You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুলপদ্দী গণহত্যা (মাদারীপুর সদর)

কুলপদ্দী গণহত্যা (মাদারীপুর সদর) সংঘটিত হয় ২৫শে এপ্রিল। এদিন মাদারীপুর সদর উপজেলার কুলপদ্দী গ্রামের দুটি স্থানে দুটি গণহত্যা সংঘটিত হয়— একটি দোলখোলায় এবং অপরটি নমোপাড়ার ঘুলিরপাড়ে। দোলখোলায় ১৬ জন এবং ঘুলিরপাড়ে ১১ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
পাকিস্তানি বাহিনী ২৪শে এপ্রিল মাদারীপুর শহরে অনুপ্রবেশ করে। পৌরসভার অধীন হলেও মূল শহর থেকে কুলপদ্দী গ্রামের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। গ্রামটিতে অভিজাত ও ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাস ছিল। অনেক সুন্দর অট্টালিকা ছিল গ্রামটিতে। ২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী মাদারীপুরে বিমান হামলা করে। এ হামলার পর মাদারীপুর শহর জনশূন্য হয়ে গেলেও কুলপদ্দী গ্রামের কুণ্ডু বাড়ির লোকেরা তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে যায়নি। তারা তাদের সোনা-দানা, টাকা- পয়সা আর মূল্যবান জিনিসপত্র দোতলার একটি কক্ষে জমা করে রাখেন। আগের দিন পুরান বাজারে হিন্দুদের দোকানপাট ও বসতবাড়িতে ব্যাপক লুটতরাজ হয়। এ অবস্থায় ২৫শে এপ্রিল সকালে কুলপদ্দী গ্রামে মাইকিং করে হিন্দুদের উদ্দেশে বলা হয়, যারা লুটপাট করেছে তাদের নাম-ঠিকানা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেন জানানো হয়। এ ধরনের ঘোষণায় অনেকের মন আশায় ভরে ওঠে। অনেকে রাস্তার পাশে শশীমোহন রায়ের বাড়ির সামনের চত্বরে জড়ো হন। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি হানাদাররা গ্রামে প্রবেশ করে। গাড়ির শব্দে ভীত-চকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সবাই দৌড়ে পার্শ্ববর্তী ম্যালেরিয়া অফিসে আশ্রয় নেন। গাড়িবহর এসে থামে কুণ্ডু বাড়ির দোতলা ভবনের সামনে। গাড়ি থেকে নেমেই পাকিস্তানি সৈন্যরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। বন্ধ কক্ষের দরজা ভাঙ্গতে উপর্যুপরি বুটের লাথি মারতে থাকে। অগত্যা ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়া হলে হানাদাররা বাড়ির লোকেদের ওপর বেধড়ক লাথি শুরু করে। তারপর সবাইকে টেনে নিচে নামিয়ে আনে। বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মালামাল বোঝাই কক্ষটি পেয়ে যায়। ধৃতদের দিয়েই কক্ষের সব মালামাল একটি পিকআপে তুলে নেয়। শেষে সবাইকে দোলপূজার বেদির সামনে লাইনে দাঁড় করায়। দুজন সৈনিক তাদের বুকের ওপর মেশিনগান উঁচিয়ে ধরে। এখনই ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বাড়ির মহিলারা প্রাণভিক্ষার জন্য কাতর মিনতি করে ঘাতকদের পা জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু বুটের লাথি খেয়ে তারা ছিটকে পড়েন। সহসা কান ফাটানো শব্দে বেরিয়ে আসে মেশিনগানের বুলেট। গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহগুলো এলিয়ে পড়ে মাটিতে। প্রতিবছর দোলপূজায় যেখানে রং ছিটিয়ে হোলি খেলা হতো, সেখানেই নিরীহ মানুষের বুকের তাজা রক্তে নির্দয় হোলি খেলে চলে যায় ঘাতকেরা। হানাদার সেনাদলকে এ গ্রামে পথ দেখিয়ে এনেছিল কুখ্যাত ঘাতক-দালাল জব্বার হাওলাদার।
কুলপদ্দী গ্রামের দোলখোলা শহীদরা হলেন- যদুনাথ কুণ্ডু (পিতা অম্বিকা চরণ কুণ্ডু), কেষ্ট কুণ্ডু (পিতা মধুসূদন কুণ্ডু), মহাদেব কুণ্ডু (পিতা কেষ্ট কুণ্ড), মদন ঠাকুর, শিবু (পিতা মদন ঠাকুর), পরেশ কুণ্ডু ভৌমিক (পিতা হিরা লাল কুণ্ডু ভৌমিক), তানিক (পিতা পরেশ কুণ্ডু ভৌমিক), অমৃত লাল কুণ্ডু, সত্য কুণ্ডু (পিতা অমৃত লাল কুণ্ডু), হরেকৃষ্ণ বণিক (পিতা গোবিন্দ বণিক), দিগেন্দ্র লাল সাহা (পিতা লাল মোহন সাহা), সীতানাথ সাহা, লক্ষ্মী কান্ত ভূঁইয়া, সাধনা রাণী বণিক (পিতা বলাই বণিক), বড়র নাগ ও জবেদ আলী। এদিন কুলপদ্দী গ্রামের নমোপাড়ায় হামলা চালিয়ে ঘুলিরপাড়ে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা। পাকসেনাদের সঙ্গে লুটপাট, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নেয় রাজাকার- কাদের খাঁ, আচমত খাঁ, লতু খা, ফজলু খাঁ, সামসু খাঁ, সালাউদ্দিন ডাক্তারসহ অনেকে।
ঘুলিরপাড় গণহত্যায় শহীদরা হলেন- মোনাই বৈরাগী (পিতা বদন বৈরাগী), হরিমালা (স্বামী মোনাই বৈরাগী), ত্রিনাথ মণ্ডল (পিতা প্রিতম মণ্ডল), ধীরেন মণ্ডল (পিতা ত্রিনাথ মণ্ডল),। হালানি মণ্ডল (স্বামী শরৎ মণ্ডল), শান্তি মণ্ডল (স্বামী পূর্ণ দাস মণ্ডল), বিজেন্দ বাছাড় (পিতা রামনাথ বাছাড়), কেষ্ট মাতবর। (পিতা প্রেমচান মাতবর), দশরথ মণ্ডল (পিতা নগেন মণ্ডল), ফটিক বৈরাগী (পিতা নিশিকান্ত বৈরাগী) ও লক্ষ্মী মণ্ডল (পিতা – কৈলাশ মণ্ডল)। [মো. শহীদুল কবীর খোকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!