বীর উত্তম কে এম সফিউল্লাহ
কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৩৫) ৩ নং সেক্টর কমান্ডার, ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক ও স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব দ্য স্টাফ। তিনি ১৯৩৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার (বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন) রূপগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী মৌলভী মো. আব্দুল হামিদ এবং মাতা মোসাম্মাৎ রজ্জব বানু। ১৯৫২ সালে মুড়াপাড়া ভিক্টোরিয়া ইংলিশ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৫ সালে হরগঙ্গা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। একই বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভের পর ঐ বছর তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। ১৯৬৮ সালে কোয়েটাস্থ কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি এওয়ার্ড লাভ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি জয়দেবপুরে সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তখন তিনি মেজর। ৭১- এর ২৫শে মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচার হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং তাঁর পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে ময়মনসিংহে অবস্থান গ্রহণ করেন। তখন থেকে শুরু ৯ মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ লড়াই চলে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ঢাকা, কুমিল্লা ও সিলেটের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ৩নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সিমনায়। এ সেক্টরে ২ হাজার ৫শ নিয়মিত বাহিনী প্রায় ২৫ হাজার অনিয়মিত বাহিনীর সদস্য নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠিত ছিল। অক্টোবর মাসে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হলে তিনি এর একটির
প্রধান নিযুক্ত হন, যা তাঁর নামের আদ্যাক্ষর অনুস্মরণে ‘এস’ ফোর্স হিসেবে পরিচিত। দুটি ব্যাটালিয়ন, যথা- ২য় ইস্ট বেঙ্গল ও ১১তম ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে এটি গঠিত ছিল। ‘এস’ ফোর্স গঠিত হওয়ার পর থেকে ক্যাপ্টেন এ এন এম নূরুজ্জামান ৩নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে কে এম সফিউল্লাহ তাঁর ব্রিগেড নিয়ে পাকহানাদেরদের বিরুদ্ধে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাঁর বাহিনী নিয়ে তিনি পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে ৪ঠা ডিসেম্বর আখাউড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তা মুক্ত করা ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে ‘বীর উত্তম’ উপাধীতে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর কে এম সফিউল্লাহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব দ্য স্টাফ নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরপর খন্দকার মোশতাক সরকার তাঁকে ঐ পদ থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর তাঁকে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৯৪ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। -আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী হিসেবে ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরসমূহের কমান্ডারদের নিয়ে গঠিত সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে BANGLADESH AT WAR শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ৩ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম মিসেস সাঈদা আখতার। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: Maj Gen K M Safiullah, BANGLADESH AT WAR, Dhaka, Agamee Prakashani 2005
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড