মুক্তিযুদ্ধে কেশবপুর উপজেলা (যশোর)
কেশবপুর উপজেলা (যশোর) কেশবপুর উপজেলার উত্তরে যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলা, পূর্বে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলা, দক্ষিণে সাতক্ষীরা জেলার তালা এবং পশ্চিমে কলারোয়া উপজেলা অবস্থিত। কপোতাক্ষ, বুড়িভদ্রা, হরিহর ও সাতনল নদীবিধৌত এ উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধে কেশবপুর উপজেলা ছিল হাকিমপুর সাব-সেক্টরের অধীন। সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় কেশবপুরেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান – সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এর সকল কর্মসূচি এখানে যথারীতি পালিত হয়। এ সকল আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন মুকুন্দ বিহারী, সুব্রত কুমার মিত্র এমএনএ, আব্দুল হালিম মাস্টার (পরবর্তীতে এমপি), আনোয়ার হোসেন বিশ্বাস, জোনাব আলী সরদার, ডা. মহেন্দ্র নাথ দাস, তপন কুমার ঘোষ, কামাল উদ্দিন ফকির, আইউব আলী সরদার, লুৎফর রহমান, অশোক ঘোষ, জি এম এরশাদ, আবুল কালাম আজাদ, কেসমত আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। যশোর জেলা -আওয়ামী লীগ নেতা শাহ হাদীউজ্জামান এমপিএ, জেলা ছাত্রলীগ-এর সাধারণ সম্পাদক খান টিপু সুলতান, ছাত্রনেতা বজলুর রহমান প্রমুখ এ সময় যশোর সদরের পাশাপাশি কেশবপুরসহ পার্শ্ববর্তী থানাগুলোতেও সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতেন। তাঁদের উদ্যোগে এখানে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে এলাকার মানুষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে সংগঠিত হয়। যুদ্ধ আসন্ন ভেবে তাদের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছিল। কৃষক-শ্রমিকসহ প্রায় সকলের মুখেই ছিল একই কথা— “যুদ্ধ হবে, খানসেনাদের খতম করা হবে, দেশ স্বাধীন হবে।’ এ অঞ্চলের ছাত্র-জনতা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় বাজারে এসে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে সমবেত হতো এবং খবরাখবর জানতে ব্যাকুল থাকত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বিভিন্ন অংশ তখন এখানকার মানুষের মুখে-মুখে উচ্চারিত হতো। কেশবপুর উপজেলা জেলা যশোর সদরের নিকটবর্তী হওয়ায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাত্র-যুবকদের নিয়ে সদরের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন। তাই এখানে আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠেনি।
কেশবপুর থানার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আনিছুর রহমান খান (বরণঢালী)। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন- সুভাষ দেবনাথ (হাড়িয়াগো), মো. মনির উদ্দিন (গোবিন্দপুর), মোহাম্মাদ আলী, মো. তৌহিদুর রহমান ও ডা. শহিদুল ইসলাম। এখানকার যুদ্ধকালীন সাব-কমান্ডাররা হলেন- কালিপদ মন্ডল, হারান কুমার নাথ, আব্দুল হামিদ গাজী, আব্দুর রহমান ঢালী ও পাগল সাহা।
কেশবপুর উপজেলায় পাকবাহিনী কোনো স্থায়ী ক্যাম্প করেনি। তবে তারা প্রায়ই এখানকার প্রধান সড়কে টহল দিত। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নেই রাজাকার ক্যাম্প ছিল। কেশবপুর সদরে রাজাকার ক্যাম্প ছিল পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ে। এ ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন আমিন উদ্দিন মাস্টার ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন মুন্সি দীন মোহাম্মদ। এছাড়া ত্রিমোহনীতেও একটি রাজাকার ক্যাম্প ছিল।
কেশবপুরে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন হিসেবে তৎপর ছিল মুসলিম লীগ এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ। স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা কফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কেশবপুরে শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ছিল গাজী এরশাদ। কেশবপুর পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিন উদ্দিন মাস্টারের উদ্যোগে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মো. ইজাহার আলী (চালিতাবাড়িয়া), মুজিবুর রহমান (চিংড়া), আবুল হোসেন (বরেঙ্গা), কাওছার আলী (দোরমুটিয়া), আব্দুল খালেক (আলতাপোল), আব্দুল বারিক (আলতাপোল), পরশ উল্লাহ (পাজিয়া) প্রমুখ রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়।
রাজাকাররা এ অঞ্চলে ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে পাইলট বালিকা বিদ্যালয় ক্যাম্পে লোকজন ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করত। পাইলট বালিকা বিদ্যালয় ক্যাম্পে ৪৫ জনের মতো মানুষকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। কাওসার আলী (দোরমুটিয়া) ও আবুল হোসেন (কন্দপপুর) রাজাকার ক্যাম্পে জল্লাদের দায়িত্ব পালন করত। এ ক্যাম্পে প্রথম নির্যাতনের শিকার হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী জোনাব আলী (সাদদিয়া)। রাজাকাররা কেশবপুর বাজারের ডা. আশরাফ আলীকে তাঁর ফার্মেসি থেকে ধরে এনে এ ক্যাম্পের একটি কক্ষে আটক রেখে নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে তাঁর বুকের পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে ফেলে এবং ক্ষতবিক্ষত করার পর মৃত ভেবে তাঁকে অদূরে ফেলে দেয়। ডা. আশরাফ আলী তখন বেঁচে গেলেও কখনো আর স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারেননি; বাকী জীবন পঙ্গু হয়ে বেঁচে ছিলেন।
রাজাকাররা জাহানপুর গ্রামের ওমর আলীকে ধরে এনে দীর্ঘদিন তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং একদিন তাদের নির্ধারিত বধ্যভূমি বুড়িভদ্রা নদীর ওপর মঙ্গলকোট ব্রিজে এনে পাজিয়া গ্রামের সুবোধ নাথের সাথে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দুজন নদীতে পড়ে যান। গুলিতে সুবোধ নাথ নিহত হলেও ওমর আলী বেঁচে যান। তিনি ভাসতে ভাসতে এক জেলের জালে আটকা পড়লে জেলে তাকে উদ্ধার করে।
রাজাকাররা বালিকা বিদ্যালয় ক্যাম্পে আনছার আলীকে (পাচরই) টর্চার করে হত্যা করে। পাজিয়া ক্যাম্পের কুবাত রাজাকার স্থানীয় বাসিন্দা পুলিন মণ্ডলকে নির্যাতন করে হত্যা করে। রাজাকার আব্দুল বারী ও ওয়াদুদ সুফলকাঠী গ্রামের ৭ ভাইকে জবাই করে হত্যা করে। এটি সুফলকাঠী গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। এভাবে রাজাকাররা বহু সাধারণ মানুষকে পাইলট বালিকা বিদ্যালয় ক্যাম্পে এনে নির্যাতন শেষে মঙ্গলকোট বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। বগা গ্রামের একই পরিবারের দুটি মেয়েকে রাজাকাররা ধরে এনে এ ক্যাম্পে আটক রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে। ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প দখল করলে তাঁরা ক্যাম্পের বিভিন্ন কক্ষে রক্তের দাগ দেখতে পান। অনেক কক্ষে নির্যাতিতরা গায়ের তাজা রক্তে দেয়ালে নিজেদের নাম লিখে গিয়েছিল বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এ ক্যাম্পের রাজাকারদের নির্যাতন শুরু হলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং অসংখ্য মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। অনেকে নিকটবর্তী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়। চিংড়া বাজার রাজাকার ক্যাম্পেও লোকজন ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। কেশবপুর থানার একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার ছিল এটি। এখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হলে রাজাকাররা বাজারের দোকানপাটসহ এলাকার সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি লুটপাট শুরু করে। তারা বাজারের চাঁদতুল্য গাজীকে ধরে এনে হত্যা করে। এখানে ৫০-৬০ জন রাজাকার অবস্থান করত। তাদের অত্যাচারে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি হয়। মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে থাকে। ত্রিমোহনীতে অবস্থিত রাজাকার ক্যাম্পের নামও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলের মানুষের চলাচলের জন্য ত্রিমোহনী ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ পথ দিয়েই এলাকার মানুষ সহজে ভারতে যাতায়াত করত। এ ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতগামী অনেক শরণার্থী এখানকার রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে এবং নির্যাতনের শিকার হয়।
কেশবপুরের বিভিন্ন গ্রামের বহু বাড়ি-ঘর রাজাকাররা লুটপাট করে। তারা গোবিন্দপুরের চিংড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলামের বাড়ি ৩ বার লুট করার পর অবশেষে পুড়িয়ে দেয়। রাজাকাররা বগা, মহাদেবপুর ও রেজাকাঠী গ্রামের বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
পাইলট বালিকা বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প এবং চিংড়া বাজার রাজাকার ক্যাম্পই ছিল পাকবাহিনী ও রাজাকারদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এছাড়া অন্যান্য ক্যাম্পেও নির্যাতন করা হতো।
বিভিন্ন ক্যাম্পে নির্যাতনের পর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা বন্দিদের মঙ্গলকোট ব্রিজের ওপর এনে গুলি করে বা ছুরি দিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত। মঙ্গলকোট ব্রিজ বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়।
এ উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো যুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি। তবে রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলো হলো- ত্রিমোহনী রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, চিংড়া বাজার রাজাকার ক্যাম্প যুদ্ধ, পাইলট বালিকা বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন এবং কেশবপুর থানা অপারেশন। নভেম্বরের শেষের দিকে কমান্ডার আনিছুর রহমান খানের নেতৃত্বে ৪৪ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ত্রিমোহনী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। অবস্থানগত কারণে কমান্ডার তাঁর বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তিনদিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে টিকতে না পেরে রাজাকার বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় এবং রাজাকার ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
চিংড়া বাজারে জুলাই মাসে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এখানে দুবার (১১ই অক্টোবর ও ৬ই ডিসেম্বর) মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেন, যা চিংড়া রাজাকার ক্যাম্প যুদ্ধ নামে পরিচিত। এতে বেশ কয়েজন রাজাকার নিহত হয় বাকিরা পালিয়ে যায়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও একজন আহত হন।
৬ই ডিসেম্বর রাতে পাইলট বালিকা বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্পে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ক্যাম্পটির ওপর আক্রমণ চালান। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর রাজাকাররা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
৭ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কেশবপুর থানায় অভিযান চালান। কমান্ডার আনিছুর রহমান খান পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা আত্মসমর্পণ করে। থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। অন্যান্য ক্যাম্পের রাজাকাররা ভীত হয়ে ঐদিনই ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং কেশবপুর সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়।
কেশবপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল খালেক (পিতা সোনাই মোড়ল, মঙ্গলকোট; যশোর এম এম কলেজে বিএসসি শ্রেণির ছাত্র এবং একই সঙ্গে মঙ্গলকোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক ছিলেন; উজ্জলপুরে শহীদ) এবং দৌলত বিশ্বাস (পিতা গহর আলী বিশ্বাস, মধ্যকুল; দশম শ্রেণির ছাত্র; পিতা-মাতাকে না বলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান ও ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, চন্ডিপুর যুদ্ধে শহীদ)। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে কেশবপুরে যুদ্ধভাসান ও যুদ্ধজয় নামে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের নামে তাঁর নিজ গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। শহীদ দৌলত বিশ্বাসের নামে তাঁর গ্রামের সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ দৌলত সড়ক। [ইশিতা আকতার মুক্তি]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড