You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়া উপজেলা (মৌলভীবাজার) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়া উপজেলা (মৌলভীবাজার)

কুলাউড়া উপজেলা (মৌলভীবাজার) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী উপজেলা কুলাউড়া একটি ঐতিহাসিক স্থান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কুলাউড়ার মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৭০-এর নির্বাচনে কুলাউড়ায় আওয়ামী লীগ থেকে আবদুল মোন্তাকিম চৌধুরী এমএনএ ও নওয়াব আলী সারোয়ার খান এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র গোটা বাঙালি জাতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। কুলাউড়াবাসীও সারাদেশের মতো মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ, ২৫শে মার্চের গণহত্যা, ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা, এরপর সংঘটিত মৌলভীবাজরের শেরপুর প্রতিরোধযুদ্ধ ও কুলাউড়ায় পাকহানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ – এ পটভূমিতে কুলাউড়াবাসী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
কুলাউড়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকগণ হলেন- আবদুল মোন্তাকিম চৌধুরী এমএনএ, আলী সফদর খান রাজা, নওয়াব আলী সারোয়ার খান এমপিএ, আবদুল জব্বার, জয়নাল আবেদিন, আবদুর রহিম, আবদুল মালিক, নূর আহমদ, আবদুস সালাম, সৈয়দ জামাল উদ্দিন, মুকিম উদ্দিন আহমদ, জুবের চৌধুরী, মমরোজ বখশ, সৈয়দ আকমল হোসেন, আবদুর রকীব তোতা, আজির উদ্দিন খান, আবদুল লতিফ খান, মসাদুর রহমান, আবদুর রহিম, মো. মোবারক আলী, মোবারক মিয়া, ছানোয়ার আলী, মেহের উল্লাহ, বাহার উল্লাহ, আলাল বখশ, আমজাদ উল্লাহ, মিয়া ঠাকুর, আলাউদ্দিন চৌধুরী, সালেহ মিয়া, নজির খান, মতিউদ্দিন আহমদ, আতাউদ্দিন আতা, চেরাগ আলী মাস্টার, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, গিয়াস উদ্দিন, সৈয়দ আছমতুর রহমান, নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া, আবদুল হাই, জানে আলম ভূঁইয়া, মইনুল ইসলাম মনু, আবদুল মতিন, আবদুল মুকিত মিকি, আবদুর রব, খালেদ হায়দার, আবদুল মোহিত, লুৎফুর রহমান চৌধুরী হেলাল, মো. সোলেমান, আবদুল মনাফ, শেখ ফখরুদ্দিন, মখলিছ মিয়া, আবদুল মুনিম, মটুক বক্স, আছদ্দর আলী তারা প্রমুখ।
কুলাউড়ার ৮নং রাউৎগাও ইউনিয়নে ৭ই মার্চ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এখানে প্রথম দলে ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ সদস্য এবং ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে ৩২ জনের এ দল গঠিত হয়। প্রশিক্ষক ছিলেন আলাউদ্দিন চৌধুরী, সালেহ মিয়া ও নজির খান। স্থানীয় ‘জব্বার বাহিনী’র মুক্তিযোদ্ধারা কুলাউড়ায় প্রশিক্ষণ নেন। এ বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন আছকির মিয়া ও হাবিব উল্লাহ। ভারতের কৈলাশহর ও লোহারবন্দে কুলাউড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কুলাউড়ায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা প্রথমদিকে জননেতা আব্দুল জব্বারের নামানুসারে জব্বার বাহিনী নামে পরিচিত হলেও পরে এ বাহিনী আর প্রতিষ্ঠা পায়নি। আছকির মিয়ার নেতৃত্বে জব্বার বাহিনী কাফুয়ার পুলে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়। আছকির মিয়া ও হাবিব উল্লাহ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন। অন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এভাবে এ বাহিনীর কার্যক্রমের অবসান ঘটে।
২৭শে মার্চ শমশেরনগরের বিদ্রোহী ইপিআর সদস্যরা চাতলাপুর ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করলে ৫ জন পাকিস্তান সমর্থক ইপিআর সদস্য নিহত হয়। শেরপুর প্রতিরোধযুদ্ধে কুলাউড়ার অনেক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিলেও উপজেলাকেন্দ্রিক প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ই এপ্রিল। এদিন মৌলভীবাজার থেকে কুলাউড়ায় পাকসেনারা আসতে পারে এ খবর পেয়ে জননেতা আবদুল জব্বার, মসাদুর রহমান, মুকিম উদ্দিন আহমদ প্রমুখ আছকির মিয়ার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে কাফুয়ার পুলে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। কুলাউড়া- মৌলভীবাজার সড়কের কাফুয়ার পুল শহর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। পিছু হটে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় জিপ উল্টে মুক্তিযোদ্ধা আছকির মিয়া ওরফে আকরাম (জব্বার বাহিনীর প্রশিক্ষক) মারাত্মক আহত হন এবং মুক্তিযোদ্ধা হাবিব উল্লাহ (জব্বার বাহিনীর প্রশিক্ষক) ঘটনাস্থলে মারা যান। এ ঘটনায় আছকির মিয়াও মৃত্যুবরণ করেন। এঁরা ২ জন কুলাউড়ার প্রথম শহীদ। মুক্তিযোদ্ধাদের কাফুয়ার পুল প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে পাকবাহিনী কুলাউড়ায় অনুপ্রবেশ করে।পাকবাহিনী ৬ই এপ্রিল কুলাউড়ায় অনুপ্রবেশ করে। শহরে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করে তারা নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় ও কুলাউড়া হাসপাতালে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। পরদিন পৃথিমপাশার রবিব বাজার সদপাশা স্কুলে তাদের দ্বিতীয় ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আলী সফদর খান রাজা ও আলী সারোয়ার খান এ ভ্রাতৃদ্বয়ের বাড়ি দখল করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
কুলাউড়ায় স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে মুসলিম লীগ- সক্রিয় ছিল। এ দলের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি- ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট এ এম এম ইউছুফ (কাজল দাড়া)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। শান্তি কমিটিতে নেতৃত্ব দেয় বদরউদ্দিন আহমদ (থানা কমিটির আহ্বায়ক ও মুসলিম লীগ নেতা), মাহতাব চৌধুরী (যুগ্ম-আহ্বায়ক ও মুসলিম লীগ নেতা; বিছরাকান্দি), বাতির মিয়া (যুগ্ম-আহ্বায়ক ও মুসলিম লীগ নেতা; রামপাশা), আলী ইয়াওর খান (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; পৃথিমপাশা), হাবিব বখত চেয়ারম্যান (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; হাজীপুর), হাজী আলাউদ্দিন (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; কুলাউড়া শহর), দরছ মিয়া (সদস্য ও মুসলিম লীগ কে ভাস্কর্য নেতা; গোবিন্দপুর), হাজী আবদুল বারী (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; কাছুর কাপন), হাবিব উল্লাহ (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; রামপাশা), আফতাব উদ্দিন চৌধুরী (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; রঙিন ফুল), খোরশেদ উল্লাহ (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; বরমচাল), মমরোজ মিয়া (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; মিয়ারমহল), মকবুল আলী (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; কাদিপুর), আবদুর রহমান (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; হাসিমপুর), আবদুল খালিক চৌধুরী ফুল মিয়া (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা, রাজাকার সংগঠক; হিঙ্গাজিয়া), মাহমুদুর রহমান চৌধুরী (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা; পৃথিমপাশা), মাহবুবুর রহমান চৌধুরী (সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা, রাজাকার সংগঠক; পৃথিমপাশা), আবদুল মতিন চৌধুরী (সদস্য ও রাজাকার সংগঠক; পৃথিমপাশা), হাফিজ আনসার উদ্দিন (সদস্য ও রাজাকার সংগঠক; পৃথিমপাশা) প্রমুখ। কুখ্যাত রাজাকারদের মধ্যে ছিল সোনা মিয়া, আবদুল খালেক, হিরা, নওয়াব আলী, আরজদ আলী, তনু মিয়া, ফয়জু মিয়া, জফর মিয়া, সুরুজ মিয়া, তাইবুদ্দিন খান, নটু মিয়া প্রমুখ। এরা পাকবাহিনী কুলাউড়ায় প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে তৎপর ও সংগঠিত হয়ে কুলাউড়া শহরের পোকুর বাজার, পৃথিমপাশা, ফানাই নদী, পদ্মদিঘীর পাড় প্রভৃতি স্থানে হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণ শুরু করে।
কাফুয়ার পুলে প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ায় পাকিস্তানি হানাদাররা এ এলাকার মানুষের ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল। ৬ই এপ্রিল কুলাউড়ায় অনুপ্রবেশ করেই তারা থানার পার্শ্ববর্তী চাতলগাও-এ আক্রমণ করে। গ্রামের মসজিদের কাছে ৫ জন নিরীহ মানুষকে তারা হত্যা করে। এ ঘটনা চাতলগাঁও গণহত্যা- নামে পরিচিত। কুলাউড়া শহরে প্রবেশ করে আত্মগোপনে থাকা ছাত্রলীগ নেতা নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া ও তাঁর এক সহযোগীকে হত্যা করে। স্বাধীনতাপন্থীদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত আজম বোর্ডিং-এর ম্যানেজার আবদুর রহমানকে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এখানে ধৃত ছলিমউল্লাহ ও রাজনগরের শামসুদ্দীনকে তারা হত্যা করে। এদিনই নানু মিয়া ও ধীরেন্দ্র নাথকে হত্যা করা হয়।
মুসলিম লীগ নেতা আলী ইয়াওর খানের প্ররোচনায় পাকহানাদাররা আলীনগর বিওপি-তে উপস্থিত হয়ে বাবুর্চি মখই মিয়া ও তার পিতা আবদুল জব্বারকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। ফেরার পথে পৃথিমপাশার রিকশাচালক ছমরু মিয়াকে ধরে নিয়ে আসে এবং তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ ফানাই নদীতে ফেলে দেয়। এখানে তারা সাবাজ আলী, আরমান আলী ও ইরফান আলীকে হত্যা করে। এদের লাশও তারা ফানাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তারাকলির আবদুল গফুর মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ায় তাঁর পিতা মকরম উল্লাহ, চাচা আইন উদ্দিন, চাচাত ভাই আবদুস সাত্তার এবং তাদের ভগ্নিপতিকে ধরে এনে পাকহানাদাররা পদ্মদিঘীর পাড়ে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।
পদ্মদিঘীর পাড়ে অনেকে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। এখানে বিভিন্ন সময় যাদের হত্যা করা হয়, তারা হলেন- মকবুল আলী, প্রহল্লাদ মাস্টার, নরেন্দ্র নাথ, বরু উল্লাহ, রাজনগরের তছলিশ আলী, বিজলী, অক্ষয় ডাক্তার, তিরাশি ঝুরার সাধুবাবু, দীঘলকান্দির নঈম উল্লাহ, মমরাজের ক্ষিতীশ দাশ, ভাটগাঁওয়ের ছগির আলী, লাক্কাতুরা চা-বাগানের ম্যানেজার আবদাল চৌধুরী প্রমুখ। সুশীল চন্দ্র দাশ, অতুল চন্দ্র দাশ, হীরেন্দ্র দাশ, সুভাষচন্দ্র দাশসহ অনেকের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। কুলাউড়ায় পাকবাহিনীর কয়েকটি প্রধান বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র হলো— কুলাউড়া নবীনচন্দ্র হাইস্কুল, কুলাউড়া হাসপাতাল, পৃথিমপাশার সদপাশা স্কুল, আলী আমজাদ ও নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিছরাকান্দি মসজিদ চত্বর।
কুলাউড়ায় বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। সেগুলো হলো— বিছরাকান্দি মসজিদের উত্তর পশ্চিম- কোণের কবরস্থান, কুলাউড়া-সিলেট রেলওয়ের সিএন্ডবি-র কুলাউড়া- জুড়ী ক্রসিং-এর পশ্চিম কোণ, নবীনচন্দ্র স্কুল সংলগ্ন কুলাউড়া- মৌলভীবাজার সড়কের ডানদিকের চত্বর ও রেলের পূর্বদিক থেকে পার্শ্ববর্তী চিড়লমুচির বাড়ি পর্যন্ত চত্বর, কুলাউড়া-সিলেট রেলপথের সিগনালের পশ্চিমাংশ, পৃথিমপাশার সদপাশা স্কুল, ফানাই নদীতীর, মনু ব্রিজের নদীতীর, চাতলগাও কাছুর কাহান কবরস্থান এবং পদ্মদিঘীর পাড়।
কুলাউড়ায় পাকসেনাদের ৩১৩ বিগ্রেডের সাব-সেক্টর ছিল। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়। এপ্রিলের শেষদিকে দত্তগ্রামে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। টিলা বাজার থেকে কালিপুর ক্যাম্প হয়ে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা এ- যুদ্ধে অংশ নেন। দুই ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, এসএলআর-সহ বিভিন্ন অস্ত্র এ-যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। সৈয়দ মখলিছুর রহমান এ-যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় ক্যাপ্টেন হামিদ নেতৃত্ব দেন। ৪৫ মিনিট ধরে যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পল্কি নদীর ওপর চাতলাপুর চা-বাগানের ভেতর একটি সেতু ছিল। ১২ কিলোমিটার টহল এলাকার মধ্যে পাকহানাদারদের কাছে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দুই দলে বিভক্ত ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার দুটি দল সেতুটি ধ্বংস করার অপারেশনে অংশ নেয়। নেতৃত্ব দেন শফিকুর রহমান ও আবদুস সালাম চৌধুরী বাচ্চু। অন্য আরো যাঁরা অংশ নেন, তাঁরা হলেন- আশরাফ আলী, সুন্দর আলী, দেবেন্দ্র রায়, আনাই মিয়া, আহমদ আলী, আজব আলী, আরজু খান প্রমুখ। তাঁরা বিস্ফোরক দিয়ে সেতুটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। পাকসেনারা তাঁদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ভেতরে চলে যান
কুলাউড়া সদর থেকে পৃথিমপাশার দূরত্ব প্রায় ৮ মাইল। পৃথিমপাশা ডাকঘরের মাধ্যমে তারবার্তা আদান-প্রদান ও তথ্য বিনিময়ের কারণে এলাকায় পাকহানাদাররা কৌশলগতভাবে ভালো অবস্থানে ছিল। ১৫ কিলোমিটার দূরে ষাড়েরগজ কালাইগিরিতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ১০৪ জনের একটি দল ছিল। এ দলের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মুজিবুর রহমান এবং আবদুল গফুর। ডেপুটি কমান্ডারের অধিনায়কত্বে ১২ জনের একটি গ্রুপ ২৪শে জুন রাতে ডাকঘরে হামলা করে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। তাঁরা ইউনিয়ন অফিসে ফিরে যাবার পর পাল্টা আক্রমণে পড়েন। এ-যুদ্ধে অংশ নেন আছলিম আলী, মকছন্দ আলী, কট্টর উল্লাহ, ফারুক আহমদ, তছকির আলী, ফিরোজ আলী, নাসির আলী, নজির খাঁ, আবদুল হাই, হারুনূর রশীদ ও আবদুল মতিন।
চাতলাপুর বিওপি-র বিপরীতে ভারতের সীমান্তের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ মুখলিসুর রহমান। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের এই ক্যাম্পের ওপর গভীর রাতে অতর্কিতে হামলা করে। এতে মুক্তিযোদ্ধা রুদ্র পাল শহীদ হন। মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে অনেকক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। ৩০৩ রাইফেল, এসএলআর ও স্টেনগান এ-যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। পাল্টা আক্রমণে একজন পাকিস্তানি মিলিশিয়া নিহত হয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়।
আলী নগর বিওপি-তে বিদ্রোহী বাঙালি ইপিআর সদস্যদের দ্বারা গঠিত মুক্তিবাহিনীকে পাকহানাদাররা হঠিয়ে দেয়। এরপর তারা এলাকার সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ন’মৌজা ছিল বৃহত্তর সিলেটের মুক্তাঞ্চল। সেখানে সংগঠিত হয়ে ইউপি সদস্য মুক্তিযোদ্ধা রহিম উল্লাহ বাদশাহর পরিকল্পনায় এবং মুক্তিযোদ্ধা ও ন্যাপনেতা আবদুল গফুরের অধিনায়কত্বে পাকবাহিনীর আলী নগর বিওপি-তে এক দুঃসাহসী আক্রমণ চালানো হয়। গভীর রাতে সংঘটিত অতর্কিত আক্রমণে আলী নগর বিওপি-র পাকসেনারা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বিওপি-তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা বেশিদিন এ ক্যাম্প দখলে রাখতে পারেননি। পাল্টা হামলা করে হানাদাররা তাদের দখল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।
মুরইছড়ায় পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প থেকে ৩ মাইলের মধ্যে টিলাবাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এ দুই ক্যাম্প থেকে দুপক্ষের মধ্যে প্রায়ই গুলি বিনিময় হতো। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের এ ক্যাম্প উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এজন্য জুলাই মাসের ১২ তারিখ রাতে মুক্তিযোদ্ধারা মুরইছড়া ক্যাম্প আক্রমণ করেন। পাকবাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে। ১ ঘণ্টা পর পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের তিনদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধা মিসির মিয়ার এলএমজি থেকে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণে বিপদ সংকেত পায় ভারতীয় বাহিনী। ক্যাপ্টেন হামিদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যেতে সক্ষম হন। এখানে একজন শত্রুসেনা আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অক্ষত অবস্থায় ভারতে ফিরে যান।
মনু নদীর এক পাড়ে বাংলাদেশের নিশ্চিন্তপুর ও অন্যদিকে ভারতের কালিপুর। ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি ক্যাম্প ছিল কালিপুরে। চাতলাপুর ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি মেজর রফিকুল ইসলাম ১ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে নিশ্চিন্তপুরে বৃন্দাবনীর দিঘীর পাড়ে অবস্থান নেয়। তার লক্ষ্য ছিল কালিপুরে আক্রমণ করা। এ খবরে ৩৮ জন করে দুটি দলে মুক্তিযোদ্ধারা শফিকুর রহমান ও আবদুস সালাম চৌধুরী বাচ্চুর নেতৃত্বে গোপনে কালিপুরের দিক থেকে মনু নদীর পাড় ঘেঁষে এগিয়ে যান। হানাদাররা যখন নৌকায় ওপাড়ে যেতে ব্যস্ত, তখন মুক্তিবাহিনী স্টেনগান, ২ ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ২৭শে জুলাই তাদের ওপর আক্রমণ করে। নিশ্চিন্তপুর-কালিপুর যুদ্ধ-এ ২০ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। বাকি পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে সোহাগ মিয়া, ইয়াছিন আলী, মনোহর আলী, আনাই মিয়া, আরজু খান, সুন্দর আলী, আহমদ আলী শাহ, আর্শাদ আলী, আজব আলী প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বে বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়।
কুলাউড়া-কমলগঞ্জ রেলপথের মাঝামাঝি ২০ ফুট দীর্ঘ পাবই সেতুটি ২০ ফুট সেতু নামে পরিচিত ছিল। পাকবাহিনীর সিলেট-আখাউড়া সেকশনে রেল চলাচল বন্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এ সেতুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। সেতু ধ্বংস করার অপারেশনে ২০ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধা দলে ছিলেন শফিকুর রহমান, বশির উদ্দিন, আবদুর রৌফ, আবদুশ শুকুর, ওয়াহিদ মিয়া প্রমুখ। অধিনায়ক ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মোহাম্মদ আলী মায়া। ২৫শে জুলাই নসিরগঞ্জ বাজার, ভুইগাও, চান্দগাও হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেতুর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর প্রহরারত রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করেন। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী রাজাকারদের হটিয়ে ব্রিজের দখল নেয় এবং ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। রাজাকারদের একজন আরজদ আলী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। মনু-চাতলাপুর সড়কের একটি অংশে পাইকপাড়া। এখানে কোদালী নদীর ওপর একটি সেতু ছিল। এ সেতু পাইকপাড়া সেতু নামে পরিচিত। এ সড়ক দিয়ে পাকবাহিনী চাতলাপুর পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করত। পাকবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এ সড়কে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ পাইকপাড়া সেতুটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শফিকুর রহমানের অধিনায়কত্ব ও মায়া মিয়ার সহ- অধিনায়কত্বে এ সেতু ধ্বংসের অপারেশন পরিচালিত হয়। রাতে মুক্তিযোদ্ধা দল অপারেশনে এগিয়ে গেলে টহলরত রাজাকাররা তাঁদের ওপর আক্রমণ করে। দুপক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। রাতভর গোলাগুলি শেষে মুক্তিবাহিনী সেতুটি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। গুলিবিদ্ধ রাজাকার সোনা মিয়া ও নওয়াব আলী পালিয়ে গেলেও তিনজন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এখানে বহু অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।
পাকবাহিনীর রেল যোগাযোগ বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা মনু নদীর ওপর অবস্থিত রেলসেতুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মোহাম্মদ আলী মায়া ৮ সদস্যের একটি দল গঠন করেন মনু ব্রিজ ধ্বংসের জন্য। এর আগে জুলাই মাসে একটি অভিযান ব্যর্থ হয়। ৯ই আগস্ট রাতে মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান, মিসির আলী, আবদুশ শুকুর, বশির উদ্দিন, আবদুর রৌফ, মুসলেউর রহমান প্রমুখ মনু ব্রিজের কাছে এগিয়ে গেলে শত্রুপক্ষের অতর্কিত হামলার মুখে পড়েন। এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা আবদুশ শুকুর শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা মুসলেউর রহমান রাজাকার তনু মিয়ার বিশ্বাসঘাতকতায় ধৃত এবং পাকক্যাম্পে শহীদ হন। এ দুজন শহীদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি স্টেনগান ও কয়েক বাক্স বিস্ফোরকও খোয়া যায়।
কুলাউড়া থানার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে রাজাপুর একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। এখানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পে নারীদের নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযোদ্ধারা নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে এ ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। আক্রমণের জন্য মায়া মিয়া, ইয়াজিদ আলী, ফরিদ আহমদ, শফিকুর রহমান, ওয়াহিদ আলী ও মসদ্দর আলীকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ২৮শে আগস্ট ভোররাতে হানাদারদের ওপর আক্রমণ করেন। আক্রমণে একজন পাকসেনা ও তিনজন রাজাকার নিহত হয়। তবে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা কঠিন প্রতিরোধ তৈরি করলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
লোহারন্দ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধিনায়ক কর্নেল বাগচি ২ ও ৩ নং ব্রাভো কোম্পানি থেকে সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ১০ জনের একটি দল গঠন করেন। দলনেতা ও উপনেতা ছিলেন যথাক্রমে আবদুল আহাদ চৌধুরী ও সৈয়দ মহসিন আলী (পরে এমপি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী)। ১১ই অক্টোবর তাঁরা আলী নগরে পাকহানাদারদের আক্রমণ করেন। আলীনগর যুদ্ধ-এ ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৯ জন আহত হন। এ-যুদ্ধে বিজয় লাভের পর মুক্তিযোদ্ধারা মনু ও টিলাগাও স্টেশনের মধ্যবর্তী রেলপথ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন।
অক্টোবর মাসে ক্যাপ্টেন আবদুল আহাদের নেতৃত্বে ১৫০ জন এবং লে. আবদুল জলিলের নেতৃত্বে ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা মনু ব্রিজ সংলগ্ন পাকসেনা ক্যাম্পে হামলা করেন। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ করলে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পিছু হটে।
১৮ই নভেম্বর কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে অধিনায়ক আবদুল গফুরের নেতৃত্বে ৪০ জনের একটি দল গঠিত হয়। এ দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন ফারুক আহমদ ও ফিরোজ আলী। রাত ৯টায় তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এ- যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ইমাম উদ্দিন আহত হন। কিছু অস্ত্র ও গুলি মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ৬ই ডিসেম্বর সকালে কুলাউড়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
কুলাউড়ার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সফর উল্লাহ (পিতা আতর আলী, উত্তরভাগ), আবদুশ শহীদ (পিতা রহমান আলী, নিশ্চিন্তপুর), শুকুর উল্লাহ (পিতা রহমান উল্লাহ, পাবই), আরজু মিয়া (পিতা মশরফ আলী, উত্তর পলকী), আছকির মিয়া ওরফে আকরাম (পিতা আছলম আলী, কামারকান্দি), বশির আলী (পিতা শুকুর আলী, মনরাজ), ছগির আলী (পিতা গফুর আলী, ভাটগাঁও), হাবিব উল্লাহ (পিতা হাসন আলী, রামপাশা), ইয়ানুর আলী খান (পিতা আকমল খান, লামারচক), আসকর আলী (পিতা হামিদ উল্লাহ, মনোহরপুর), জহির মিয়া (পিতা আপ্তাব মিয়া, লালারচক), ইব্রাহিম আলী (পিতা ইউনুছ মিয়া, মনোহরপুর), নন্দলাল বাউরী (পিতা সুধীর বাউরী, চাতলাপুর), আবদুল আলী (পিতা হাবিব উল্লাহ, লালারচক), সনাতন সিংহ (পিতা হেনা সিংহ, নলভরি), ধ্রুবরঞ্জন দে (পিতা দিপেন্দ্র চন্দ্র দে, সালন), মো. মুজিবর রহমান (চরগোবর; ইপিআর সদস্য) এবং কাজী আরিফ আলী (চান্দিনা)।
শহীদ আছকির মিয়ার স্মরণে কুলাউড়ার লাফুয়ার পুল এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। [হাসনাইন সাজ্জাদী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড