কুলফৎপুর গণহত্যা (ধামইরহাট, নওগাঁ)
কুলফৎপুর গণহত্যা (ধামইরহাট, নওগাঁ) সংঘটিত হয় ১৪ই আগস্ট। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার নিদর্শন এ গণহত্যায় গ্রামের ১৪ জন সাধারণ কৃষক শহীদ হন। কুলফৎপুর গ্রাম ধামইরহাট উপজেলা সদর থেকে উত্তর- পশ্চিম কোণে প্রায় ৭ কিমি দূরে অবস্থিত। এর সন্নিকটে জয়পুরহাট জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। ভারতীয় সীমান্তের প্রায় ২০০ মিটারের মধ্যে এ গ্রামের অবস্থান।
পাকিস্তানি বাহিনী নওগাঁ জেলা সদর দখল করে তাদের দোসরদের সহায়তায় অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করলে এ অঞ্চলের মানুষ দলে-দলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এছাড়া এ পথ দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতে গমন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়া এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে তাদের আশ্রয় ঠেকাতে ধামইরহাট উপজেলার ফার্সিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত অংশে ক্যাম্প স্থাপন করে, যা ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত পায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে হানাদার বাহিনীর প্রখর দৃষ্টি ছিল কুলফৎপুর গ্রামের ওপর। ১৪ই আগস্ট কুলফৎপুর গ্রামের মানুষজন কেউ জমি চাষ, কেউ বীজ বপন, কেউ দৈনন্দিন অন্যান্য কাজে ব্যস্ত ছিল। এদিন ধামইরহাট পাকসেনা ক্যাম্প থেকে বেলা আনুমানিক ১টায় পাকবাহিনীর ২০০ জনের একটি দল এ গ্রামে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা মাঠ থেকে ১৮ জন কৃষককে কুলফৎপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো করে। ১৮ জনের মধ্যে উমার ইউনিয়নের কুলতপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী কৈগ্রাম, টুটিকাটা ও দাড়াবাতা গ্রামেরও কয়েকজন ছিল। ধৃত গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পাকসেনারা একের পর এক প্রশ্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতাকামী কৃষকদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে না পেরে তাদের ওপর তারা নারকীয় অত্যাচার চালাতে থাকে। বুটের লাথি এবং বেয়নেটের আঘাত করার পর ১৮ জনকে হাত-পা বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। এরপর হানাদারদের অনেকগুলি অস্ত্র এক সঙ্গে গর্জে ওঠে। আর্তচিৎকার করে কৃষকদের দেহগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রক্তে রঞ্জিত হয় স্কুলের সবুজ চত্বর। এর মধ্যে আব্দুল মান্নান, মজিরউদ্দিন, আজিরউদ্দিনসহ ৪ জন আহত হয়ে বেঁচে যান। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের ফলে গ্রামবাসী ও স্বজনদের কান্নার রোল ওঠে, গোটা গ্রাম যেন শ্মশানে পরিণত হয়। এভাবে প্রায় ৪ ঘণ্টা কেটে যায়। এরপর হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গ্রামটি ত্যাগ করলে গ্রামবাসীরা ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। তারা হানাদার বাহিনী পুনরায় গ্রামে ফিরে আসার আশঙ্কা করে দ্রুত ১২ জন শহীদকে কালাহারের পুকুরপাড়ে গণকবরে সমাহিত করে। অন্য দুজনকে গ্রামের উত্তর পাড়ায় কবর দেয়া হয়।
কুলফৎপুর গণহত্যায় শহীদ ১৪ জনের ১০ জন কুলফৎপুর, টুটিকাটা ও দাড়াবাতা গ্রামের এবং ৪ জন কৈগ্রামের বাসিন্দা। ১৪ জন শহীদের সমাধিস্থল এখন শুধুই গো- চারণভূমি। তবে নওগাঁর একুশে উদযাপন পরিষদ এবং উমার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ-এর পক্ষ থেকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এ গণহত্যার শিকার ১৪ জন শহীদ গ্রামবাসী হলেন- কুলফৎপুর গ্রামের আমজাদ হোসেন (৩৫) (পিতা বজির উদ্দীন), চানমদ্দীন মণ্ডল (৪৫) (পিতা কফিল উদ্দীন মণ্ডল), কছিমদ্দীন মণ্ডল (৪২) (পিতা ইছরত আলী দেওয়ান), ছয়েফ উদ্দীন (৫০) (পিতা সুবারউদ্দীন মণ্ডল), আবতাব উদ্দীন (২২) (পিতা আবেদ আলী মণ্ডল), তায়েজউদ্দীন (১৮) (পিতা আবেদ আলী মণ্ডল), মতিবুল হোসেন (৩৪) (পিতা সিরাজ উদ্দীন), টুটিকাটা গ্রামের আব্বাছ আলী (৫০) (পিতা ছবিরউদ্দীন), আবেদ আলী (৩৫) (পিতা শরিফ উদ্দীন), কৈগ্রামের রহিমউদ্দীন (৩০) (পিতা সালেমদ্দীন), ফয়জুল ইসলাম (৩৬) (পিতা মহিরউদ্দীন), তজিরউদ্দীন মণ্ডল (৬২) (পিতা কিমির উদ্দীন মণ্ডল), তমিজউদ্দীন বিজু (১৫) (পিতা শহীদ তজিরউদ্দীন) ও অবিরউদ্দীন (৩৪) (পিতা রহিমউদ্দীন, দাড়াবাতা)। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড