You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.18 | কৃষ্ণপুর গণহত্যা (লাখাই, হবিগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

কৃষ্ণপুর গণহত্যা (লাখাই, হবিগঞ্জ)

কৃষ্ণপুর গণহত্যা (লাখাই, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৮ই সেপ্টেম্বর। হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা এ নৃশংস গণহত্যা চালায়।
কৃষ্ণপুর গ্রামের ননী গোপাল রায়ের বাড়ির পুকুরের ঘাটলা সংলগ্ন ফাঁকা জায়গা, গদাই নগর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাসের বাড়ির উঠানে ও চন্ডীপুর গ্রামের একটি স্থানসহ মোট তিনটি জায়গায় গণহত্যাটি সংঘটিত হয়। কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার সেনা ক্যাম্প থেকে ১০-১২ জন হানাদারবাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় রাজাকার- বাহিনীর কমান্ডার মুড়াকরি গ্রামের খেলু মিয়ার পুত্র লিয়াকত আলী, মো. বাদশা মিয়া, উমর আলী, সন্তোষপুরের মুর্শেদ কামাল শিশু মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নাসির নগর উপজেলার ফান্দাউকের আজিজুর রহমান বল্টু, আহাদ মিয়া, কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার কলাপাড়ার লাল খাঁ মিয়া এবং সাবিয়ানগরের আমিনুল হক ওরফে রজব আলীসহ ১০-১২ জন রাজাকার এ গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে।
১৮ই সেপ্টেম্বর ভোর ৫ টায় অষ্টগ্রাম পাকসেনা কাম্প থেকে কিছু সংখ্যক পাকহানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্য দুটি স্পিড বোট ও দুটি পানসি নৌকা যোগে বলভদ্র নদী পরিবেষ্টিত কৃষ্ণপুর, গদাই নগর ও চন্ডীপুর গ্রামসহ আশপাশের সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত ছোট-ছোট পাড়া ঘেরাও করে। তারা গ্রামগুলো ঘেরাও করে বের হওয়ার সকল রাস্তা বন্ধ করে দেয়। গ্রামবাসীরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হানাদাররা প্রতিটি ঘর থেকে লোকজনকে জোর করে ধরে এনে উল্লিখিত তিনটি স্থানে জড়ো করতে থাকে। হানাদার বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে অনেকেই গ্রামের পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে আশ্রয় নেয়। কেউবা গ্রামের পার্শ্ববর্তী ধানি জমিতে সাঁতার কেটে দূরে চলে যায়। এমতাবস্থায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ঘরে-ঘরে তল্লাসি চালিয়ে মোট ১২৭ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে গ্রামের তিনটি স্থান কৃষ্ণপুর গ্রামের ননী গোপাল রায়ের বাড়ির পাকা ঘাটসংলগ্ন ফাঁকা জায়গা, গদাই নগরের চিত্তরঞ্জন রায়ের বাড়ির উঠান ও চন্ডীপুর গ্রামে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নারকীয়ভাবে এদের ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা দিনব্যাপী কৃষ্ণপুর গ্রামে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবে গ্রামটি বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। আনুমানিক বিকেল ৫টায় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা চলে যাওয়ার পর যারা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে বেঁচেছিল, তারা আস্তে-আস্তে গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামে এসে তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশের স্তূপ দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারা দু-একটি লাশ স্থানীয় শ্মশানে দাহ করে। কিছু লাশ বলভদ্র নদীতে ভেসে যায়। বাকিগুলো পানিতে পড়ে থাকে।
কৃষ্ণপুর গ্রামটি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত হওয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আশপাশের গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জেলার গ্রামগুলো থেকে অসংখ্য লোক নিরাপত্তার জন্য এ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। গ্রামটিকে জনসাধারণ নিরাপদ মনে করত। তৎকালীন সময়ে কৃষ্ণপুর গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না। এ কারণে গ্রামে পাকবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনা কম ছিল। তাই এ স্থানে তারা আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাক হানাদারবাহিনী পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে ১২৭ জন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বেশির ভাগ শহীদ বহিরাগত হওয়ায় তাঁদের নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। এমনকি গ্রামে যারা এখনো বেঁচে আছে, তারাও তাদের নাম সংগ্রহ করতে পারেনি। মাত্র ৪৫ জন শহীদের নাম-পরিচয় জানা যায়। তারা হচ্ছেন- কালীদাস রায় (পিতা ব্রজেন্দ্র রায়, কৃষ্ণপুর), ডা. ননী রায় (পিতা বিনোদবিহারী রায়, কৃষ্ণপুর), রাধিকা মোহন রায় (পিতা হরেন্দ্র রায়, কৃষ্ণপুর), গোপী মোহন সূত্রধর (পিতা বিহারী লাল সূত্রধর, কৃষ্ণপুর), সুনীল শর্মা (পিতা সুসেন শর্মা, কৃষ্ণপুর), মুকুন্দ সূত্রধর (পিতা গোপাল সূত্রধর, কৃষ্ণপুর), যোগেন্দ্র সূত্রধর (পিতা প্রকাশ সূত্রধর, কৃষ্ণপুর), মহেন্দ্র রায় (পিতা বিনোদ বিহারী রায়, কৃষ্ণপুর), অনিল মাঝি (পিতা তারা চাঁন, কৃষ্ণপুর), চন্দ্র কুমার রায় (পিতা অম্বিকা চরণ রায়, কৃষ্ণপুর), জয় কুমার রায় (পিতা অম্বিকা চরণ রায়, কৃষ্ণপুর), শান্ত রায় (পিতা সখী চরণ রায়, কৃষ্ণপুর), কিশোরী রায় (পিতা মনোহর রায়, কৃষ্ণপুর), ননী চক্রবর্তী (পিতা নরেন্দ্র চক্রবর্তী, গোয়াল নগর), সুনীল চক্রবর্তী (পিতা হরিচরণ চক্রবর্তী, কটিয়াদি), ব্রজেন্দ্র রায় (পিতা অমর চাঁন রায়, কৃষ্ণপুর), জগদীশ দাস (পিতা অঘোর দাস, কৃষ্ণপুর), ইশান দাস (পিতা বোদাই দাস, কাটাখালী), ধীরেন্দ্র রায় (পিতা বৈষ্ণব রায়, বাঙ্গাল পাড়া), হরিচরণ রায় (পিতা ব্রজ গোপাল রায়, অষ্টগ্রাম), মদন রায় (পিতা অন্নদা রায়, কৃষ্ণপুর), দাসু শুক্ল বৈদ্য (পিতা কৃষ্ণচরণ শুক্ল বৈদ্য, কৃষ্ণপুর), হরিদাস রায় (পিতা হরসুন্য রায়, কৃষ্ণপুর), শুকদেব দাস (পিতা কামদেব দাস, কৃষ্ণপুর), ডা. অবিনাশ রায় (পিতা অখিল রায়, কৃষ্ণপুর), বামা চরণ রায়, শৈলেশ রায়, ক্ষিতীশ গোপ (পিতা গঙ্গাচরণ গোপ, গঙ্গানগর), নিতীশ গোপ (পিতা গঙ্গাচরণ গোপ, গঙ্গানগর), হিরা লাল গোপ (পিতা হরি মোহন গোপ, গঙ্গানগর), প্যারী দাস (পিতা ভরত দাস, কৃষ্ণপুর), শুভাস সূত্রধর (পিতা নবদীপ সূত্রধর, গঙ্গানগর), প্রমোদ দাস (পিতা প্রফুল্ল দাস, গঙ্গানগর), সুদর্শন দাস (পিতা প্রফুল্ল দাস, গঙ্গানগর), গোপাল রায় (পিতা কোল চন্দ্র রায়, গঙ্গানগর), দিগেন্দ্র আচার্য (পিতা শ্রীশ আচার্য, গঙ্গানগর),
রেবতী রায়, শবরঞ্জন রায় (পিত কৃষ্ণ কুমার রায়, কৃষ্ণপুর), দীনেশ বিশ্বাস (পিতা রমেশ বিশ্বাস, গঙ্গানগর), মনোরঞ্জন বিশ্বাস (পিতা দেবেন্দ্র বিশ্বাস, গঙ্গানগর), রসরাজ দাস, জয় গবীন্দ দাস (পিতা রামধন দাস, কৃষ্ণপুর), বিশ্বনাথ দাস (পিতা ক্ষেত্র মোহন দাস, নওয়াগাও), মহাদেব দাস (পিতা কেবল দাস, কৃষ্ণপুর) ও মহেশ দাস। [মো. বাহারউদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড