কেটরাহাট যুদ্ধ (বিরামপুর, দিনাজপুর)
কেটরাহাট যুদ্ধ (বিরামপুর, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ৪ ও ৫ই ডিসেম্বর। এতে ১৩ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা পিছু হটে ঘোড়াঘাটের দিকে পালিয়ে যায়। ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে শহীদ হন।
বিরামপুর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে কেটরাহাটের অবস্থান। উপজেলা সদর থেকে কেটরাহাট যাওয়ার পথে হাটের শেষপ্রান্ত থেকে প্রায় ৪০০ গজ দূরত্বে একটি দিঘির নাম চখাহার দিঘি। দিঘির চতুর্দিকে আবাদি জমি। বিশাল দিঘির চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ পাড়জুড়ে গাছ-গাছালির কারণে দূর থেকে এখন এটিকে জঙ্গলের মতো লাগে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দিঘির চতুর্দিকে উঁচু পাড় বাঁধানো ছিল, যা অনেকটা পাহাড়ের মতো দেখাত। এপ্রিল মাসের মধ্যে পুরো বিরামপুর পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে যাওয়ার পর চখাহার দিঘির বিস্তীর্ণ পাড়জুড়ে তারা ক্যাম্প স্থাপন করে। যুদ্ধের পুরো সময় তারা দিঘির পাড়ে অবস্থান করে। দিঘির চতুর্দিকে ছোট-বড় অনেকগুলো বাংকার স্থাপন করে। ক্যাম্পের মূল অংশ ছিল দিঘির পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা স্থানীয় লোকজন ধরে এনে তাদের দ্বারা জোরপূর্বক ক্যাম্পের এ অংশে বড়বড় বাংকার খনন করিয়ে নেয়। ক্যাম্পের ছোট বাংকারগুলোকে পাহারার কাজে ব্যবহার করা হতো। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা সার্বক্ষণিক অবস্থান নিয়ে অস্ত্র তাক করে থাকত।
চখাহার দিঘির পাড় ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে লোকজনের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালিয়ে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করত। ক্যাম্পে সব সময় ৫০-৬০ জন পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করত। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে-মধ্যেই কেটরাহাটসহ আশপাশের এলাকায় অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদর তটস্থ করে রাখত। দুপক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হতো।
ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে মুক্তিবাহিনী – ও মিত্রবাহিনী – সম্মিলিতভাবে বিরামপুরের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বিরামপুর শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৪ঠা ডিসেম্বর তাঁরা কেটরাহাট সংলগ্ন চখাহার দিঘির পাড়ে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের ওপর দিনভর আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করেন। পাকিস্তানি সেনারাও সুরক্ষিত বাংকারে থেকে পাল্টা জবাব দিতে থাকে। ৫ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী একই সঙ্গে স্থল ও আকাশ পথে চূড়ান্ত অভিযান চালায়। এদিন তীব্র বিমান হামলার মুখে পাকিস্তানি সেনারা বাংকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কেটরাহাট, চখাহার দিঘি, চাকুলগ্রাম, পাটহাট, গোদগাছসহ পুরো জোতবানী ইউনিয়ন ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ-যুদ্ধে ১৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অব্যাহত বিমান ও আর্টিলারি হামলায় টিকতে না পেরে পাকিস্তানি সেনারা ৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে বিরামপুরের দিকে পালাতে শুরু করে। ৬ই ডিসেম্বর তারা বিরামপুর ছেড়ে ঘোড়াঘাটের দিকে পালিয়ে যায়। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড