You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কুলিয়ারচর উপজেলা (কিশোরগঞ্জ)

কুলিয়ারচর উপজেলা (কিশোরগঞ্জ) পাকিস্তান-বিরোধী স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও অসহযোগ আন্দোলন-এর মধ্য দিয়ে কুলিয়ারচরে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভৈরব-কুলিয়ারচর আসনে আওয়ামী লীগ-এর মনোনয়নে মো. জিল্লুর রহমান (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) এমএনএ এবং কুলিয়ারচরের সৈয়দ বদরুজ্জামান (এস বি জামান) এমপিএ নির্বাচিত হন। এঁদের নেতৃত্বে পালটিয়া গ্রামের সৈয়দ মো. মুছা, বরখাচর গ্রামের গণি মিয়া এবং দোয়ারিয়া গ্রামের রহমত আলী প্রধান-সহ একদল তরুণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঐকবদ্ধ হন। এঁদের বাইরে আওয়ামী লীগের ইউনিয়নভিত্তিক প্রথম সারির নেতারাও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন ইউনিয়নের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন: গিয়াস উদ্দিন (উসমানপুর), নাজমুল হুদা ওরফে জীবন মিয়া (সালুয়া), আব্দুল হাই (আগরপুর), আবদুল হাফিজ (মনোহরপুর), শামসুদ্দিন আহাম্মদ ওরফে কাসু মিয়া (মাধুয়ারচর), নূরুল ইসলাম খান (বড়ছয়সূতি), তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া(ছয়সূতি), আবদুল আজিজ মুন্সি (বীর কাশিমনগর), শামসুল আলম ভূঁইয়া (লক্ষ্মীপুর), জিন্নাত আলী মিয়া (পশ্চিম আব্দুল্লাপুর), মকবুল আহাম্মদ (ফরিদপুর), নূরুজ্জামান ওরফে আঙ্গুর মিয়া (নলবাইদ), আবদুল আওয়াল (খিদিরপুর), আবু তাহের (বীর কাশিমনগর) প্রমুখ। এছাড়া আব্দুল মালেক, নাসিরউদ্দিন, আবু সাঈদ ভূঁইয়া, শায়েস্তা খান, সাইফুল ইসলাম গোলাপ, রমিজ উদ্দিন ভূঁইয়া প্রমুখ সংগঠক হিসেবে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুলিয়ারচরে সশস্ত্র যুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কুলিয়ারচরের তরুণদেরও উজ্জীবিত করে। তারা সৈয়দ মো. মুছাকে সভাপতি ও শামসুদ্দিন আহাম্মদ কাসু মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: গণি মিয়া, শামসুল আলম ভূঁইয়া, আবদুল আজিজ মুন্সি, মকবুল আহাম্মদ প্রমুখ। তারাকান্দি গ্রামের নূরুল ইসলাম মঞ্জু, সালুয়া গ্রামের আবু সাঈদ এবং মাটিকাটা গ্রামের সাদেক মিয়া এ-ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মে মাসের প্রথম দিকে কুলিয়ারচরের বেশ কয়েকজন তরুণ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ফরিদপুর গ্রামের কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৮ জনের একটি দল আগরতলার অম্পিনগর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। এ দলে আরো ছিলেন: আব্দুল আজিজ (ফরিদপুর), সুরুজ মিয়া (ফরিদপুর), বরজু মিয়া (ফরিদপুর), মেরছি মিয়া (ফরিদপুর), রফিকুল ইসলাম আঙ্গুর (ফরিদপুর) এবং শামসুদ্দিন ইলিয়াস (সালুয়া)। নায়েক মো. মেজবাহ উদ্দিন (ভিটিগাঁও)-এর তত্ত্বাবধানে ও নুরুজ্জামান (নলবাইদ)-এর নেতৃত্বে আরেকটি দল আগরতলা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। এ দলের সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মো. গোলাম মোস্তফা (কান্দুলিয়া), ইপিআর সদস্য শামসুল আলম ওরফে লালু (সালুয়া) ও জিল্লুর রহমান (আলী আকবরী)। এঁদের পরে গোবরিয়া গ্রামের মো. জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ২৯ সদস্যের একটি দল আগরতলার হাপানিয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে এক মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ- দলে ছিলেন: মো. জসিম উদ্দিন (গোবরিয়া), মো. আসাদ উল্লাহ আসাদ (লক্ষ্মীপুর), সিরাজুল ইসলাম ওরফে আবিরাজ মাস্টার (কান্দুলিয়া), সোহরাব হোসেন আঙ্গুর (লক্ষ্মীপুর), হারিছ মাস্টার (লক্ষ্মীপুর), আব্দুল ওয়াহাব মাস্টার (বড়চারা), শামসুদ্দিন (জাব্বাপাড়া), হাবিবুর রহমান সাজনু (লক্ষ্মীপুর), মোজাম্মেল (বড়চারা), খালেক মাস্টার (বড়চারা), (বড়চারা), জয়নাল (আব্দুল্লাপুর), জিন্নত আলী মাস্টার (দশকাহনিয়া), জসিম উদ্দিন (পীরপুর), মুসলিম উদ্দিন (লক্ষ্মীপুর), রমিজ উদ্দিন (বড়চারা), সালাম, হারিছ মিয়া প্রমুখ। এসব দলের সঙ্গে বজলুর রহমান ও জজ মিয়ার দলও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়।
মে মাসের শেষদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভৈরব থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে সিদ্দিকচর
বাজারের ভেতর দিয়ে ফরিদপুর ভায়া-সালুয়া হয়ে কুলিয়ারচর যাওয়ার চেষ্টা করে। এ-সময় মধ্য-সালুয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এ-সময় এন্টিপার্সনাল মাইন বিস্ফোরণে একজন পাকসেনা আহত হয় (পরে সে মারা যায়), অন্যরা উপজেলা শহর কুলিয়ারচরে পালিয়ে যায়।
পাকসেনাদের দলটি কুলিয়ারচরে প্রবেশ করে মধুয়ারচর গ্রামে আগুন দেয়। গ্রামের লোকজন আগেই পালিয়ে গিয়েছিল বলে পাকসেনারা তাদের কাউকে নির্যাতন বা হত্যা করতে পারেনি। তবে তারা কুলিয়ারচর বাজারে ঢুকে স্থানীয় ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করে।
কুলিয়ারচরে এসে পাকবাহিনী অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করলে তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু দালাল যোগ দেয়। তারা পাকবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য শান্তি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির মদদে পাকবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টি হয়। বক্তরমারা রেলব্রিজের গোড়ায় তাদের একটি ক্যাম্প ছিল। তারা এলাকার সাধারণ নাগরিকদের ধরে এনে এ ক্যাম্পে অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। ক্যাম্পের রাজাকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: কমান্ডার মতি মিয়া (তাতারকান্দি), মুখলেছ (লালপুর), মাহবুব (খরকমারা), জমশেদ (বরখারচর), মুসলিম লীগ নেতা এ এফ এম নূরুল্লাহ (খরকমারা) প্রমুখ। এদের মধ্যে জমশেদ নৃশংসতার জন্য আজো কুলিয়ারচরবাসীর ঘৃণার পাত্র হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ-দের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এ সুযোগে এস বি জামান এমপিএ পাকবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। কুলিয়ারচরে স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিদের মধ্যে এস বি জামানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য স্বাধীনতার পর তাকে কারাবরণ করতে হয়। কুলিয়ারচরের আর এক কুখ্যাত রাজাকারের নাম জিলুর রহমান ওরফে হিরা মিয়া (সালুয়া)।
পাকবাহিনী কুলিয়ারচরে প্রবেশ করে পালটিয়া, গাইলকাটা, মধুয়ারচর প্রভৃতি গ্রামের নিরীহ মানুষদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। বহু গ্রামের মানুষকে নির্যাতন করে। নির্যাতনে অনেকের প্রাণহানিও ঘটে। নিহত কয়েকজন হলেন: মো. বাচ্চু মিয়া (পিতা জমশেদ মিয়া, তারাকন্দি), শ্রীবাস চন্দ্ৰ দেবনাথ (পিতা বীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, তারাকান্দি), সুনীল চন্দ্র দেবনাথ (পিতা নরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, তারাকান্দি), আব্দুল আওয়াল (পিতা রেয়াছত আলী, বীর কাশিমনগর), গোলাপ মিয়া (পিতা মধু মিয়া, পশ্চিম আব্দুল্লাপুর), ছন্দু মিয়া (পিতা সিরাজ মিয়া, লক্ষ্মীপুর), মো. জয়নাল (পিতা আবদুল আজিজ, পশ্চিম গোবরিয়া), লক্ষ্মীপুরের দুই ভাই মো. জারু মিয়া ও মো. জজ মিয়া (পিতা কনু মিয়া), আতাউর রহমান (পিতা আবু তাহের ভূঁইয়া, আদমখার কান্দি), বকুল মিয়া (মাতবরকান্দা), আবুল হাসিম (বড় ছয়সূতি), শওকত আলী (লোকমানখার কান্দি), ফালু বেপারী (ফরিদপুর), ডা. মো. রমিজ উদ্দিন (পিতা মো. জনাব আলী, দণি নন্দরামপুর), গিরীশচন্দ্র ভট্টাচার্য (কাপাসাটিয়া), আব্দুস সুবহান (বরখারচর), অনিল চন্দ্র ঘোষ (পিতা ধরণীকান্ত ঘোষ, ছয়সূতি), শুক্কুর মাহমুদ (পিতা ফারুক হোসেন, নাছিরাকান্দা), মমতাজ উদ্দিন (পিতা আবু সাঈদ ভূঁইয়া, বাজরা মাছিমপুর) এবং মো. রেণু মিয়া ওরফে লেনু (পিতা মো. সোনা মিয়া, লোকমানখার কান্দি)। পাকবাহিনীর দেয়া আগুনে ডুমরাকান্দা বাজারের আজিজ মুন্সির গুদাম, পালটিয়ার রশিদ মুন্সির বাড়ি, কাশিমনগরের সৈয়দ মুয়াজ্জেম হোসেন ওরফে টেনা মিয়ার বাড়ি, ভরাঢোল গ্রামের গজনবীর বাড়ি এবং সালুয়ার রমণী দাসের গুদামঘর পুড়ে যায়। কুলিয়ারচর বাজারস্থ ডাকবাংলো পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল।
জুলাই মাসের শেষদিকে একদল পাকসেনা কটিয়াদি থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বেলাবো যাওয়ার সময় সালুয়া মাদ্রাসা মাঠে রাত্রিযাপন করে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে পরদিন সকালে তাদের ওপর আক্রমণ করলে পাকসেনারা বেলাবোর দিকে পালাতে থাকে। তারা ভাঙারঘাটে পৌঁছলে বেলাবো উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। এতে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। এ ঘটনা ভাঙারঘাট আক্রমণ হিসেবে পরিচিত।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনাদের একটি দল ভৈরব থেকে এসে আগরপুর বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমপাশ দিয়ে পোড়াদিয়া-মনোহরদী যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে লক্ষ্মীপুর ফকিরপাড় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালান। এতে একজন পাকসেনা নিহত হয়। উপজেলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বক্তরমারা রেলব্রিজ অপারেশন। এ অপারেশনের ফলে ব্রিজটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় হানাদার বাহিনীর রেল যাতায়াত মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। এরপর এ এলাকা দিয়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হতো বলে প্রায়শই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হতো। ২৩শে অক্টোবর কুলিয়ারচর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম (পিতা আবুল হাসান মো. করিম উল্লাহ, খরগমারা), মোহাম্মদ আইনউদ্দিন, বীর প্রতীক (পিতা নাম সুরুজ আলী, লক্ষ্মীপুর), নিলু মিয়া, বীর বিক্রম- (পিতা সোনা মিঞা, ছয়মুতি), মো. সেলিম, বীর প্রতীক- (পিতা মো. আকবর আলী, কাশিমনগর) ও মো. নাজিমউদ্দিন, বীর প্রতীক- (পিতা আরব আলী মিয়া, চৌহদ্দি, কাপাসটিয়া)।
কুলিয়ারচরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন: নিলু মিয়া, বীর বিক্রম (দিনাজপুর-সৈয়দপুর সড়কের দশমাইল যুদ্ধে শহীদ), মো. সেলিম, বীর প্রতীক (প্যাড়াডাঙ্গায় শহীদ), হুমায়ুন, মজনু মিয়া (পিতা মুসলিম উদ্দিন, নোয়াপাড়া, উসমানপুর), মো. দরবেশ মিয়া (পিতা মো. সুলতান গণি, মনোহরপুর), মো. গোলাপ মিয়া (পিতা মধু মিয়া, পূর্ব আব্দুল্লাপুর), মো. গিয়াস উদ্দিন ভূঁইয়া (পিতা মো. আব্দুছ সাত্তার, নোয়াপাড়া, উসমানপুর), মো. ইসমাইল (পিতা মো. ইব্রাহিম, পীরপুর রামদী) এবং মো. সাহাব উদ্দিন (পিতা হাজী সৈয়দ আলী, মুজরাই আব্দুল্লাপুর)।
উপজেলা সদরে ‘স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ’ নামে মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। শহীদ সেলিমের স্মৃতি রক্ষার্থে সদরে শহীদ সেলিম স্মৃতি সংসদ গঠন করা হয়েছে। [শাদমান শাহিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!