You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুমিরা প্রতিরোধযুদ্ধ (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম)

কুমিরা প্রতিরোধযুদ্ধ (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ২৬শে মার্চ। এতে ১৫৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ১৪ জন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন।
পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এর প্রধান নৌ-বন্দর চট্টগ্রাম। বহির্বিশ্বে সমুদ্রপথে যাগাযোগ এবং আমদানি- রপ্তানিসহ রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস এটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বন্দরটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। ২৫শে মার্চ কালরাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনাদের এক বিশাল কনভয় চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এটি ছিল পাকবাহিনীর ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-রেজিমেন্ট এবং ৮৮তম মর্টার ব্যাটারি। এ ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার ছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইকবাল সফি।
মুক্তিযোদ্ধারা শুভপুর ব্রিজটি ধ্বংস করে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করেন। তাছাড়া তারা শিল্পাঞ্চল কুমিরা এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ করারও প্রস্তুতি নেন। কুমিরা অঞ্চলটি অনেকটা ইংরেজি ‘ইউ’ বর্ণের মতো। পাহাড়-নদী খুবই কাছাকাছি এবং উত্তর-দক্ষিণে এর বুক চিড়ে লম্বালম্বি চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। পূর্বে পাহাড় ঘেঁষে রেল লাইন। ভৌগোলিকভাবে এটি সম্মুখ যুদ্ধের খুবই উপযুক্ত স্থান। এখানে পরপর তিনটি সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথম যুদ্ধে বাঙালি জওয়ানরা বিজয় লাভ করেন। দ্বিতীয় যুদ্ধটি ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ১৫ কিলোমিটার জুড়ে এবং সর্বশেষ যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ডিসম্বরে মাসে।
২৫শে মার্চ রাতে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের শতাধিক সৈনিক আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে কুমিরা স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে অবস্থান নেন। থানা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. আখতারুজ্জামানসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের চিকিৎসাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করেন। ইতোমধ্যে হালিশহর ক্যাম্প থেকে আরো কিছু ইপিআর সৈনিক পালিয়ে এসে এখানে অবস্থান নেন। তাঁদেরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। রাত ৩-৪টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা পাকিস্তানি সোয়াত জাহাজ থেকে ৩টি ট্রাক বোঝাই করে বাঙালি সৈনিকরা অস্ত্র নিয়ে আসেন। রাতভর কুমিরা স্কুলের ছাত্ররা এসব অস্ত্র ট্রাক থেকে খালাস করে কিছু ডা. আখতারুজ্জামানের বাসায়, কিছু কুমিরা স্কুল সংলগ্ন খালের ঝোপঝাড়ে ও মাটিতে পুঁতে রাখে। ঐ রাতে পাকসেনাদের কনভয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের প্রতিরোধে মুক্তিযোদ্ধারা রাতভর চেষ্টা চালিয়ে শুভপুর ব্রিজটি বিকল করে দেন। পরে ব্রিজটি আংশিক মেরামত করে পাকিস্তানি সেনাদল ২৬শে মার্চ সকাল ১১টার মধ্যে বারৈয়ারহাট এলাকায় পৌঁছে।
থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি ও মসজিদ্দা স্কুলের প্রধান শিক্ষক এম এ মামুন, কুমিরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফায়েল আহম্মদ, সাধারণ সম্পাদক মো. রফিক এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আহম্মদ হোসেন সওদাগর পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় প্রতিরোধ করার জন্য স্থানীয় সেনাদের প্রতি সর্বাত্মক আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দ ছোট কুমিরা বাইক্কা পুলের পশ্চিমে এবং নবাব মিয়া চৌধুরীর বাড়ির দক্ষিণে মহাসড়কে অবস্থিত শতবর্ষীয় অশ্বত্থ বৃক্ষটি কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২৬শে মার্চ দুজন কাঠুরিয়া কুমিরা হিঙ্গুরী পাড়ার কোব্বাত আলীর ছেলে সাদু মিয়া ওরফে সদুবলী এবং তার সঙ্গী নুর হোসেন গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় বিশাল গাছটি কেটে ব্যারিকেড তৈরি করে।
২৬শে মার্চ সকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খায়ের হোসেন ছুটিতে আসা বাঙালি সৈনিক মুরাদপুরের গুপ্তাখালী গ্রামের সুবেদার আবুল মুনছুরকে ডা. আখতারুজ্জামানের বাসায় ডেকে এনে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো দেখান। এর মধ্য থেকে শতাধিক রাইফেল, এসএমজি ও ২০-২৫ কার্টুন গুলি পৃথক করেন। ঐদিন সকাল ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া চট্টগ্রাম থেকে এক ইপিআর জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে কুমিরা এসে পৌঁছান। তিনি ডা. আখতারুজ্জামানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এক পর্যায়ে তিনি একটি মোটরসাইকেলযোগে তিনটি সম্ভাব্য স্পটও দেখে আসেন।
পাকবাহিনীর কনভয়টি পথে-পথে প্রতিরোধকারীদের অসংখ্য বাধা অতিক্রম করে ২৬শে মার্চ বিকেল ২টার দিকে সীতাকুণ্ডুর দারোগাহাট এলাকায় এসে পৌঁছে। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য স্থানীয় জনতা হালকা দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা ও লোহার রড জড়ো করে ট্রাঙ্ক রোডে অবস্থান নেয়। সীতাকুণ্ডু থানা ছাত্রলীগ নেতা এস এম হাসান, এ কে এম সালাউদ্দীন, শামছুল আলম টিপু ও তাহের হোসেন বর্ণালী ক্লাবে এসে নিজেদের উদ্ভাবিত দেশীয় প্রযুক্তি দিয়ে হাতবোমা তৈরি করে সাধারণ জনতাকে সরবরাহ করতে থাকেন। দুপুর আড়াইটার দিকে পাকসেনারা সীতাকুণ্ডু বাজার অতিক্রম করে। সাহসী স্কুল ছাত্র শামছুল আলম টিপু পেট্রল বোমা নিয়ে সীতাকুণ্ডু বাজারস্থ সিএন্ডবি অফিস লাগোয়া প্রকাণ্ড আমগাছটির ডালে চড়ে বসে। তার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি সেনা কনভয় ঐ পথ অতিক্রমকালে পেট্রল বোমা ছুড়ে মারা। কিন্তু কনভয়ের বিশালতা দেখে সে তাৎক্ষণিক পেট্রল বোমা ছুড়ে মারা বন্ধ রাখে।
কনভয় আরো কাছাকাছি আসার খবর পেয়ে প্রতিরোধকারীরা বাড়বকুণ্ডস্থ চিটাগাং কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের সম্মুখে অবস্থিত ব্রিজটিতে বিস্ফোরণ ঘটালে ব্রিজটির অংশবিশেষ ধ্বংস হয়। শ্রমিক নেতা এ টি এম নিজামউদ্দিন ও রহমত উল্ল্যাহর নির্দেশে ব্রিজটিতে শ্রমিকরা বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকসেনা কনভয় ধীরগতিতে ভাঙা ব্রিজটি পার হয়। তারা রাস্তার দুধারে অবস্থিত দোকানে ওড়ানো কালো পতাকা নামিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ঐ সময় বাড়বকুণ্ড ইউপির মহাদেবপুর (দীঘিনামা) গ্রামের সাদাকাৎ উল্লাহর পুত্র বদিউল আলম বাদশা পাক কনভয়ের ওপর রাসায়নিক পদার্থ নিক্ষেপ করে। কিন্তু বোতলটিতে যে রাসায়নিক পদার্থ ছিল না, সে তা জানত না। ফলে তা অকার্যকর হয়। এরপর সে দুই পাকসেনাকে জাপটে ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পাকসেনারা তাকে গুলি ও বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে।
পাকসেনারা আরো চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ছোট কুমিরার মছজিদ্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মুখে এসে পৌঁছে। তারা পাথর ও গাছের গুঁড়ি সরিয়ে সামনে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রতিরোধকারী যুবক আবু তাহের পাকসেনাদের পাথর ছুড়ে মারে। সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা গুলি চালায়। এতে তাহের গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়।
পাকবাহিনী দীর্ঘ সময় ধরে অশ্বথ গাছের ব্যারিকেড সরানোর চেষ্টা করে। তারা গাছটির ডালপালার ওপর দিয়ে গাড়ি পার করতে চেষ্টা করে। এতে অস্ত্রভর্তি একটি গাড়ি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ে এবং ব্যাপক পরিমাণ গোলা-বারুদ বিস্ফোরিত হয়। অবশেষে তারা রাস্তার উত্তর পাশ লাগোয়া খাদে শনের আঁটি ফেলে একটি বিকল্প সড়ক নির্মাণ করে ২ ঘণ্টার মতো চেষ্টা চালিয়ে গাড়ি পার করে। এ পর্যায়ে তারা নিজেদের রণকৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনে। তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে কিছু মহাসড়ক, কিছু রেললাইন ধরে অগ্রসর হতে থাকে। কিছুটা দক্ষিণে গেলেই বামে যাদুর বিল। যাদুর বিলের বুক চিড়ে চলে গেছে যক্ষ্মা হাসপাতাল রোড, স্টেশন রোড ও পরির রাস্তা। সামনে ট্রাঙ্ক রোডের বামে উম্মেদ আলী ফকির দীঘি। এ দীঘির পূর্ব-দক্ষিণ দিক ঘেঁষে কামাল ড্রাইভারের বাড়ি। এ বাড়ির সামনে যাদুর বিলের ফাঁকা মাঠটিতে কুমিরার যুদ্ধটি সংঘটিত হয়।
কুমিরা খালের উত্তর প্রান্তে পাকিস্তানি কনভয়। অন্যদিকে দক্ষিণ প্রান্তে স্বল্প সংখ্যক আনসার, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। গুল আহমদ জুট মিলস থেকে পালিয়ে আসা কিছু আনসার সদস্য তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। জোড়ামতলের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য রাজা মিয়া ড্রাইভার, বিমান সেনা রুস্তম আলী, আনসার কমান্ডার সৈয়দ হারেছ আহমদ, নিয়ামত আলী, আনসার সদস্য কোরবান আলী, জাফর আহমদ, জাহাঙ্গীর আলম, সোনাইছড়ি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, থানা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. আখতারুজ্জামান, ইউসুফ আলী, বদিউল আলম সওদাগর ও সেকান্দর সওদাগরসহ গ্রামবাসীরা ইপিআর জওয়ানদের উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকে। ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়াসহ সৈনিকরা কয়েকটি খোলা ট্রাকে করে যুদ্ধের ময়দান কুমিরার দিকে অগ্রসর হন। ঐ সময় জনতা রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ও করতালি দিয়ে তাদের সাহস যোগাতে থাকে। জনতা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মো. ইসহাক এমপিএ ও ডা. আখতারুজ্জামানের কাছ থেকে কিছু গোলা-বারুদ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে।
ইপিআর সৈনিকরা খালের ওপর ব্রিজটির দক্ষিণ প্রান্তে শতবর্ষী একটি তুলাগাছ আড়ালে রেখে ধুনাড্রামে, টিবি হাসপাতালের সম্মুখে ছয়টিলার ওপর, ডালচালমিয়া মসজিদের পেছনে ও কমিউনিটি সেন্টারে একটি করে মেশিনগান উত্তর দিকে শত্রুর নিশানা বরাবর স্থাপন করেন। কিন্তু পাকসেনা কনভয়ের রণকৌশল দেখে তাঁরা দ্রুত অগ্রবর্তী ডিফেন্স সরিয়ে নেন। শুধু থেকে যান ছয়টিলার গানম্যান। দ্রুত তিনি উম্মেদ আলী ফকির বাড়ির সম্মুখে যাদুর পুকুরপাড় ও ছিড়া পাহাড়ে স্থাপিত ডিফেন্সের সঙ্গে যুক্ত হন। কমান্ডিং-এ ছিলেন তরুণ ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। তিনি ফোর্সকে ৩টি প্লাটুনে ভাগ করেন। একজন সুবেদার, একজন নায়েক সুবেদার ও একজন হাবিলদারকে কমান্ডারের দায়িত্ব দেন। তাঁরা দেখতে পান সামনে শত্রুদের নিশানা, পেছনে গাড়ি বহর ধেয়ে আসছে।
মাগরিবের পরপর পাকসেনারা স্টেশনরোড-পরির রাস্তা অতিক্রম করতেই ইপিআর সৈনিকদের স্টেনগান গর্জে ওঠে। ঝড়ের গতিতে শত্রুর নিশানায় স্টেনগানের গুলি বিঁধতে থাকে। এ অবস্থায় ঊর্ধ্বতন একজন পাকসেনা ক্রলিং করে এগিয়ে যাচ্ছিল। ইপিআর সৈনিকদের গুলিতে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পাকিস্তানি সৈনিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। গোলা-বারুদ ভর্তি একটি কনভয়ে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন জ্বলে ওঠে। এতে পাকবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহপুর খান ও অপর একজন অফিসারসহ মোট ১৫৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। শহীদ হন ১৪ জন ইপিআর জোয়ান। কিছু পাকসেনা ইপিআর-দের এম্বুশ ভেদ করে দক্ষিণে ঘোড়ামরা রেলওয়ের ডিপোতে অবস্থান নেয়। বাকি কিছু সৈনিক নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইকবাল সফি পাহাড়ের অরণ্যে লুকিয়ে পড়ে। কুমিরা প্রতিরোধযুদ্ধ স্মরণে ‘স্মৃতি-৭১’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [জামসেদ উদ্দীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!