You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজাকার কমান্ডার থেকে জনপ্রতিনিধি

একাত্তরে ফরিদপুরের নগরকান্দায় হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের মতাে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ওই এলাকার রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হােসেন খােকন ওরফে খােকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর এ রায় ঘােষণা করেন। রায়ে বলা হয়, জাহিদ হােসেন খােকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১১টি অভিযােগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযােগে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযােগের দায়ে ফাঁসির রায় এসেছে। এছাড়া ২, ৩, ৪ ও ১১ নম্বর অভিযােগে আটক, ধর্ষণ, ধর্মান্তর ও দেশান্তরে বাধ্য করা, মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটনে পরামর্শ ও সহযােগিতার দায়ে আসামিকে মােট ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জাহিদ হােসেন খােকনকে গ্রেফতার বা তার। আত্মসমর্পণের এই সাজা কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারপতি।

ফরিদপুরের নগরকান্দার মােতালেব মিয়া ও জয়নব বেগমের দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে জাহিদ হােসেন খােকন দ্বিতীয়। তার বড় ভাই জাফর হােসেনও একাত্তরে একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলাে, যে চাদহাটের যুদ্ধে ধরা পড়ে জনতা ও মুক্তিযােদ্ধাদের পিটুনিতে নিহত হয়। এ মামলায় প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মুক্তিযােদ্ধা আবুল কাশেমের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ওই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছিলাে মাওলানা মােহাম্মদ আলী। জাহিদ হােসেন খােকন ও তার বড় ভাই জাফর সে সময় মােহাম্মদ আলীর পক্ষে কাজ করে। একাত্তর সালের ২১ এপ্রিল নগরকান্দায় পাকিস্তানি বাহিনী এলে খােকন ও তার ভাই জাফর তাদের অভ্যর্থনা জানায়। এরপর জাফরের নেতৃত্বে। একটি এবং মাওলানা আবুল কালামের নেতৃত্বে আরেকটি মুজাহিদ বাহিনী গঠন। করা হয়। এ দুই বাহিনী পরে নগরকান্দার হিন্দুদের এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও সমর্থকদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয় বলে আদালতকে জানান কাসেম। স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থােকন ছিলাে আনসার বাহীনির সদস্য। ফরিদপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ‘৭১ সালের দশ মাস এবং মুক্তিযােদ্ধা মাে. সােলায়মান আলীর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ফরিদপুর বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে নগরকান্দার রাজাকার বাহিনীকে সুসংগঠিত করে তােলে খােকন ও তার ভাই জাফর। আর এ কাজে তারা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের কাছ থেকেও সহযােগিতা পেতাে।
পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে সে সময় খাড়াদিয়ায় নিজস্ব বাহিনী গড়ে তােলেন বাচ্চু, যা খাড়াদিয়ার মিলিটারি নামে পরিচিতি পায়। প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৯ মে চাদহাটে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে জাফর নিহত হলে নগরকান্দা রাজাকার বাহিনীর প্রধান হয় তার ভাই থােকন। নগরকান্দা সদরের কোদালিয়া-শহীদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মাে. রফিকুজ্জামান অনু বলেন, জাহিদ হােসেন খােকন বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, সে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার কমান্ডার ছিলাে। এ নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের গর্ববােধও ছিল। স্বাধীনতার পর খােকন আত্মগােপনে যায় এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খােকন এলাকায় ফিরে। সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবু সাঈদ খানের লেখা মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস-তৃতীয় খণ্ডে বলা হয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাহিদ হােসেন খােকনের বিরুদ্ধে দালাল আইনে একটি মামলাও দয়ের করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে জামায়াতঘনিষ্ট খােকন বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান জিয়াউর রহমানের আমলে। সর্বশেষ নগরকান্দা পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি হয়। সেই সূত্রে ২০১১ সালে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয় সে। এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযােগে তদন্ত শুরু হলে মেয়র হিসাবে শপথ নেওয়ার পরপরই নিরুদ্দেশ হয়। জাহিদ হােসেন খােকন। ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরুর পর সরকার তাকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নগরকান্দায় ব্যাপক লুটপাট ও হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করেন খােকন ও তার ভাই জাফর, যা ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষীদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে।
মামলার পূর্বাপর 
২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ২৮ মে পর্যন্ত জাহিদ হােসেন খােকনের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করে প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়। এরপর ২৯ মে তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ১৮ জুলাই অভিযােগ আমলে নিয়ে বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলে আদালতের নির্দেশে খােকনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে দুপি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপরও সে হাজির না হওয়ায় তার অনুপস্থিতিতেই আদালত মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলে। পলাতক খােকনের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে আব্দুস শুকুর খানকে আইনজীবী নিয়ােগ দেন বিচারক। ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর অভিযােগ গঠনের মধ্য দিয়ে খােকন রাজাকারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন দাসসহ ২৪ জন সাক্ষ্য দেন। আসামি পলাতক থাকায় তার পক্ষে কোনাে সাফাই সাক্ষ্যের সুযােগ ছিল না। ২০১৩ বছরের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা। সত্যরঞ্জন দাশসহ খােকন রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৪ জন সাক্ষী।
অন্য সাক্ষীরা হচ্ছেন আবুল কাসেম, কানাই লাল মণ্ডল, ইকরাম মােল্লা, মুক্তিযােদ্ধা মাে, আব্দুল হাই মােল্লা, মাে. ইউনুস মােল্লা, মাে. ইদ্রিস সরদার, আব্দুল আজিজ মাতুব্বর, মাে, হাফিজুর রহমান চানু, আলাউদ্দিন শেখ, রবীন্দ্রনাথ দত্ত, জগন্নাথ দত্ত, হান্নান মুন্সি, রমেশ চন্দ্র রায়, মাে. আবুল কাসেম মাতুব্বর, মাে. আব্দুস সালাম মাতুব্বর, কলম শেখ, মাে. ইয়াকুব আলী, মাে. চুন্ন শেখ, ভূক্তভােগী একজন নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), আব্দুল গফুর মােল্লা, মঞ্জুয়ারা বেগম, মাে. বতু মিয়া এবং জীবন কৃষ্ণ দাশ। ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরােধী অপরাধে খােকন রাজাকারের বিরুদ্ধে। অভিযােগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে থােকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ১৬ জন নারী ও শিশুসহ ৫০ জনকে হত্যা, তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা, ২ জনকে ধর্ষণ, ৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২টি মন্দিরসহ ১০টি গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ, সাতজন গ্রামবাসীকে সপরিবারে দেশান্তরে বাধ্য করা ও ২৫ জনকে নির্যাতনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযােগ আনা হয়েছে। ৫ ও ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযােগ গঠনের পক্ষে শুনানি রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকউটর মােখলেছুর রহমান বাদল। অন্যদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযােগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন খােকন রাজাকারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান। ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই থােকন রাজাকারকে হাজির হতে দু’টি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পলাতক খােকনের বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
কিন্তু সে হাজির না হওয়ায় ১৪ আগস্ট খােকন রাজাকারের অনুপস্থিতিতেই তার বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে খােকন রাজাকারের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী হিসেবে নিয়ােগ পান আব্দুস শুকুর খান। ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই প্রসিকউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযােগ আমলে নিয়ে বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৩ জুন প্রসিকউটর মােখলেসুর রহমান বাদল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর এ আনুষ্ঠানিক অভিযােগ দাখিল করে খােকন রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারির আবেদন করেছিলাে। ২৯ মে খােকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ১৩টি অপরাধে জড়িত থাকার অভিযােগে তদন্ত শেষ করে তদন্ত সংস্থা চিফ প্রসিকউটর বরাবর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন রায় এ মামলার তদন্ত করেন। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল শুরু হয়ে ২০১৩ সালের ২৮ মে শেষ হয় তদন্ত। তদন্তকালে এ মামলায় ৭৮ জনের বেশি লােকের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে।
খােকন রাজাকারের বিরুদ্ধে যত অভিযোেগ
অভিযােগ ১ একাত্তরের ২৭ শে এপ্রিল ভাের ৬টার দিকে খােকনের নেতৃত্বে তার বড় ভাই । জাফর ও সশস্ত্র রাজাকার সদস্যরা নগরকান্দা বনগ্রামে যায় তারা মুক্তিযােদ্ধা আবদুল হাই মােল্লা ও নাজিম উদ্দিন মােল্লার বাড়িসহ ছয় বাড়িতে লুটপাট চালায়। এছাড়া উমেদ মােল্লা, রতন মােল্লা, হাসেম মােল্লা, মাে. ইউনুস মােল্লাসহ ১৯। জনকে আটক করে তারা তাদের মধ্যে সাত্তার মােল্লা ও আজিজ শেখকে নির্যাতনের পরে ছেড়ে দেয়া হলেও বাকি ১৭ জনকে থানায় নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানাে হয়।
অভিযােগ ২ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৮ শে এপ্রিল থেকে ৬ই মের মধ্যে কোনাে একদিন পাকিস্তানি । দখলদার বাহিনীর সহযােগী হিসেবে খােকন ও তার নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনী। জগুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের কানাই লাল মণ্ডল ও আরেকজনের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ওই বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে এবং গ্রামের অন্য হিন্দুরা মুসলমান হলে বাড়িঘর ধ্বংস করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। এরপর কানাই লালের পরিবারের কাছ থেকে জোর করে ৫ হাজার টাকা এবং জীবন দাসের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয় তারা।
অভিযােগ ৩ একাত্তরের ১৬ থেকে ২৮শে মের মধ্যে কোনাে একদিন আসামি খােকন ও তার। ভাইয়ের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা একজন মৌলবীসহ জঙ্গুরদি-বাগুটিয়া গ্রামের জীবন দাসের বাড়ি যায়। তারা জীবন দাসসহ তার চার ভাইকে জোর করে মুসলিম করে তাদের মুসলিম নাম দেয়। পরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে নারী সদস্যদেরও তারা ধর্মান্তরিত করে।
অভিযােগ ৪ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ই মে সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে থােকন, তার ভাই জাফর ও রাজাকার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদের হাট গ্রামের বণিকপাড়ায় গিয়ে ১৬/১৭ জন হিন্দুকে হত্যার হুমকি দেয় এবং তাদের কাছ থেকে সােনার গয়না ও নগদ অর্থ কেড়ে নেয়। এরপর তাদের বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেয়। ওই গ্রামে আশ্রয় নেয়া এক নারীকে ধর্ষণ করেন খােকন। অন্য রাজাকার সদস্যরা এক কিশােরীকে ধর্ষণ করে।
অভিযােগ ৫ মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ শে মে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে খােকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আইনাল রাজাকার ও আরাে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে কোদালিয়া গ্রামের শহীদনগরে ঢােকে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন দেয়। আশেপাশে লুকিয়ে থাকা নারী ও শিশুসহ ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে খােকন ও তার সহযােগিরা। দেড় বছর বয়সি এক শিশুসহ অন্তত ছয়জন গুরুতর আহত হন। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানানােয় আলাউদ্দিন নামে এক কিশােরের হাত ভেঙ্গে দেয় খােকন। এছাড়া কোদালিয়া কওমি মাদ্রাসার কাছে। পাকিস্তানি সেনারা আফজাল হােসেন এবং কাছেই পাটক্ষেতে শুকুর শেখ নামে একজনকে খােকন নিজে গুলি করে হত্যা করে।
অভিযােগ ৬ একাত্তরের ৩০শে মে দুপুর দেড়টার দিকে খােকনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাসহ রাজাকাররা ঈশ্বরদী গ্রামে যায় এবং বাড়ি-ঘর ও দোকানপাটে আগুন দেয়। গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকা ভীত ও নিরস্ত্র প্রামবাসীকে গুলি করে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। এতে সালাম মাতবর, শ্রীমতী খাতুন, লাল মিয়া মাতুব্বর এবং মাজেদ মাতুব্বর নিহত হন।
অভিযােগ ৭ একাত্তরের ৩১ শে মে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে খােকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়ার শহীদনগর গ্রামের দীঘলিয়া-ঘােড়ানাড়া বিলে যায় দুদিন আগে ঐ এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের লাশ খুঁজতে। এ সময় পিজিরউদ্দিন, তার ভাই আফাজ ও তাদের প্রতিবেশী শেখ সাদেকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। তারা তিনজনই বাড়ির ভেতরে পুড়ে মারা যান। একইদিন সকাল ১০টার দিকে বনগ্রামে আবদুল হাই মােল্লা, ইকরাম মােল্লাসহ পাঁচজনের বাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। মেহেরদিয়া গ্রামের আসিরুদ্দিন মাতুব্বরকে মেহেরদিয়া পূর্বপাড়া জামে মসজিদ থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করে থােকন। পরে সফিজুদ্দিন মাতুব্বরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
অভিযােগ ৮ একাত্তরের ৩১শে মে খােকনের নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতার পক্ষের লােকজন, আওয়ামী লীগের কর্মী ও হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করতে গােয়ালদি গ্রামে যায়। প্রাণভয়ে পালাতে থাকা মানুষের দিকে তারা গুলি চালালে রাজেন্দ্রনাথ রায় নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। পরিবারের সঙ্গে পালাতে থাকা। কিশাের হান্নান মুন্সীর দুই বছরের বােন বুলু খাতুনকে তার মায়ের কোলে গুলি করে হত্যা করে থােকন ও তার সহযােগীরা।
অভিযােগ ৯। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩১ শে মে খােকনের নেতৃত্বে রাজাকার সদস্য ও পাকিস্তানি। সেনারা কুড়াপাড়া গ্রামে ঢুকে ছটু খাতুন, সফিজুদ্দিন শেখ, মানিক সরদার, রতন শেখ, জয়নুদ্দিন শেখ ও আবদুল বারেক মােল্লাকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করা হয়।
অভিযােগ ১০ একাত্তরের ১লা জুন ভােরে আসামি খােকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার, আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা এবং পাকিস্তানি সেনারা বাগত ও চুরিয়াচর গ্রামে গিয়ে লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের সমর্থক মিনি বেগমের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মালেক মাতব্বর, ভাই মােশাররফ মাতব্বর, দাদী, নানী ও আমজাদ মুন্সীকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া রতন। মাতব্বর, আইউব আলী ও মঞ্জু রাণীসহ ১০/১৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয় ।
অভিযোেগ ১১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে কোনাে একদিন খােকন রাজাকারের নেতৃত্বে আতাহার রাজাকার ও আয়নাল রাজাকারসহ অন্যরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে জগুরদিয়া-বাগুটিয়া গ্রামে কানাইলাল মণ্ডলের বাড়িতে যায়। কানাইলাল তাদের আসতে দেখে পাশের পাটক্ষেতে আত্মগােপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু খােকন রাজাকার সেখান থেকে তাকে ধরে এনে গুলি করে।

সূত্র : ফিরে-দেখা-৭১-যুদ্ধাপরাধীদের-বিচার-সুজন-হালদার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!