You dont have javascript enabled! Please enable it! যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সারকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতাে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সারকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় কায়সার বাহিনী’ গঠন করে ওই দুই জেলায় যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেয় এই মুসলিম লীগ নেতা। জিয়াউর রহমানের আমলে সে হয়ে যান বিএনপির লােক, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় জাতীয় পার্টির। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর চুয়াত্তর বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় ঘােষণা করেন। সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৬টি অভিযােগের মধ্যে ১৪টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযােগে, যার। মধ্যে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। এই দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে একজন এবং তার গর্ভে জন্ম নেওয়া এক যুদ্ধশিশু এ মামলায় সাক্ষ্যও দিয়েছেন।

ট্রাইব্যুনাল এই প্রথমবারের মতাে অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে কোনাে যুদ্ধাপরাধীকে ফাসির দণ্ডাদেশ দিল বলে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জানিয়েছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, কায়সার একাত্তরে ছিলাে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত সহযােগী । কায়সার বাহিনী’ নামে দল গড়ে সে যেসব যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছে, সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের মানুষ তাকে একজন কুখ্যাত ব্যক্তি হিসাবেই চেনে। কায়সার এতােটাই নগ্নভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিলাে যে নিজের গ্রামের নারীদের ভােগের জন্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি।’ ১৬ নম্বর অভিযােগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন গ্রামে ১০৮ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার ঘটনায় কায়সারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযােগও প্রমাণিত হয়েছে। এ অভিযােগেও তাকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সাজা । ১, ৯, ১৩ ও ১৪ নম্বর অভিযােগে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় কায়সারকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ২ নম্বর অভিযােগে তাকে ১০ বছর, ৭ নম্বর অভিযােগে ৭ বছর এবং ১১ নম্বর অভিযােগে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে দমনের অস্ত্র হিসাবে ধর্ষণের ব্যবহার এবং সেই পাশবিকতার শিকার নারীদের দুর্দশার কথা বার বার এসেছে এই রায়ে । আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের জাতীয় বীর’ অভিহিত করে আদালত বলেছে, “যুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার নারীরা অবশ্যই এ মাটির মহীয়সী মা ও বােন। তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আমাদের গর্ব। নিজেদের সর্বোচ্চ সম্মান বিসর্জন দিয়ে সাহসের সঙ্গে তারাও আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। জাতি তাদের এবং তাদের এ ত্যাগকে স্যালুট জানায়।” বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানাের জন্য সরকার দ্রুত প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করেছে ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন এ রায়কে উৎসর্গ করেছে বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশুদের প্রতি।
বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশু
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের জাতীয় বীর’ অভিহিত করে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তারা আমাদেরই মা, আমাদেরই বােন। আমরা আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানাের জন্য সরকার দ্রুত প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং যারা ইতােমধ্যে মারা গেছেন, তাদের মরণােত্তর সম্মান জানিয়ে স্বজনদের শােক ও দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলেছে আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সমাজ ও জাতিকে আরাে মনে রাখতে হবে যে, বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, মুক্তিযােদ্ধারা পরােক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সমাজ ও জাতির কোনাে স্বীকৃতি ছাড়াই এখনাে সেই আত্মত্যাগের জন্য মানসিক ক্ষত বয়ে চলেছেন বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা। ধর্ষণের শিকার এসব নারীদেরও মুক্তিযােদ্ধার সম্মান দেওয়া উচিৎ, তাদের অব্যক্ত বেদনাকে আর অবহেলা করা যায় না।’ রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানাের জন্য দ্রুত প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আদালত আশা করে। ‘শুধু ধর্ষণের শিকার নারীদের ক্ষত দূর করার জন্য নয়, বরং আমাদের সমাজ ও জাতির ক্ষত সারিয়ে তােলার জন্যও এটি করা প্রয়ােজন। তাই, তাদের মানসিকসামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিস্তৃত ও সুশৃঙ্খল মনােযােগ ও ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছি আমরা।
ডিগবাজ যুদ্ধাপরাধী
হবিগঞ্জের মাধবপুরের ইটাখােলা গ্রামের সৈয়দ সঈদউদ্দিন ও বেগম হামিদা বানুর ছেলে সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সার ওরফে মাে, কায়সার ওরফে সৈয়দ কায়সার ওরফে এসএম কায়সারের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯ জুন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় সে যে তথ্য নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন, তাতে ঢাকার আরমানিটোলা নিউ গভার্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে তার মেট্রিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার কথা বলা হয়েছে। তবে ওই স্কুলে তার পড়ার কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালকে জানানাে হয়। নির্বাচন কমিশনের নথিতে তার শিক্ষাগত যােগ্যতা বলা হয়েছে, সে বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। কয়েকটি শিল্প কারখানাতেও তার মালিকানা রয়েছে। সৈয়দ কায়সারের বাবা সৈয়দ সঈদউদ্দিন ১৯৬২ সালে সিলেট-৭ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএলএ নির্বাচিত হয়।
ওই বছরই মুসলিম লীগের। রাজনীতিতে যুক্ত হন তার ছেলে কায়সার। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কায়সার মুসলিম লীগ সিলেট জেলা কমিটির সদস্য ছিলাে। ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সে পরাজিত হয়। ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় ৫০০ থেকে ৭০০ ‘স্বাধীনতাবিরােধীকে’ নিয়ে কায়সার বাহিনী’ গঠন করে এই মুসলিম লীগ নেতা। সে নিজে ছিলাে ওই বাহিনীর প্রধান। সে যে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার। পক্ষের লােক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দমন অভিযান চালিয়েছিলাে সে। বিষয়টি মামলার রায়েও উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার ঠিক আগে কায়সার পালিয়ে লন্ডনে চলে যায়। দেশে ফেরে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর। জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৮ সালে আবারাে রাজনীতিতে সক্রিয় হয় কায়সার। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভােটে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। পরে বিএনপিতে যােগ দেয় এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হয়। ১৯৮২ সালে সে বিএনপির শাহ আজিজুর রহমান অংশের যুগ্ম মহাসচিবও হয়।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে কায়সার জাতীয় পার্টিতে যােগ | দেয় এবং হবিগঞ্জ শাখার সভাপতির দায়িত্ব পায়। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ৪ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে আবারও দুই দফা সে সংসদ সদস্য। হয়। ওই সময় তাকে কৃষি প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব দেন এরশাদ। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হয় কায়সার। এক পর্যায়ে এরশাদের দল ছেড়ে সে যােগ দেয় পিডিপিতে। কায়সারের বিরুদ্ধে আনা ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৬ নম্বর অভিযােগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযােগে তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের পুলিশ ফাঁড়ি ও ইসলামপুর গ্রামের কাজীবাড়িতে শাহজাহান চেয়ারম্যানকে হত্যা, নায়েব আলী নামের একজনকে জখম ও লুটপাট করে কায়সার ও তার। লােকজন। এ অভিযােগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে কায়সার বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগী বাহিনী বা অক্সিলারি ফোর্স না বললেও ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ বাহিনী ও সৈয়দ কায়সার ভিক্টিম ও অপরাধ সংঘটনস্থল এলাকাগুলাের মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবে। ২০১৩ সালের ১৫ মে কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। ওই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের এই সাবেক নেতাকে।
এরপর তাকে রাজধানীর অ্যাপােলাে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২১ মে পুলিশ কায়সারকে হাসপাতাল থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করলে বিচারক। তাকে কারাগারে পাঠান। আসামিপক্ষের আবেদনে ৪ আগস্ট সৈয়দ কায়সারকে। শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা মনােয়ারা বেগম ২০১২ সালের ২৮ মার্চ থেকে ২০১৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযােগের তদন্ত করেন ।এরপর ১০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে কায়সারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযােগ দাখিল করে প্রসিকিউশন, যাতে যুদ্ধাপরাধের ১৮টি অভিযােগ আনা হয়। এর মধ্যে ১৬টি ঘটনায় অভিযােগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল, যার মধ্যে গণহত্যার একটি হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযােগ ও লুটপাটের ১৩টি এবং ধর্ষণের দুটি অভিযােগ রয়েছে। ৪ মার্চ প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তর সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ প্রসিকিউশনের মােট ৩২ জন সাক্ষী।

সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার