You dont have javascript enabled! Please enable it!

কেয়ারগাতি যুদ্ধ (আশাশুনি, সাতক্ষীরা)

কেয়ারগাতি যুদ্ধ (আশাশুনি, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ১৬ই আগস্ট। আশাশুনি থানার সন্নিকটস্থ কেয়ারগাতি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। পাইকগাছা ও আশাশুনি এলাকায় অবস্থিত চারটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ, রেজাউল করিম, মতিয়ার রহমান এবং গাজী রফিকুল ইসলাম তাঁদের অধিনায়ক স ম বাবর আলী (বি এল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি এবং পাইকগাছা থানার গজালিয়া গ্রামের সন্তান)-র সঙ্গে যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে মত বিনিময়ের জন্য এ ক্যাম্পে আসেন। যুদ্ধের আগের দিন ১৫ই আগস্ট নৌ কমান্ডোরা মংলা বন্দরে নোঙ্গর করা পাকবাহিনীর ৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। একই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর ও চট্টগাম বন্দরেও অভিযান চালানো হয়, যা অপারেশন জ্যাকপট – নামে বহুল পরিচিত। পাকবাহিনী মনে করেছিল, মংলা বন্দরের আশপাশের মুক্তিযোদ্ধারা একজোট হয়ে বন্দর আক্রমণ করেছে। এ কারণে ১৬ই আগস্ট দুটি গানবোট ও তিনটি লঞ্চযোগে পাকবাহিনী, রাজাকার- ও মিলিশিয়ারা কেয়ারগাতি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে।
কেয়ারগাতি গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মরিচ্চাপ নদীর অপর পাড়ে চাপড়া গ্রামে রাজাকারদের একটি বড় ক্যাম্প ছিল। সাতক্ষীরা সদর থেকে মাত্র আধঘণ্টার দূরত্ব বলে পাকসেনারা প্রায়ই এখানে আসত এবং মাঝেমধ্যে রাতে অবস্থানও করত। ক্যাম্পের রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায়ই গুলি বিনিময় হতো। কিন্তু খরস্রোতা নদী পার হয়ে কেউ কাউকে আক্রমণ করত না। তবে নিরাপত্তার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি বড় গাছে অবজারভেশন পোস্ট স্থাপন করে রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ করতেন। ১৬ই আগস্ট অবজারভেশন পোস্টে দায়িত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আজিজ সানা দেখতে পান খোলপেটুয়া নদী দিয়ে পাকসেনাদের গানবোট ও লঞ্চ কেয়ারগাতির দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি গাছ থেকে নেমে দ্রুত এ খবর পৌছে দেন অধিনায়ক স ম বাবর আলীকে। ক্যাম্প কমান্ডারদের সঙ্গে তিনি তখন আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। হানাদারদের আসার খবর শুনে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন পাকবাহিনীকে নদীতেই প্রতিহত করতে হবে। কিছুতেই তাদের পাড়ে উঠতে দেয়া যাবে না। ক্যাম্পের চারদিকে আগেই তৈরি করা হয়েছিলে ৮-১০টি বাংকার ও পঁচিশটি ট্রেঞ্চ। মুক্তিযোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন এবং বাবর আলী ও চারজন কমান্ডার একেকটি দলের দায়িত্ব নেন।
হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের মধ্যে আসামাত্রই কমান্ডার রেজাউল করিম এলএমজি দিয়ে ফায়ার শুরু করেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্যরাও গুলি বর্ষণ শুরু করেন। পাকসেনারা প্রস্তুতই ছিল। তারাও পাল্টা জবাব দেয়। উভয় পক্ষে বৃষ্টির মতো গুলি বিনিময় চলে। পাকসেনাদের গানবোট পাড়ে ভিড়তে চেষ্টা করে, কিন্তু ভাটা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে বারবার পিছিয়ে যায়। লঞ্চের রাজাকাররাও নামতে চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর গুলি খেয়ে তারা গানবোটের পেছনে আশ্রয় নেয়। পাকসেনারা গানবোট থেকে হেভি শেলিং শুরু করে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে অধিনায়ক বাবর আলী কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন, কারণ নদীতে তখন জোয়ার এসে গেছে এবং এ সুযোগে পাকবাহিনী পাড়ে উঠতে পারলে তাদের প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে গোলাবারুদও ফুরিয়ে আসছে। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেন। অধিনায়কের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ বন্ধ করে হেতালবুনিয়ার কাজলনগর ক্যাম্পে চলে যান। এ সুযোগে পাকবাহিনী পাড়ে উঠে বাংকারে যুদ্ধরত অবস্থায় তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে। অবিরাম গুলির শব্দে তাঁরা অধিনায়কের যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা শুনতে পারেননি। এ তিনজন হলেন হাবিব, কুদ্দুস ও শহীদ। এদিনের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান, আবুল হোসেন, রফিকুল ইসলাম ও আমিনউদ্দিন শহীদ হন।
কেয়ারগাতির যুদ্ধে কেয়ারগাতি ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাসহ দক্ষিণ খুলনার কয়েকটি ক্যাম্পের দু-শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন- অধিনায়ক স ম বাবর আলী, কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ, রেজাউল করিম, মতিয়ার রহমান ও গাজী রফিকুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান, জমাত আলী, সিদ্দিক, মহিউদ্দিন, আজহারুল, সামসু, হাবিব, রফিক, আবদুল কাদের, মোনাজাত, মজিদ, সিরাজুল, বারী, অশোক, আজিজ, হাবিব, কুদ্দুস, শহীদ, সুবল, সোবহান, মনোরঞ্জন, মোক্তার, নাজিমুদ্দিন, মুসা প্রমুখ।
যে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েছিলেন তাঁরা স্বাধীনতার পরে খুলনা জেল থেকে মুক্তি পান। এ-যুদ্ধের পরে রাজাকাররা ভয় পেয়ে যায়। অধিনায়ক স ম বাবর আলীর উপস্থিত বুদ্ধি, যুদ্ধ জয়ের দৃঢ় ইচ্ছা ও নিপুণ রণকৌশলের কাছে পাকবাহিনী সেদিন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়েও পরাস্ত হয়। কেয়ারগাতির যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকা চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্য অর্জনে তাঁদের আরো উদ্বুদ্ধ করে। [জহুরুল আলম সিদ্দিকী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!