভারতে চলে গিয়েছিল। বাড়িটিতে এক বিধবা মহিলা গ্রুপটিকে রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
২রা অক্টোবর বিকেল ৫টার পরে গ্রুপটি সেখান থেকে গ্রামের মেঠোপথ ধরে ভট্টাচার্য হাটে পৌঁছায়। কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদ একটি থলের মধ্যে করে তাঁর স্টেনগান নিয়েছিলেন। তাতে দুই ম্যাগাজিনভর্তি গুলি ছিল। হাটে পৌঁছে সেখানকার পশ্চিম মাথায় কমান্ডার তাঁর গ্রুপের দুজন যোদ্ধা নিয়ে একটি চায়ের দোকানে অবস্থান নিয়ে থলেটি নিজের বাম পাশে রাখেন। অন্য যোদ্ধারা কমান্ডারের নির্দেশে রাজাকারদের অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য হাটে বাজার করতে আসা লোকদের মধ্যে মিশে যায়। তবে তারা তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসার আগেই কমান্ডার দোকান থেকে দেখতে পান দোকানের সামনে তরিতরকারি ব্যাপারিদের কাছ থেকে উত্তর হাইদগাঁওয়ের রাজাকার মনুমিয়া চাঁদা তুলছে। দোকানটি ছিল ত্রিমোহনায়। একটি দক্ষিণ ভূর্ষি খানমোহনা থেকে, একটি কেলিশহর থেকে, আরেকটি ভট্টাচার্য হাট থেকে এসে মিশেছে। এই ত্রিমোহনাও হাটের অংশ ছিল। কমান্ডার মনু মিয়াকে দেখে স্টেনগানে ম্যাগাজিন ভর্তি করে দোকান থেকেই তার দিকে তাক করেন। তখন কমান্ডারের সঙ্গে থাকা যোদ্ধাদ্বয়ের মধ্য থেকে আবদুস সবুর নামক একজন যোদ্ধা কমান্ডার কিছু বুঝে উঠার আগেই দোকান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে মনু মিয়াকে ঝাপটে ধরে। কিন্তু ততক্ষণে কমান্ডারের স্টেনগান থেকে ফায়ার শুরু হয়ে গেছে। গুলিতে মনু মিয়ার ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। কিন্তু মনু মিয়ার শরীর ভেদ করে সবুরের বুকের বামপাশেও গুলি বিদ্ধ হয়। গুলির আওয়াজে হাটের মানুষ ও রাজাকাররা পালাতে শুরু করে এবং অন্য যোদ্ধারা দোকানে চলে আসে। তারপর ভট্টাচার্য হাটের স্থানীয় এক গ্রাম্য চিকিৎসকের বাড়িতে সবুরকে নিয়ে যাওয়া হলে রাত দশটার দিকে সেখানে সবুর মৃত্যুবরণ করেন। সবুর তখন পটিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি শুধু বলেছিলেন: ‘আমি মরে গেলেও দেশ স্বাধীন হবে। দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করে গেলাম। তখন কাফনের কাপড় কেনার জন্য ভট্টাচার্য হাটে কোনো দোকান খোলা ছিল না। ফলে কমান্ডার চিকিৎসকের বাড়ি থেকে একটি লুঙ্গি নিয়ে নিজের পরনে থাকা সাদা লুঙ্গিটি চেঞ্জ করে সেটি ধুয়ে নিয়ে তা কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভট্টাচার্য হাটের পূর্বপাশে পাহাড়ের পাদদেশে খিল্লাপাড়া গ্রামে তাঁকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় দাফন করা হয়। এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদ (পিতা আবদুল মন্নান, গোবিন্দারখীল), গাজী আবদুস সবুর (পিতা গাজী আলী চান সওদাগর, পটিয়া সদর), আবুল বশর (পিতা আবুল খায়ের, করল), আবুল কালাম (পিতা আবদুস সালাম, পটিয়া সদর), কবির আহমদ (পটিয়া সদর), সেনা-সদস্য আহমদ ছফা চৌধুরী (উত্তর গোবিন্দারখীল), আবু জাফর চৌধুরী (পিতা নজির আহমদ চৌধুরী, উত্তর গোবিন্দারখীল), জহুরুল হক চৌধুরী (উত্তর গোবিন্দারখীল) এবং আবদুস সোবহান মিস্ত্রি (উত্তর গোবিন্দারখীল)। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!