You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.05 | কুলিয়া ব্রিজ যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

কুলিয়া ব্রিজ যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা)

কুলিয়া ব্রিজ যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ৫ই ডিসেম্বর। এতে ৪ জন পাকসেনা নিহত, অপরপক্ষে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধবিদ্যায় অনেক পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে যাঁরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন, তাঁরাও প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেন। পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ভারী ও আধুনিক অস্ত্র দেয়া হয়। ফলে নভেম্বর মাসে সাতক্ষীরা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন করে গতি সঞ্চার হয় এবং তাঁরা ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। গেরিলা পদ্ধতিতে চোরাগোপ্তা হামলার পাশাপাশি পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধেও তাঁরা অংশ নিতে থাকেন। দুঃসাহসিক অভিযানে একে-একে মুক্ত হয় সাতক্ষীরা মহকুমার দক্ষিণাঞ্চলীয় থানা শ্যামনগর (১৯শে নভেম্বর) ও কালিগঞ্জ (২০শে নভেম্বর)। এদুটি থানা থেকে বিতাড়িত হয়ে হানাদার বাহিনী পারুলিয়া ব্রিজের দু-প্রান্তে বাজার জুড়ে ঘাঁটি স্থাপন করে অবস্থান নেয়। কিন্তু ব্যাপক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার অগ্রসর হওয়ার খবর জানতে পেরে তারা হঠাৎ একদিন এ ঘাঁটি ছেড়ে কুলিয়া ব্রিজে গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। মুক্তিযোদ্ধারাও কুলিয়া ব্রিজের দক্ষিণ পাড়ে রাতের অন্ধকারে বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চ তৈরি করে সমবেত হতে থাকেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ খোন্তা, কোদাল ইত্যাদি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে সহায়তা করে। মা-বোনেরা বাড়িতে- বাড়িতে রুটি বানিয়ে ও খিচুড়ি রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
৫ই ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা কুলিয়া ব্রিজ সংলগ্ন পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন নবম সেক্টরের তিন সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম নূরুল হুদা, লে. মাহফুজ আলম বেগ ও ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার। সেনাবাহিনী ও ইপিআর সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার দুশতাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম আক্রমণেই ৪ জন পাকসেনা নিহত হলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হয়। পাকসেনাদের জন্য এ-যুদ্ধ ছিল মরণপণ লড়াই। তাই যুদ্ধের প্রচণ্ডতা ও গতি ছিল অত্যন্ত তীব্র। এ-যুদ্ধে ৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও কয়েকজন গুরুতর আহত হলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এক পর্যায়ে সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল যুদ্ধক্ষেত্রে এলে যুদ্ধ নতুন গতি পায় তাঁর নির্দেশনায় ভারী কামান নিয়ে শুরু হয় ত্রিমুখী আক্রমণ। কয়েক ঘণ্টা যাবৎ প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। পাকবাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ৬ই ডিসেম্বর অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। এর ফলে জাতীয় ও আন্তার্জাতিক পরিস্থিতি দ্রুত নতুন মোড় নেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনী নতুন অনুপ্রেরণা লাভ করে। অপরদিকে পাকবাহিনীর মনোবল মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। তারা রাতের অন্ধকারে কুলিয়া ব্রিজের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে সাতক্ষীরা শহরের উপকণ্ঠে বাঁকাল ব্রিজের নিকট ঘাঁটি স্থাপন করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রায় মনোবল ভেঙ্গে পড়া পাকহানাদার বাহিনী সেখানেও থাকতে না পেরে ডিনামাইট দিয়ে বাঁকাল ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়ে ৭ই ডিসেম্বর সাতক্ষীরা শহর ত্যাগ করে পাটকেলঘাটা বাজারে চলে যায়। পথে শহরের উপকণ্ঠে উত্তর দিকের বিনেরপোতা ব্রিজটি শক্তিশালী ডিনামাইট দিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে যায়। কুলিয়া ব্রিজ যুদ্ধ কিছুতেই সহজ ছিল না। কারণ এখানে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা অঞ্চলের বিভিন্ন ক্যাম্প ও ঘাঁটির সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্য জড়ো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে ছিল প্রচুর সংখ্যক রাজাকার ও ভারী অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার। তথাপি ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য অগ্রযাত্রায় বাঁধা দেয়ার মতো মনোবল তাদের আর ছিল না। [সিরাজুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড