মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জেলা কুষ্টিয়া। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির লীলাভূমি কুষ্টিয়া সাংস্কৃতিক রাজধানী এবং মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার হিসেব পরিচিত। এ জেলার মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কুষ্টিয়া জেলার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর সারাদেশের ন্যায় কুষ্টিয়ার মুক্তিপাগল জনতা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। ১৩ই মার্চ কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মাঠে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন কুষ্টিয়া জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও জেলা – ছাত্রলীগ-এর সভাপতি আব্দুল জলিল। স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ করেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হাদী। এ সময় মারফত আলী, আব্দুল মোমেন ও শামসুল হাদীর নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা’ বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসকে চ্যালেঞ্জ করে ইউনাইটেড হাইস্কুল মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন এবং কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে। অনুষ্ঠানে গোলাম কিবরিয়া এমপিএ ও আব্দুর রউফ চৌধুরী জয় বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এডভোকেট এম এ বারী, কুচকাওয়াজ পরিচালনা করেন ছাত্রনেতা মারফত আলী, ছাত্রলীগের পতাকা এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন যথাক্রমে ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল জলিল ও সাধারণ সম্পাদক সামসুল হাদী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট আমজাদ হোসেন, নূর আলম জিকু, মিজানুর রহমান মজনু, আক্কাস আলী মঞ্জু, আবদুল হান্নান, জাফরী, মধু, শেখ দলিল, হেলাল প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়ার প্রতিটি গ্রামে জয় বাংলা বাহিনী গঠিত হয়। এছাড়া স্থানীয়ভাবে হামিদ বাহিনী ও মোকাদ্দেস বাহিনী বিভিন্ন সময়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করতে বিশেষ অবদান রাখে।
৩রা এপ্রিল আজিজুর রহমান আক্কাস এমএনএ-এর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সভায় এডভোকেট আহসানুল্লাহ এমপিএ-কে আহ্বায়ক করে কুষ্টিয়া স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। উক্ত কমিটির অন্যতম সদস্য এ এম মজিদকে আহ্বায়ক করে আব্দুর রউফ চৌধুরী এমপিএ, আব্দুল জলিল, শামসুল হাদীসহ ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সহোযোগিতায় কুষ্টিয়া ডাকবাংলোতে শান্তি-শৃঙ্খলা ও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
দুর্গম ও নিরাপদ এলাকা হিসেবে বংশীতলায় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও চেয়ারম্যান ছলিম উদ্দীন বিশ্বাস বংশীতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতেন। মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হাদী ও শামসুল হুদার নেতৃত্বে গোস্বামী দুর্গাপুর গ্রামের আড়পাড়া কুঠিবাড়ি (বিশ্বনাথ গোস্বামীর বাড়ি) এবং বামনগ্রাম ঠাকুরবাড়ি (নিতাই চক্রবর্তীর বাড়ি)-তে যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। নির্জন গ্রামের ভেতর বিশাল বাড়িদুটি ফাঁকা পড়ে থাকায় সেখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। কুষ্টিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম পরিচালনায় কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ায় অবস্থিত আব্দুর রউফ চৌধুরীর বাড়িটি এখানকার স্বাধীনতা যুদ্ধের হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আব্দুর রউফ চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতা মাঙ্গন মিয়াসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধের জন্য তরুণদের সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন।
১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা স্বাধীন বাংলা কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হয়। এর সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন খন্দকার শামসুল আলম দুদু। এর লেখা প্রস্তুত করতেন লিয়াকত আলী, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, শফিউর রহমান মন্টু প্রমুখ। পত্রিকাটির মূল্য ছিল ১০ পয়সা। কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ রনী রহমানের নামে শহীদ রনী প্রেস থেকে এটি ছাপা হতো। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। কুষ্টিয়া জেলায় মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে আজিজুর রহমান আক্কাস এমএনএ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এমএনএ ও প্রধানমন্ত্রীর পিএস, আব্দুর রউফ চৌধুরী এমপিএ, ব্যারিস্টার বাদল রশিদ এমএনএ (অফিসার লিয়াজোঁ মুক্তিযুদ্ধ), মোহাম্মদ শহীদউদ্দিন আহম্মদ এমএনএ, আহসান উল্লাহ এমপিএ, গোলাম কিবরিয়া এমপিএ, মো. নূরুল হক এমপিএ, এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ, কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক শামসুল হক, তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী (এসডিও, মেহেরপুর), ডা. আসাবুল হক এমপিএ (মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকার- পরিচালিত বাংলাদেশ রেডক্রসের চেয়ারম্যান), গোলাম কিবরিয়া, মির্জা জিয়াউল বারী নোমান, এডভোকেট শামসুল আলম দুদু, আব্দুল হামিদ রায়হান, এডভোকেট আব্দুল জলিল, এডভোকেট আক্তারুজ্জামান মাসুম, আব্দুল মোমিন, মোহন মিয়া, এডভোকেট শামসুল হুদা, নাসিম উদ্দিন, শামসুল হাদী, খন্দকার সাজেদুর রহমান বাবলু, মিনহাজুর রহমান আলো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কুষ্টিয়া অঞ্চল ৮নং সেক্টরের অধীন ছিল। প্রথমে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। পরবর্তীতে মেজর এম এ মঞ্জুর এ সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে এ অঞ্চলকে দক্ষিণ-পশ্চিম জোনাল কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর রউফ চৌধুরী এমপিএ।
কুষ্টিয়া জেলায় এফএফ কমান্ডার ছিলেন রাশেদুল আলম আনিস। সদর উপজেলায় এফএফ গ্রুপের ১৪ জন কমান্ডার হলেন- নওশের আলী, সামসুল হাদী, আশরাফ উদ্দিন আনারুল, মো. আবদুর রাজ্জাক, নাসির উদ্দিন, হুসাইনুল বাহার, সৈয়দ বাহাউদ্দিন, বদর উদ্দিন বদু, আবদুল হক, ফজলুল হক, শরিফুল ইসলাম মাস্টার, খোকন মাস্টার, শহীদুল ইসলাম রতন, মো. খায়ের উদ্দিন। কুষ্টিয়া জেলায় বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন মির্জা জিয়াউল বারী নোমান। সদর উপজেলায় উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিএলএফ কমান্ডাররা হলেন— আবুল কাশেম, আবদুল মান্নান, আবদুল হামিদ, নূর মোহাম্মদ জাপান, শামসুল হুদা।
মুক্তিযুদ্ধকালে কুষ্টিয়ায় মরফত আলী, আব্দুল মোমেন ও শামসুল হাদীর নেতৃত্বে জয় বাংলা বাহিনী গঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়ার প্রতিটি গ্রামে জয় বাংলা বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে হামিদ বাহিনী ও মোকাদ্দেস বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করতে ভূমিকা পালন করে।
২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকা দখলে নেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কুষ্টিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬শে মার্চ সারাদেশের ন্যায় কুষ্টিয়াতেও কারফিউ জারি করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আব্দুর রউফ চৌধুরী এমপিএ-র বাসায় বৈঠক করছিলেন। এমন সময় রাত ৮টার দিকে ঝিনাইদহ থেকে টেলিফোনে আব্দুর রউফ চৌধুরীকে জানানো হয় যে, যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝিনাইদহ অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমন সংবাদ পেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে ঐ সভা থেকে নেতা-কর্মীদের করণীয় এবং তাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়। রাতেই আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম মোস্তফা ফটিক (চৌড়হাস) স্টেডিয়ামের সামনে গাছপালা কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দেন। জেলা ছাত্রলীগের নেতা- কর্মীরা সভাপতি আব্দুল জলিল ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হাদীর নেতৃত্বে রাতে কাউফিউ ভেঙে ছাত্র- জনতাকে সঙ্গে নিয়ে মজমপুর গেট, থানা মোড়, কেয়া সিনেমা (বর্তমান পরিমল টাওয়ার) হলের সামনে, আমলাপাড়া মোড় এবং বড় বাজার রেলগেটে বড়বড় গাছের গুঁড়ি ও ইটের ব্যারিকেড তৈরি করেন। ২৭ বালুচ রেজিমেন্টর ডেল্টা কোম্পানি কমান্ডার মেজর শোয়েব বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা নিয়ে সকল ব্যারিকেড সরিয়ে অপারেশন সার্চলাইট-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী কুষ্টিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। তারা জেলা স্কুল, পুলিশ লাইন্স, সদর থানা এবং ওয়ারলেস অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকসেনা কনভয় সারা শহর দাপিয়ে বেড়ায় এবং প্রতিটি ওলি-গলিতে তাদের টহল চলতে থাকে। এ-সময় কিশোর দেওয়ান মিজানুর রহমান রনী (পিতা দেওয়ান মোস্তাফিজুর রহমান, পাপলপাড়া, রংপুর) এন এস রোডে নিজামতুল্লাহ সংসদ (বর্তমানে নুরুল ইসলাম মার্কেট)-এর ছাদে উঠে পাকহানাদার বাহিনীর ওপর বোমা নিক্ষেপ কালে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন। কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে গোলাম কিবরিয়া, রেজাউল করিম হান্নান, দৌলতপুরের আজিজুর রহমান আক্কাস, ভেড়ামারার জহুরুল হক রাজা মিয়া, কুষ্টিয়ার ব্যারিস্টার এম আমীর- উল-ইসলাম, খন্দকার শামসুল আলম দুদু, আনোয়ার আলী, খন্দকার রশীদুজ্জামান দুদু, ছাত্রনেতা আব্দুল জলিলসহ হাজারো ছাত্র-জনতা বাঁশের লাঠিহাতে কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করতে এগিয়ে আসে। ইতোমধ্যে জেলার এমএনএ ও এমপিএ-দের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে ওঠে। নেতৃবৃন্দ কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান, সংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সম্ভাব্য আক্রমণের একটি নকশা তৈরি করে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও দৌলতপুর ইপিআর অফিসে যোগাযোগ করেন। চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ২৬শে মার্চ স্থানীয় রাজনীতিবিদ, পুলিশ কর্মকর্তা ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেন। ২৭শে মার্চ ইপিআর ও জনতার সম্মিলিত বাহিনী একই সঙ্গে তিনদিক থেকে আক্রমণ করে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাস্ত করে কুষ্টিয়া শহর দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর দায়িত্ব ছিল সরাসরি পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করা। জনগণের দায়িত্ব ছিল আক্রমণের সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে দেয়া। এ-যুদ্ধে ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর ৫টি কোম্পানিকে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। ২৮শে মার্চ চুয়াডাঙ্গায় সকল কোম্পানি কমান্ডারের উপস্থিতিতে ‘এ’ কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার মোজাফ্ফরকে পুলিশ লাইন্স আক্রমণ, ‘বি’ কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার খায়রুল বাসার খানকে ওয়ারলেস স্টেশন আক্রমণ, কোম্পানির ব্যাটালিয়ন উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীকে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল আক্রমণ, ‘ডি’ কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার মজিদ মোল্লাকে কোর্ট চাঁদপুর, কালিগঞ্জ ও দত্তনগরে শত্রুর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দলের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করা এবং ‘ই’ কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার রাজ্জাককে উইং সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গার দায়িত্ব দেয়া হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানি সৈন্য ঝিনাইদহ ও অপর এক কোম্পানি সৈন্য পোড়াদহ স্টেশনে অবস্থান নেয়। ২৯শে মার্চ আক্রমণের পূর্ব নির্ধারিত সময় থাকলেও সুবেদার মোজাফ্ফরের গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অপারেশনের সময় একদিন পিছিয়ে ৩০শে মার্চ ভোররাতে নির্ধারণ করা হয়। এদিন ভোররাত ৪টায় তিনদিক থেকে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে আক্রমণ শুরু হয়। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী হাজার-হাজার জনতার জয় বাংলা স্লোগানে পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। ৩০শে মার্চ দুপুরের মধ্যে জেলা স্কুল ছাড়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অবস্থানকৃত পুলিশ লাইন্স, ওয়ারলেস, সদর থানা ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। এ- সময় পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাস থেকে আরো সৈন্য ও গোলাবারুদ চাইলে যশোর সেনানিবাসের উত্তর ছিল নেতিবাচক ও নিজেদের প্রচেষ্টায় টিকে থাকার পরামর্শ। ৩০শে মার্চ দুপুরের পর থেকে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে মাঝে-মাঝে ফায়ার করতে থাকেন ইপিআরসহ মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তান বাহিনীর বেঁচে থাকা ৬০-৭০ জন সদস্য ৩১শে মার্চ ভোররাতে একটি জিপ ও দুটি ট্রাকযোগে জেলা স্কুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে জেলা স্কুল গেইট থেকে বের হওয়ামাত্র ইপিআর-এর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এবং একটি জিপ জেলা স্কুলের বিপরীত দিকে রাস্তার পশ্চিম পাড়ে বাহাউদ্দিনের বাড়ির নিচের দোকান ঘর ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এখানে পাকিস্তানি মেজর শোয়েবসহ কয়েকজন নিহত হয়। অপর দুটি ট্রাক গুলি ছুড়তে-ছুড়তে পালানোর সময় বিত্তিপাড়ার কাছে একটি বিকল হয়ে যায়। কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা পলায়নরত অবস্থায় হাতিয়া এলাকায় কয়েকজন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। পরে ইপিআর ও স্থানীয় জনগণের হাতে তারা নিহত হয়। গাড়াগঞ্জ ব্রিজে পূর্ব থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে পরে পাকিস্তানি সেনাদের একটি গাড়ি ব্রিজের নিচে পড়ে যায়। এতে পাকহানাদার বাহিনীর বেশকিছু সৈন্য নিহত হয়। কয়েকজন সৈন্য গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলে ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহ শাহ্-সহ তারা জনগণের হাতে ধরা পড়ে। অপর একটি গ্রুপ মিরপুর এলাকার মশান বলিদাপাড়া হয়ে কামারপাড়া গোড়দা প্রবেশ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন, আব্দুর রশিদ হীলম্যান ও মনিরুজ্জামান শহীদ হন। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা যোগ দিলে উভয়ের মধ্যে গুলি বিনিময়কালে ৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১লা এপ্রিল সকাল ১১টার মধ্যে কুষ্টিয়া জেলা পাকহানাদারমুক্ত হয়। কুষ্টিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে পাকসেনাদের বেশকিছু অস্ত্র ও গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ৩রা এপ্রিল লন্ডন টাইমস-এ কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় ফলাও করে ছাপা হয়।
সড়ক ও রেলপথে আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে পাকহানাদার বাহিনী আকাশপথে কুষ্টিয়া আক্রমণ করে। ১১ই এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বহর কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর ওপর হামলা করলে তাতে বহু বাঙালি মৃত্যুবরণ করে। ১২ই এপ্রিল পুনরায় বিমান হামলা হলে মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা গুলিবর্ষণে একটি পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান জেলখানার ওপর বিধ্বস্ত হয়। ১৫ই এপ্রিল বিমান বহরের কভারে পাকসেনাদের পদাতিক বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিশাখালী পর্যন্ত পৌঁছে। আরেক পদাতিক বাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নগরবাড়ি ঘাট পার হয়ে পাকশি ব্রিজের অপর পাড়ে এসে অবস্থান নেয়। উভয় স্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকসেনাদের অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান হামলা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। তারা বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে এবং শতশত বেসামরিক লোককে হত্যা করে কুষ্টিয়া দখল করে। কুষ্টিয়ায় অনুপ্রবেশ করে তারা পুলিশ লাইন্স, জেলা স্কুল, টেলিগ্রাফ অফিস, থানা ও আড়ুয়াপাড়া ওয়ারলেস অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এডভোকেট সাদ আহমেদের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। সদর উপজেলায় মাজিলার আব্দুল করিম ও জোয়াদ আলী কুখ্যাত রাজাকার ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি লুট, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণ ও নির্যাতনসহ ব্যাপক অত্যাচার চালায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত গোপন তথ্য পাকবাহিনীর কাছে পাচার করত এবং পাকবাহিনীকে হত্যাযজ্ঞে উৎসাহিত করত।
১৬ থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা কুষ্টিয়া জেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। তারা শুধুমাত্র কুষ্টিয়া শহর থেকেই প্রায় চল্লিশ কোটি টাকার সম্পদ লুট করে। মে মাসে বিশ্ব ব্যাংকের এক রিপোর্টে কুষ্টিয়া সম্পর্কে বলা হয়, শহরের প্রায় ৯০ ভাগ বাড়ি, দোকান, ব্যাংক প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
জুলাই মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী কোহিনুর কোম্পানি গণহত্যা সংঘটিত করে। এ গণহত্যায় কোহিনুর কোম্পানির মালিক ও তাঁর পরিবারের ১৮ জন সদস্য শহীদ হন। ৭ই সেপ্টেম্বর পাকহানাদার বাহিনী দুর্বাচারা এলাকায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধর্ষণ চালায় এবং দুজনকে হত্যা করে। ৬ই ডিসেম্বর বিত্তিপাড়া আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্প এবং হরিনারায়ণপুর ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার বাহিনী এবং কুষ্টিয়া থেকে মিলিশিয়া বাহিনী একত্রিত হয়ে ধলনগর এলাকার হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে গরু, ছাগল ও কৃষকের ফসল লুটপাট করে।
পাকিস্তানি বাহিনী ১৭ই এপ্রিল নির্মম নির্যাতন করে পৌরসভার চেয়ারম্যান আবুল কাশেমকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তারা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইন্তাজ আলী এবং তাঁর পুত্র, আনছার আলী, ঠিকাদার হাসান ফয়েজ, পিয়ার টেক্সটাইলের মালিক শামসুদ্দিন আহমেদ, তাঁর মাতা ও ভগ্নিপতিকে হত্যা করে। তারা ব্যবসায়ী রফিক আহমদ, হাজী ফকির আহমেদ, ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক দুর্গাদাস সাহা, এডভোকেট আবদুল গণি, ফুটবলার সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক বুড়ো, ওবাইদুর রহিম বুলু, কমলাপুরের নবীন প্রামাণিক ও তার দুই পুত্র, টিকোপাড়ার আতিয়ার রহমান, আড়য়াপাড়ার সবুর, আতিয়ার শাহজাহান, আলতাফ আলী, আফতাব উদ্দিন, আবদুল গণি, রমজান আলী মণ্ডল ও তার দুই পুত্র আলতাফ ও মোফাজ্জেল, আবদুল (পিতা দীন মোহাম্মদ), শেখ জামাল উদ্দীন, আব্দুল মোমেন (পিতা আব্দুল করিম, কোর্টপাড়া), আনসার আলী (পিতা আজগর আলী, চাপাইগাছি) প্রমুখ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের হরিনারায়ণপুর ক্যাম্প হত্যা, নারীনির্যাতন ও টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করত। এছাড়া বিত্তিপাড়া ক্যাম্প, রাজারহাটের কোহিনুর ভিলা, কুষ্টিয়ার পৌর এলাকার হাউজিং-এর হলুদ ঘর ছিল তাদের বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। কুষ্টিয়া সদরের মোহিনী মিলস এবং শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের ঘর-বাড়িও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ-সকল নির্যাতনকেন্দ্রে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও নারীদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, -আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা সমগ্র কুষ্টিয়াকে মৃত্যু উপত্যাকায় পরিণত করেছিল। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার প্রতিটি প্রান্তর পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। সদর উপজেলায় ১১টি গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে। উজান গ্রাম ইউনিয়নের বিত্তিপাড়া বধ্যভূমি ও কুষ্টিয়া পৌরসভার রেনউইক এন্ড যজ্ঞেশ্বর কোম্পানি সংলগ্ন গড়াই নদীর পাড়ের বধ্যভূমি এ দুটি বৃহৎ বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এছাড়া আব্দালপুর ইউনিয়নের কুমার নদীর পাড়, পৌর এলাকার হাউজিং-এ হলুদ ঘর, আমলাপাড়ার পূর্ণ বাবুর ঘাট, বড় বাজার গড়াই নদীর ঘাট, রাজাহাটের কোহিনুর ভিলা, বড় স্টেশনের উভয় পাশের গড়াই নদীর পাড়, কুওয়াতুল ইসলাম আলিয়া মাদ্রাসার গেট, কুষ্টিয়া মিল লাইনের পেছনে কালীগঙ্গা নদীর পাড় এবং ঝাউদিয়া ইউনিয়নের হাতিয়া বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। প্রতিটি বধ্যভূমি এলাকায় গণকবর রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালে কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সদর উপজেলায় ১১টির মধ্যে ৬টি যুদ্ধ হয়েছে পৌরসভা এলাকায়। এর মধ্যে কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধ, বংশীতলা যুদ্ধ, আড়পাড়া যুদ্ধ, পিয়ারপুর যুদ্ধ, কুশলীবাসা-করিমপুর-ধলনগর-প্রতাপপুর যুদ্ধ ও আলামপুর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। কুষ্টিয়া শহর থেকে ১১ কিমি দূরে অবস্থিত বংশীতলা গ্রামে ৫ই সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। দুর্গম এলাকা হিসেবে এ গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বংশীতলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন জেলা বিএলএফ কমান্ডার মির্জা জিয়াউল বারী নোমান, ডেপুটি কমান্ডার জাহিদ হোসেন জাফর, আবুল কাশেম, মাহাবুব আলী (গেরিলা) গ্রুপ, সামসুজ্জোহা, নুর মহম্মদ জাপান ও আব্দুল হামিদ গ্রুপ। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন জামিলসহ ৫০ জনেরও অধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এদের মধ্যে ১৪ জনের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- সদর থানার তাজুল ইসলাম, দিদার আলী, খোরশেদ আলম দিল, আব্দুর রাজ্জাক, ইয়াকুব আলী, মিরাজুল ইসলাম, সুরুজ লাল, মেজবার আলী, চাঁদ আলী, মোবারক আলী, সাবান আলী, কিয়াম উদ্দিন, আবু দাউদ ও কুমারখালীর মান্নান। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও চেয়ারম্যান ছলিমউদ্দিন বিশ্বাসের বাড়িসহ হিন্দু এলাকা সম্পূর্ণ আগুনে পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজনের লাশ দুর্বাচারা স্কুল প্রাঙ্গণে, কয়েকজনের লাশ মোল্লাতেঘরিয়া এলাকায় এবং খোরশেদ আলম দিলের লাশ তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ-যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দুর্বাচারা আসেন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার গোস্বামী দুর্গাপুর ইউনিয়নে আড়পাড়া গ্রামে ২৭শে নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধ নাটনা-করিমপুর-আড়পাড়া যুদ্ধ নামেও পরিচিত। ২৬শে নভেম্বর উপজেলার মাজিলার আব্দুল করিম ও জোয়াদ আলী নামে দুই কুখ্যাত রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেন। এ খবরে বেসামাল হয়ে হালসা ও বিত্তিপাড়া পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের সদস্য ও মিলিশিয়ারা ২৭শে নভেম্বর আড়পাড়া গ্রাম আক্রমণ করে। তাদের মোকাবেলায় তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারাও জবাব দেন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হাদী (কুষ্টিয়া সদর), শামসুল হুদা (কুষ্টিয়া সদর), খায়রুদ্দিন (পাটিকাবাড়ি, কুষ্টিয়া), সদর উদ্দিন (পিতা সাইদুর রহমান, খাজুরিয়া, ঝিনাইদহ) ও আবদার (শ্রীপুর, হরিণাকুণ্ডু, ঝিনাইদহ) গ্রুপ এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা সদর উদ্দিন ও তাজউদ্দিন (পিতা আফজাল মণ্ডল, চোরাইকোল, ঝিনাইদহ) শহীদ হন। এই দুই শহীদকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মনোহরদিয়া ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামে সমাহিত করা হয়। এছাড়াও জাহিদ হোসেন নামের একজন নিরীহ পথচারী শহীদ হন। আড়পাড়া গ্রামে তাঁর কবর রয়েছে।কুষ্টিয়া জেলার এক নিভৃত গ্রাম পিয়ারপুরে ২৭শে সেপ্টেম্বর রাতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকহানাদার বাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক, আবুল কালাম, জহুরুল হক ও কৃষ্ণ রায় শহীদ হন। এছাড়া এ-যুদ্ধে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকহানাদার ও রাজাকার বাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং পরে তাঁদের বিত্তিপাড়া বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়।
কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার কুশলীবাসা, করিমপুর, ধলনগর ও প্রতাপপুর গ্রামে ৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা জাহিদ হোসেন জাফর, বদরুল ইসলাম বদর, মোকাদ্দেস হোসেন, আব্দুল হামিদ, নূর মহম্মদ জাপান, সামসুজ্জোহা, শহিদুল ইসলাম আন্টু ও আশরাফুল আলম গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম ও মহব্বত হোসেন খেড়ো শহীদ হন এবং পাকিস্তানি সেনাসদস্য, মিলিশিয়া ও রাজাকারসহ মোট ১১ জন নিহত হয়।
৪ঠা সেপ্টেম্বর আলামপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরাস্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে এ-যুদ্ধে আমিরুল ইসলাম, শফিউল ইসলাম জিল্লু, তাইজাল আলী খান, গৌচ, রেজা, খুররম, এডভোকেট বাকী, মানিক ঘোষ, পলাশ স্যানাল প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মরণ কামড় দেয়ার জন্য সদর উপজেলার দক্ষিণে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়কের জিকে ক্যানেলের ব্রিজের ওপর অবস্থান নেয়। ৮ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী- এবং পাকবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষের অনেকে হতাহত হয়। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র জেলা ঘিরে ফেলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকবাহিনী পালিয়ে যেতে থাকে। ১০ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ ইউনিট ভেড়ামারা হয়ে পাকশির দিকে চলে যায়। ১১ই ডিসেম্বর কুষ্টিয়া হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শেখ দিদার আলী, বীর প্রতীক (পিতা শেখ নুরুল ইসলাম, আড়ুয়াপাড়া), আবদুল আলীম, বীর প্রতীক (পিতা আবদুল জলিল বিশ্বাস, শাহাপুর, আব্দালপুর)।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শেখ দিদার আলী, বীর প্রতীক (বংশীতলা যুদ্ধে শহীদ), আবদুল মান্নান (পিতা মো. কফিলউদ্দিন বিশ্বাস, পূর্ব আব্দালপুর), মো. আবদুল হাই মিয়া (পিতা মো. মোকাররম হোসেন, লক্ষ্মীপুর), মো. কামাল উদ্দিন (পিতা মো. রাহেন আলী, খেজুরতলা), মীর সাইফউদ্দিন (পিতা মীর সামসউদ্দিন, থানাপাড়া), মো. ফজলুর রহমান (পিতা মো. আব্দুল ওয়াহেদ শেখ, মৃত্তিকাপাড়া), রওশন আলী (পিতা খোদাবক্স, খেজুরতলা), মো. তাজউদ্দিন (পিতা মো. আবদুল করিম শেখ, দুর্বাচারা), মো. শহিদুল ইসলাম (পিতা মো. ছলিম উদ্দিন, দুর্বাচারা), মো. আবু দাউদ (পিতা মো. ইয়াদ আলী, মিলপাড়া), মো. খোরশেদ আলম (পিতা সাদ আহমেদ, গোপালপুর), মো. সাইদুল ইসলাম (পিতা মো. নেহাল উদ্দিন, শিবপুর), ফ্লাইট লে. মো. মকবুল (পিতা আলহাজ্ব মো. হোসেন, থানাপাড়া), গোলাম মোস্তফা (পিতা মোহাম্মদ আলী শেখ, আড়ুয়াপাড়া), রুস্তম মালিথা (পিতা শুকুর আলী মালিথা, যুগিয়া), আবুল হোসেন (পিতা মো. বাবর আলী, আড়য়াপাড়া), নবদ্বীপ চন্দ্র শর্মা (পিতা অরামশ চন্দ্র শর্মা, উত্তর লাহিনী), মো. মকবুল শেখ (পিতা জসিমউদ্দিন, সোনাডাঙ্গা), জালাল উদ্দিন (পিতা কমল উদ্দিন মিয়া, বটতৈল), আসুরন কুমার নাথ (পিতা কুঞ্জ বিহারী নাথ, মিললাইন), গোলাম মোস্তফা (পিতা মহা. পরশ উল্লাহ, বটতৈল), খোন্দকার সুলতান আহম্মেদ (পিতা খোন্দকার রেজাউল, বটতৈল), ওমর আলী (পিতা এতিম বক্স খলিফা, গোরস্থানপাড়া), নওশের আলী (পিতা খন্দকার রাহেন আলী, খেজুরতলা), মহাম্মদ আলী মণ্ডল (পিতা চিনিরউদ্দিন মণ্ডল, হরিশংকরপুর), গেদন আলী মালিথা (পিতা তকি মালিথা, যুগিয়া), কোরবান আলী (পিতা সমশের আলী মণ্ডল, হারুলিয়া), আরুন আলী (পিতা আবদুর রহিম, কালীশংকরপুর), কেচমত আলী শেখ (পিতা মঙ্গল শেখ, মৃত্তিকাপাড়া), মহা. আফছার (পিতা নবাই সরদার, মাঠপাড়া), তজাম্মেল হক (পিতা মো. মল্লিক শেখ, হাউজিং এস্টেট), মো. লতিফ (পিতা আ. ছত্তার মিয়া, হারনারায়ণপুর), লিয়াকত আলী (পিতা ইয়াছিন আলী, আড়ুয়াপাড়া), রুস্তম আলী (পিতা মো. শুকুর আলী, লাহিনী), মেজবার রহমান (পিতা বাছের মোল্লা, মোল্লাতেঘরিয়া), ইয়াকুব আলী (আড়ুয়াপাড়া), মিরাজ (পিতা মফিজউদ্দিন, মোল্লাতেঘরিয়া), এবং ছরোয়ার (পিতা মকবুল ফকির, মোল্লাতেঘরিয়া)।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহম্মদ জাপান, শহিদুর ইসলাম, নাসির উদ্দিন মৃধা, আবুল কালাম আজাদ, জয়নাল আবেদিন, আ ক ম আজাদ (পিতা মো. শামছুদ্দিন, পিয়ারপুর), শফিউল ইসলাম জিল্লু (পিতা আমিরুল ইসলাম, কেনী রোড), মতিয়ার রহমান (মনোহরদিয়া), ফিরোজ আহম্মেদ (কুষ্টিয়া আমলাপাড়া), হাবিবুর রহমান শেরকান্দি (কুমারখালী), আব্দুল কুদ্দুস (মঙ্গলবাড়ীয়া), আব্দুল খালেক (হাটস হরিপুর) প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে কুষ্টিয়ায় নামসহ কেন্দ্রীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ, পিয়ারপুর যুদ্ধে শহীদদের নামসহ সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, বংশীতলার মোড়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামসহ স্মৃতিস্তম্ভ ‘রক্তঋণ-১’ এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে কুশলীবাসা-করিমপুর-ধলনগর-প্রতাপপুর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। পৌরসভার আড়য়াপাড়ার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর প্রতীক দিদার আলী সড়ক। [মোহা. রোকনুজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড