You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতাে যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়ে উঠতি বয়সেই সে হয়ে উঠেছিলাে রংপুর অঞ্চলের ত্রাস; চার দশক আগের সেই অপরাধের দায়ে এই জামায়াত নেতাকে ফাসির রায় দিয়েছে আদালত। মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ মামলার রায় ঘােষণা করেন। প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযােগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে আজহারের দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন তিনি। জামায়াতের আজকের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম একাত্তরে ছিলাে ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি। সে সময় তার। নেতৃত্বেই বৃহত্তর রংপুরে গণহত্যা চালিয়ে ১৪ শ’র বেশি মানুষকে হত্যা, বহু নারীকে ধর্ষণ ও অপহরণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল বলে ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে। প্রসিকিউশন বলছে, সংখ্যার দিক থেকে এত বড় গণহত্যার বিচার এ ট্রাইব্যুনালে আর হয়নি।

ট্রাইব্যুনাল আইনে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা না থাকায় একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণের আদেশ দেয়নি। তার বদলে রাষ্ট্রকে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে বলেছে আদালত। পাঠ্যপুস্তকেও তাদের গৌরবগাঁথা অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। রায়ের পর স্রষ্টার শুকরিয়া আদায় করেছেন রংপুরের বীরাঙ্গনা মানসুরা, যাকে অন্য অনেক নারীর মতাে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আজহার ও পাকিস্তানি বাহিনী, রংপুর। টাউন হলে নিয়ে করা হয়েছিল ধর্ষণ ।। তিনি বলেন, ‘লম্পট আজহারের ফাঁসির রায় হওয়ায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। ফাঁসি কার্যকর হলে শান্তিতে মরতে পারব।
সবচেয়ে বড় গণহত্যার বিচার
এটিএম আজহারুল ইসলামের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে অন্তত ১৪০০ লােককে হত্যা এবং ১৪ জনকে খুনের অপরাধে। প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযােগের মধ্যে ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযােগ। আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ নম্বর অভিযােগে ১৪ জনকে অপহরণের পর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযােগে ঝাড়ুয়ার বিল ও দমদম ব্রিজে গণহত্যা চালিয়ে ১৪ শীর বেশি লােককে হত্যার দায়ে আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর প্রসিকিউটর তুরীন আফরােজ সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালে যতগুলাে বড় গণহত্যার ঘটনার বিচার হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যা। সংখ্যার দিক থেকে এত বড় গণহত্যার বিচার ট্রাইব্যুনালে হয়নি। ওই অঞ্চলের বহু নারীকে রংপুর টাউন হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন। কেন্দ্রে ধর্ষণের জন্য তুলে দেওয়ার দায়ে ৫ নম্বর অভিযােগে একাত্তরের এই বদর কমান্ডারকে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ৬ নম্বর অভিযােগে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় আসামির জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।
প্রতিক্রিয়া ও পর্যবেক্ষণ
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের ত্যাগ ও কষ্টকর অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করতে সরকারের প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ, যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে। যাতে বীরঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, পাকিস্তান দখলদার ও তাদের সহযােগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসের যৌন সন্ত্রাসসহ বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে তারা জানতে পারে।’ কিন্তু আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উচিৎ আর দেরি না করে এই বীরাঙ্গনাসহ সকল বীরাঙ্গনাকে যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা। কারণ তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘােষিত এবং সম্মানিত বীরাঙ্গনা । সমাজে তাদেরকে গ্রহণ, স্বীকৃতি এবং সম্মানিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। শহীদ ও মুক্তিযােদ্ধাদের মতাে তারাও জাতির অহঙ্কার।
বদর কমান্ডার থেকে জামায়াত নেতা
এটিএম আজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার। বদরগঞ্জ উপজেলার বাতাসন লােহানীপাড়া গ্রামে। বাবার নাম নাজির হােসাইন, মা রামিসা বেগম। ১৯৬৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে পরের বছর সে ভর্তি হয় রংপুর কারমাইকেল কলেজে। একত্তরে বাঙালি যখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আজহার তখন জামায়াতের সেই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে আলবদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার। বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম দমনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযােগিতা দিতে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের তত্ত্বাবধানে এই সশস্ত্র দলটি গড়ে তােলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী সে সময় রংপুর টাউন হলকে নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত করে এবং বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের লােকজনকে ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করা হয়। রংপুরের মুক্তিযােদ্ধাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আজহার সে সময় ৭০ জন আলবদর সদস্যের একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিতাে।
সে মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের স্বজনদের তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দিতাে এবং তাদের হত্যা, আটকে রেখে নির্যাতনে অংশ নিতাে। ১৭ আগস্ট আল-বদর বাহিনী সারা দেশেই সভা-সমাবেশ করে। রংপুর সদরে আল-বদর বাহিনীর সেই সভা হয় এটিএম আজহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে, যা জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামেও আসে। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলার বিজয়ের আগে আগে আজহার দেশত্যাগ করে। এবং চলে যায় সৌদি আরবে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আজহার আবার দেশে ফেরে এবং ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে। জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার পর দলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে আজহার। ১৯৯১ সালে সে ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব পায় এবং ২০০৫ সালে। কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হয়। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর কিছুদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আজহার। ২০১২ সালের ২২ অগাস্ট সেও একই। অভিযােগের মামলায় গ্রেপ্তার হয় আজহার।
মামলার কার্যক্রম
২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল এটিএম আজহারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করেন তদন্ত কর্মকর্তা এস এম ইদ্রিস আলী। ওই বছর ২২ অগাস্ট মগবাজারের বাসা। থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্ত শেষে প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও নূরজাহান বেগম মুক্তা ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযােগ দাখিল  করেন। যুদ্ধাপরাধের ছয় ঘটনায় অভিযােগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর আজহারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) এম ইদ্রিস আলীসহ প্রসিকিউশনের পক্ষের মােট ১৯ জন সাক্ষ্য দেন। তবে সপ্তম সাক্ষী আমিনুল ইসলামকে বৈরি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া আজহারের যুদ্ধাপরাধের একজন ভিকটিম’ ১৪ নম্বর সাক্ষী হিসাবে ক্যামেরা ট্রায়ালে জবানবন্দি দেন।
২০১৪ সালের ৩ ও ৪ অগাস্ট আজহারের পক্ষে একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে। জবানবন্দি দেন আনােয়ারুল হক। দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ১৮ সেপ্টেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য। অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।
আজহারের বিরুদ্ধে যতাে অভিযােগ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)/এ, ৩(২)/সি, ৩(২)/ডি, ৩(২)/জি ও ৩(২)/এইচ এবং ৪/১ ও ৪/২ ধারা (সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি) মােতাবেক ৬টি অভিযােগ আনা হয় আজহারের বিরুদ্ধে। অপরাধ সংঘটনের সময়সীমা ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। অভিযােগে বলা হয়, রংপুরের কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। থাকাকালে আজহার জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর শাখার। সভাপতি ও ওই জেলার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলাে। রংপুর ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াতের মাধ্যমে সে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তােলে। আসামি আজহার মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের স্বজন, মুক্তিকামী বাঙালি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দিতাে এবং তাদের হত্যা, গণহত্যা, আটক ও নির্যাতনে পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র করে তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতাে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় মানবতাবিরােধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে এসব অপরাধ সংঘটন করে এটিএম আজহার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদরের নেতৃত্বে থাকায় তার বিরুদ্ধে। সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি আনা হয়েছে। প্রথম অভিযােগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটক শারিরীক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদের ৩ এপ্রিল রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যা চালানাে হয়। দ্বিতীয় অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে।
তৃতীয় অভিযােগে বলা হয়, এ একই বছরের ১৭ এপ্রিল নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২০০ বেশি নিরীহ লােক ধরে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে। চতুর্থ অভিযােগে বলা হয়, ১৭ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক পত্মীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম বিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পঞ্চম অভিযােগে বলা হয়, ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরীক নির্যাতন চালায়। একই সঙ্গে মহিলাসহ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলাে আজহার। ষষ্ঠ অভিযােগে বলা হয়, একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে এজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম করে।

সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!