You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.13 | কৃষ্ণনগর যুদ্ধ (বীরগঞ্জ, দিনাজপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

কৃষ্ণনগর যুদ্ধ (বীরগঞ্জ, দিনাজপুর)

কৃষ্ণনগর যুদ্ধ (বীরগঞ্জ, দিনাজপুর) সংঘটিত হয় ১৩ই ডিসেম্বর। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়, কয়েকজন ধরা পড়ে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।
বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম কৃষ্ণনগর। গ্রামটি আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। পূর্ব তীরে খানসামা গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমার্ধে খানসামা উপজেলা পাকিস্তানি সেনাদের দখলে আসার পর তারা খানসামা হাই স্কুল মাঠ থেকে কৃষ্ণনগরের দিকে গুলি ও বোমা বর্ষণ করে। এতে নদীর পশ্চিম তীরের গোবিন্দপুরের বাসিন্দা আমিনুর রহমান নামে একজন কলেজ ছাত্র ও যদু মার্ডি নামে এক সাঁওতাল যুবক মারা যায়। যদু মার্ডি আত্রাই নদী সংলগ্ন ওয়াপদা ভবনের কাছে মাছ শিকার করছিল। এ- সময় অকস্মাৎ বোমা হামলার শিকার হয়। আমিনুর মারা যায় কৃষি কাজ করতে গিয়ে। এ-সময় বাঙালি ইপিআর-সহ মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলি বর্ষণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে সরে গিয়ে বীরগঞ্জের দিকে চলে যান। এ ঘটনার পর কৃষ্ণনগর ও তৎসংলগ্ন গ্রামসমূহের লোকজন মিরাটঙ্গি নামক এলাকায় পালিয়ে যায় এবং সেখান থেকে ভারতে চলে যায়। তিন মাস পর পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হলে বয়স্ক লোকেরা বাড়ি পাহারা ও জমি চাষের জন্য ফিরে আসেন এবং নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত বিজয়ের মুখে পাকিস্তানি সেনারা ঠাকুরগাঁও থেকে বীরগঞ্জে পিছিয়ে আসে। বীরগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি গ্রুপ দশমাইলের দিকে, আরেকটি গ্রুপ খানসামার দিকে পালিয়ে যায়। খানসামামুখি গ্রুপটি ১১ই ডিসেম্বর একাধিক ট্যাংক, জিপ ও ১০-১২টি মোষের গাড়িযোগে পালানোর সময় ১০নং মোহনপুর ইউনিয়নের কল্যাণী, চৌধুরীহাট, কৃষ্ণনগর, মোহনপুর, আরাজী গোবিন্দপুর, কাশিপুর, সেনপাড়া ও করিমপুর পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরে গোবিন্দপুরে ৮ জন লোককে হত্যা করে। এদিকে মুক্তিবাহিনী স্থানীয়দের সহযোগিতায় কৃষ্ণনগরে অবস্থিত ৬ কিলোমিটার ওয়াপদা সেচ ক্যানেলের দুই কিলোমিটার অংশের দক্ষিণ প্রান্তে ২ শতাধিক বাংকার খনন করে সেগুলোতে অবস্থান গ্রহণ করে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (দাড়িয়াপুর), নজরুল ইসলাম (দাড়িয়াপুর), স্থানীয় যুবক রমজান আলীসহ প্রায় অর্ধশত যুবক এসব বাংকার খনন করেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কৃষ্ণনগরের ১০-১২ জায়গায় আহারের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন শুরু করেন। ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনী পেছন থেকে তাদের সাপোর্ট দেয়।
১৩ই ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে ওয়াপদা ক্যানেলের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন বাংকার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাটপার ও খানসামার আলোকঝারির দিকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প বরাবর গোলা ছোড়েন। পাকিস্তানি সেনারাও কামান দ্বারা জবাব দেয়। রাত ১০টায় শুরু হয়ে ভোর ৫টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় আর্টিলারি সাপোর্ট নিয়ে এগিয়ে যায়। ভারতীয় বিমান থেকেও পাকিস্তানি ক্যাম্পগুলোতে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করা হয়। বিমান হামলার সময় পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষ থেকে কোনো জবাব দেয়া হয়নি। পাকিস্তানি সেনারা ভোর হওয়ার আগেই তাদের ক্যাম্পগুলো ছেড়ে নীলফামারী ও সৈয়দপুরের দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী বীরগঞ্জ ও খানসামা দখল করে নেয়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। যে-সকল মোষের গাড়িযোগে পাকসেনারা তাদের মালামাল বহন করে নিয়ে এসেছিল, সেই মোষগুলো ঘাটপার এলাকায় মৃত পড়ে ছিল। সেগুলোর সারা শরীর গুলি ও শেলের আঘাতে জর্জরিত ছিল। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাদের কয়েকজনকে হত্যা করা হয় এবং বাকিদের মিত্রবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। পাকিস্তানি সেনাদের ফেলে যাওয়া বিপুল অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করেন। [আজহারুল আজাদ জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড