You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুমিরা যুদ্ধ (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম)

কুমিরা যুদ্ধ (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় দুবার – ২৭ ও ২৮শে মার্চ এবং ১৪-১৬ই ডিসেম্বর। প্রথমবারের যুদ্ধে উভয় পক্ষে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে ৮-১০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধের পরেই পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে।
২৬শে মার্চ কুমিরা প্রতিরোধ যুদ্ধ- পরাজয়ের পর কিছু পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ অতিক্রম করে ঘোড়ামরা এলাকায় অবস্থান নেয়। তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও দলছুট হয়ে পড়ে। সংখ্যায় ১০-১২ জন হবে। রাতভর তারা রেলওয়ের ডিপোতে অবস্থান নেয়। ২৭শে মার্চ ভোর থেকেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ জনগণের মধ্যেও উত্তেজনা দেখা দেয়। রেলওয়ের ডিপো লাগোয়া আওয়ামী লীগ নেতা খায়ের হোসেন চেয়ারম্যানের বাড়ি। চেয়ারম্যান নিজে এবং স্থানীয় যুবক মো. নিজাম উদ্দিন, দোস্ত মুহাম্মদ, জহুর আহমদ, শামছুল হুদা চৌধুরী, শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন সর্দার ও ওবায়দুল হক সর্দারসহ শিল্প-কারখানার শ্রমিক সাধারণ জনগণ লাঠিসোঁটা নিয়ে সকাল থেকে সেখানে জড়ো হতে থাকে। তাদের মধ্যে শ্রমিক নেতা ওবায়দুল হক সর্দ্দারের কাছে একটি, জহুর আহমদের কাছে একটি এবং খায়ের হোসেন চেয়ারম্যানের কাছে একটি দোনলা বন্দুক ছিল। এক পর্যায়ে খায়ের হোসেন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জনতা পাকবাহিনীকে ধাওয়া দেয় এবং মাঝে-মধ্যে বন্দুকের গুলিও ছুড়তে থাকে। পাকসেনারাও পাল্টা গুলি চালায়। এতে প্রতিরোধযোদ্ধা দোস্ত মুহাম্মদ ও কামাল উদ্দিন শহীদ হন এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন জহুর আহমদ ও মাহমুদ মিয়া কেনু। এদিকে পাকসেনারা আলীবিল ও মৌলই সাঁকো পার হয়ে কুমিরা ঘাটঘর এলাকায় গিয়ে পৌছে। সেখানে দুই সহোদর নুরুল আনোয়ার ও ভোলা সহ ৩ জন ইপিআর সৈনিক পূর্ব থেকে অবস্থান করছিলেন। স্থানীয় শতাধিক যুবক তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। যুবকদের সহযোগিতায় পাকসেনাদের প্রতিরোধ করেন ইপিআর সৈনিকরা। কিছু পাকসেনা দলছুট হয়ে কুমিরা খাল দিয়ে পার হয়ে উত্তর দিকে জমাদার পাড়ার খোলা মাঠে এলোপাতাড়ি দৌড়াতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন পাকসেনাকে ধরে নিয়ে উত্তেজিত জনতা সন্দ্বীপ চ্যানেলে গুলি করে হত্যা করে। বাকিরা সুলতানা মন্দির পথে ট্রাঙ্ক রোড পার হয়ে পূর্ব পাশে পাহাড়ে লুকিয়ে পড়ে। এ-সময় পাকসেনাদের গুলিতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার মসজিদ্দা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র কামাল উদ্দিন নিহত হয়।
এদিকে সন্দ্বীপ ফেরিঘাটে যে-সকল পাকসেনা অবরুদ্ধ ছিল, তাদের উদ্ধারে আরো কিছু পাকসেনা পাহাড়ে অবস্থিত যক্ষ্মা হাসপাতাল থেকে নেমে আসে। সঙ্গে-সঙ্গে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এতে আলেকদিয়া গ্রামের মো. এখলাছ উদ্দিনসহ ৫ জন প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদ হন এবং মারাত্মভাবে অহত হন লঘু নামের স্থানীয় এক জেলে। তখনো ফেরিঘাটের আইডব্লিউটি-র দ্বিতল ভবন থেকে থেমে-থেমে গুলি বর্ষিত হচ্ছিল। পাকসেনারা পাহাড় থেকে ওই ভবন লক্ষ করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। ভবনটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে একজন ইপিআর সৈনিক মেশিনগান নিয়ে অবস্থান নেন। কৌশলগত কারণে তিনি সাড়াশব্দ না করে এম্বুশ নিয়ে বসে থাকেন। ৩ জন পাকসেনা ভবনটির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর মেশিনগান গর্জে ওঠে। তাঁর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে ঘটনাস্থলে ২ জন পাকসেনা নিহত ও একজন পাক কমান্ডিং অফিসার মারাত্মকভাবে আহত হয়।
পরবর্তীতে পাকসেনারা কুমিরা ঘাটঘরের ভবনটি ঘেরাও করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে সেখানে অবস্থানরত ইপিআর সৈনিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এদিনের যুদ্ধে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ ২০০ জনের অধিক পাকসেনা নিহত হয়। এরপর কুমিল্লা- ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুমিরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কনভয় অগ্রসর হয়। ২৭শে মার্চ বিকেল ৪টার দিকে সীতাকুণ্ডুর টেরিয়াল এলাকায় ভাঙা ব্রিজটির কাছে এসে কনভয়টি আটকা পড়ে। এ সংবাদ পেয়ে মাওলানা আজাহারের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যোদ্ধারা ব্রিজটি ভেঙে দেন। ফলে এ পথে পার হতে না পেরে মহালঙ্কাবিল হয়ে সন্ধ্যার মধ্যে পাককনভয়টি কুমিরায় পাকসেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় বাঙালি নায়েক শফিউল আলম চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭২ জন সৈনিক নিয়ে এসে ঘোড়ামরা থেকে পশ্চিমে সমুদ্র ও পূর্বে পাহাড় পর্যন্ত উত্তরমুখী ডিফেন্স স্থাপন করেন। এ খবর পাকবাহিনীর ক্যাম্প টিবি হাসপাতালে পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে সেখান থেকে তাঁদের লক্ষ করে কয়েক দফা মর্টার শেল ছোড়া হয়। মর্টার শেলের আঘাতে ঘটনাস্থলে শহীদ হন স্থানীয় প্রতিরোধ যোদ্ধা আমিন শরিফ। ২৮শে মার্চ সকাল ৮টার দিকে ঘোড়ামরাস্থ মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স ক্যাম্প থেকে ২১ নম্বর পাক বেলুচ রেজিমেন্টের ওপর মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি। সেখানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩৫ জন সৈনিক ছাড়াও ১১ জন প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- আজিজুল হক, নুরুল ইসলাম লেদন, আবদুল হক, নুরুল আলম, আবু বক্কর সিদ্দিকী, এমদাদ সর্দার, আমিন শরিফ, বাদশা মিয়া, মোহাম্মদ ইউসুফ ও অজ্ঞাত ২ জন।
নায়েক শফিউল আলম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪-৫ জন সৈনিক নিয়ে উত্তর দিকে গুল আহমদ জুট মিলস্ সংলগ্ন তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান নেন। বিকেল ৪টার দিকে তিনি পুনরায় ঘোড়ামারায় ফিরে আসেন। এরপর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শহীদ সৈনিকদের পরিত্যক্ত অস্ত্রগুলো নিয়ে সদর সীতাকুণ্ডুর দিকে ছুটে যান। পাকসেনারা যায় চট্টগ্রামের দিকে। সন্ধ্যার মধ্যেই তারা চট্টগ্রামের কর্নেলহাট এলাকায় পৌঁছে বার আউলিয়া দরগাহ্ শরীফ এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ করে। পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন হালিশর ১১নং উইংয়ে কর্মরত ইপিআর সৈনিক ফজল মিয়া (ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট) এবং অজ্ঞাত অপর একজন ইপিআর সৈনিক। পূর্ব থেকে মাজারের উত্তর-পশ্চিম পাশে বটবৃক্ষের ওপর অবস্থান নেন ২ জন ইপিআর সদস্য। তাঁরা পাকবাহিনীকে লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। সঙ্গে-সঙ্গে একজন পাকসেনা নিহত হয়। এরপর হাফিজ জুট মিলস্ এলাকায় পাকবাহিনী ও ইপিআর সৈনিকদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। সেখানে ৩ জন ইপিআর সৈনিক শহীদ হন।
পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে একজন ইপিআর সদস্য মাদামবিবিহাটস্থ অশ্বত্থ বৃক্ষের ডালে বসে এম্বুশ নেন। পাকসেনারা নিশানায় এলেই তিনি ঝড়ের গতিতে বোমা ও গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। এতে পাকবাহিনীর একটি লরি বিস্ফোরিত হয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের গতি কিছুটা থেমে যায়। পাকসেনারা ক্ষাণিকটা দূর থেকে উক্ত ইপিআর সদস্যকে গুলি করলে তিনি শহীদ হন। পাকবহর প্রতিরোধ করার জন্য ভাটিয়ারি ইউপির ৫নং তেলিপাড়া ও দক্ষিণ জাহানাবাদ গ্রামের গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের শতশত শ্রমিক লাঠিসোঁটা নিয়ে লালপুল এলাকায় জড়ো হয়। এ-সময় পাকবাহিনী খাদ্যবোঝাই একটি পিকআপে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে সেটি উড়িয়ে দেয়। এ পরিস্থিতিতে জনতা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেয়। ইপিআর সৈনিকরা চট্টগ্রাম থেকে এসে ট্রাঙ্করোড বাংলাবাজার, সলিমপুর ওয়ার্লেস টাওয়ার সংলগ্ন এলাকা ও ফৌজদারহাটে প্রতিরোধযুদ্ধে সামিল হন। এসব স্থানে ৬০ জনের মতো ইপিআর সৈনিক প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৭ জন আহত হন।
ইতোমধ্যে ফৌজদারহাট বাজারে উপস্থিত হয় ১৩টি পাকিস্তানি সেনাবাহী লরি। এর মধ্যে ৩টি লরিতে ছিল এ্যামুনিশন বিস্ফোরক। ৫০ জনের মতো পাকসেনা পায়ে হেঁটে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ১০টি লরিতে ৩ শতাধিক পাকসেনা এবং সামনে দুটি জিপ পাকিস্তানি পতাকা বহন করে এগিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় চেয়ারম্যান নুরুল আলম পাকিস্তানি বহর আসার খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেন। পাকসেনারা পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে দূরপাল্লার অস্ত্র নিক্ষেপ করে অগ্রবর্তী দলকে এগিয়ে যাওয়ার পথে কভারিং দিতে থাকে। আড়াল থেকে মুক্তিযোদ্ধারাও সঙ্গীদের নিরাপদে যাওয়ার জন্য মাঝে-মধ্যে গুলি চালাতে থাকেন। অবশেষে উভয় পক্ষ মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। ইপিআর সৈনিকদের কেউ-কেউ রাস্তার ধারে ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে এবং গাছের ডালে বসে প্রতিরোধের চেষ্টা চালান। তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে একে- একে আত্মাহূতি দিতে থাকেন। ৯ জন ইপিআর সৈনিক এ যুদ্ধে শহীদ হন। একজন চাকমা ইপিআর সৈনিক গাছের ডালে বসে হানাদারদের রুখতে চেষ্টা করেন। বহু পাকসেনা এ বীরের গুলিতে প্রাণ হারায়। এক ঘণ্টার মতো যুদ্ধ স্থায়ী হয়। এ-যুদ্ধে ঐ এলাকার ১০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। তারা হলেন- কালা জলদাস, নাইদ্যা জলদাস, মাস্টার করিম আহাম্মদ, ছালেহ আহম্মদ, নূর হোসেন, ফকির আহম্মদ, রসুল হক, হাজী সিরাজ, শামছুল হক মোল্লা ও বাদশা মিয়া। সুবেদার রউফের নেতৃত্বে ২২ জন ইপিআর সৈনিক ট্রাকযোগে উত্তরমুখী কালু শাহ (রহ.) মাজারের সম্মুখে প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। ট্রাকের সামনে ছিলেন আব্দুর রউফ। তাঁর ব্রাশ ফায়ারে অগ্রবর্তী পাকবাহিনীর ট্রাকটি প্রতিহত হয়। শত্রুপক্ষ সঙ্গে-সঙ্গে ঝড়ের গতিতে ফায়ার ওপেন করে। পাল্টা জবাব দিয়ে দ্রুত পজিশন নেন ইপিআর সৈনিকরা। পাকবাহিনীর গুলি রউফের ডান কনুই ও কব্জিতে আঘাত হানে। ডানে-বামে কভারিং ফায়ার চেয়ে তিনি এলএমজি ম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি দেখতে পান S এলএমজি ম্যান মৃত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। অদূরে ৮ জনের মৃতদেহ। সুবেদার রউফ গড়িয়ে পড়েন ওভার ব্রিজের ২০ ফুট নিচে। তখন চারদিক থেকে তাঁর ওপর পাকিস্তানি সেনাদের গুলি বর্ষিত হচ্ছিল। দুপাশে নিচু ভূমি ও ঢালু ঝোপঝাড় থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের জীবন রক্ষা পায়। তাঁরা রেললাইন ধরে পূর্বদিকে কলাক্ষেতের আড়ালে আশ্রয় নেন। স্থানীয় ইকবাল মিস্ত্রি আহত রউফকে একটি ঘরে আশ্রয় দেন। ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আহত অবস্থায় যক্ষ্মা হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ৩ জন শহীদ হন। শহীদ ইপিআর সৈনিকরা হলেন- নায়েক রুহুল আমিন, ল্যান্স নায়েক আবুল খায়ের ও আবদুল অদুদ।
সন্ধ্যায় আবারো পাকিস্তানি কনভয় ইপিআর সৈনিকদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় পাকা রাস্তার মাথায়। ৩ শতাধিক ইপিআর সৈনিক লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে এসে সমবেত হন। সেখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাদের গুলি বিনিময় হয়। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে কয়েকজন ইপিআর সৈনিক শহীদ এবং ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়।
কুমিরার দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় ১৪-১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর পূর্বে ১০ই ডিসেম্বর ফেনী হানাদারমুক্ত হয়। ১২ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ১১ রেজিমেন্ট মিরসরাই শুভপুর ব্রিজ পার হয়ে জোরারগঞ্জ পৌঁছে। সন্ধ্যার মধ্যে তারা সীতাকুণ্ডুর দারোগারহাট এলাকা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে নেয়। সবশেষে পন্থিছিলায় এসে পাকবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী মুখোমুখি হয়। এখানে মুফাক্কর গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা ৪ জন পাকসেনাকে আটক করেন এবং তাদের মুক্তিবাহিনীর সীতাকুণ্ডু ল্যাবরেটরি ক্যাম্পে সোপর্দ করেন। এর আগে মিত্রবাহিনী যখন সীতাকুণ্ডুর দারোগারহাট এলাকায় এসে পৌঁছে, মুক্তিবাহিনী তখন তাঁদের সঙ্গে একত্রিত হয়। পিস্তল সিরাজ গ্রুপ ও মুফাক্কর গ্রুপও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। থানা কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন জাফর ইমামসহ মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনন্দস্বরূপ জাফরনগর স্কুলে মিলিত হন। সেখানে তাঁরা পরবর্তী রণকৌশল নির্ধারণ নিয়ে বৈঠক করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা সীতাকুণ্ডু স্কুলে লুকিয়ে থাকা আরো এক পাকসেনাকে আটক করেন। রেলওয়ে ডোবার উত্তর-পূর্ব কোণে কয়েকজন পাকসেনার মৃতদেহ পড়ে ছিল। ধারণা করা হয় মিত্রবাহিনীর শেলিংয়ে তাদের মৃত্যু হয়। ১৩ই ডিসেম্বর ভোররাতে পাকবাহিনী বাড়বকুণ্ডুর গান্ধারা ও বাঁশবাড়িয়া এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে পিছু হটে। তারা চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছোট কুমিরার বাইক্কারপুল এলাকা থেকে দক্ষিণে ফৌজদারহাট পর্যন্ত তারা সারি-সারি বাঙ্কার স্থাপন করে। কুমিরা টিবি হাসপাতালে পাকবাহিনীর শক্ত ডিফেন্স ছিল। ১৩ই ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে সীতাকুণ্ডু থেকে ৪ কিমি দক্ষিণে বাঁশবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সাময়িক যাত্রাবিরতি করে। সেখানে এক পাকসেনা আহত অবস্থায় আটক হয় এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়।
মিত্রবাহিনী চূড়ান্ত লড়াইয়ে যাওয়ার আগে বাঁশবাড়িয়াস্থ এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরীর বাড়িতে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করে। মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনন্দস্বরূপ, মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও থানা কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাউদ্দিনের উপস্থিতিতে যৌথবাহিনীর এ বৈঠক হয়। বৈঠকে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার বিস্তারিত রণকৌশল ঠিক করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সদস্যরা চার ভাগে ভাগ হয়ে অগ্রসর হবে। একটি গ্রুপ পাহাড় ঘেঁষে, দ্বিতীয় গ্রুপ রেললাইন ধরে, তৃতীয় গ্রুপ মহাসড়ক-ট্রাঙ্ক রোড ধরে এবং চতুর্থ গ্রুপ সমুদ্রের বেড়িবাঁধ দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হবে। ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাউদ্দিন তাঁর বাহিনীকে বাঁশবাড়িয়া এলাকায় অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন।
মিত্রবাহিনীর ৩১নং জাঠ রেজিমেন্ট কুমিরার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ই ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে সম্মুখ যোদ্ধা (ওপি) নায়েক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের রেজিমেন্টের সঙ্গে আরো ৩টি রেজিমেন্ট একত্রিত হয়ে অগ্রসর হয়। কিন্তু সামনে প্রচণ্ড বাধা ছিল। ছোট কুমিরার শিল্পপতি অহিদুল হকের সিলভার ফ্যাক্টরি এলাকায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। নবাব মিয়া চৌধুরী বাড়ির উত্তর পাশে মুক্তিযোদ্ধা আলি আহম্মদ গুলিবিদ্ধ হন। মারাত্মক আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করা হয়। সকাল ১০টার দিকে শিল্পপতি অহিদুল হক, ছেলে ও ফ্যাক্টরির দুই কর্মচারী পাকসেনাদের মর্টার শেলের আঘাতে মারা যান। যৌথবাহিনী ১৪ই ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে কুমিরা শত্রুঘাঁটির ওপর প্রচণ্ডভাবে বোমা হামলা শুরু করে। উভয় পক্ষের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলা চলে। মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনন্দস্বরূপের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি ও মিত্রবাহিনীর দলকে সেখানে রেখে বাকিদের নিয়ে কুমিরা পাহাড় হয়ে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা দেন। ১৫ই ডিসেম্বর দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছান। বিকেল ৪টার মধ্যে মিত্রবাহিনীর আরো ২টি রেজিমেন্ট একত্রিত হয় এবং তাঁরা ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কুমিরা ব্রিজ এলাকা রেলক্রসিং পার হতেই মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার সিরাজ ও মান্নান পাকবাহিনীর বাঙ্কারগুলো দেখতে পান। হাবিলদার সিরাজ পাকবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি শর্ট ফায়ার করেন। মিত্রবাহিনীর কমান্ডার ফৌজকে পজিশনে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পাকবাহিনীর ক্যাম্প কুমিরা হাসপাতাল থেকেও ফায়ার আসতে থাকে। পেছন দিক থেকে পাকবাহিনীর দুটি শক্তিশালী ফৌজ এসএমজি ও এলএমজি নিয়ে মিত্রবাহিনীর ওপর ঝড়ের গতিতে হামলা শুরু করে। মিত্রবাহিনীর কমান্ডারের নির্দেশে তাঁরা পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। নায়েক সিরাজ ৩৬নং হ্যান্ড গ্রেনেডের সেফটি পিন খুলে পাকবাহিনীর বাঙ্কারের দিকে নিক্ষেপ করে এগিয়ে চলেন।
ক্যাপ্টেন গাফফারের অধীনে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি দল রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম রোডে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা দেয়। ১৫ই ডিসেম্বর তারা হাটহাজারী থেকে ৩-৪ মাইল দূরে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সঙ্গে এসে মিলিত হন। মিত্রবাহিনীর কমান্ডার কুমিরা পাকবাহিনীর ঘাঁটির ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। ১৬ই ডিসেম্বর সকাল হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই শত্রুদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। পাকবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে। দুপুর নাগাদ পাকবাহিনীর ওপর আবারো আক্রমণ চালানো হয়। সেখান থেকে নতুনপাড়া ক্যান্টনমেন্টের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। মিত্রবাহিনী ও লে. দিদারের নেতৃত্বাধীন ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি কুমিরায় পাকবাহিনীর ঘাঁটির ওপর হামলা চালায়।
কুমিরা যুদ্ধে টিবি হাসপাতালে স্থাপিত পাকবাহিনীর ডিফেন্সের সর্বশেষ পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধা ফছিউল আলমের বোমা হামলায় নিহত হয়। এ পাঞ্জাবি সৈনিক মেশিনগান দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। ক্যাপ্টেন এনামের নির্দেশমতো ফছিউল আলম সতর্কতার সঙ্গে টিবি হাসপাতাল ক্যাম্প এলাকায় পাহাড়ের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের খনন করা বাঙ্কারগুলো একের পর এক পরীক্ষা করে দেখেন। সবই খালি, শুধু একটি বাঙ্কার থেকে ফায়ার আসছে। তিনি বাঙ্কারের পেছনে গিয়ে বোমার মুখ খুলে ভেতরে নিক্ষেপ করেন। একটু পরে শুনতে পান আর্তচিৎকার। মিত্রবাহিনীও শত্রুর নিশানায় একের পর এক আঘাত হানতে থাকে। টিবি হাসপাতালের সামনে মন্দির সংলগ্ন পাকবাহিনীর বাংকারে মিত্রবাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে ৮-১০ জন পাকসেনা প্রাণ হারায়।
মিত্রবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হরগোবিন্দ সিং তাঁর কোম্পানি নিয়ে বিকেল ২টার মধ্যে কুমিরায় এসে পৌঁছান। তখন পাকবাহিনী কিছুটা পিছু হটে বারআউলিয়া নামক স্থানে অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনীর এই কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আজিজ ও নাজিম উদ্দিন অগ্রভাগে ওপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সুবেদার আজিজসহ তাঁর কোম্পানি খুব সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে থাকে। তাঁদের কোম্পানি কাসেম জুট মিলসের সম্মুখে নিয়াজী পুকুরপাড়ে বাঙ্কার স্থাপন করে। তখন বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট। ঢাকাসহ সারা দেশে যুদ্ধ থেমে গেছে। পাকবাহিনীর শেষ অবস্থান মাদামবিবিরহাটস্থ ইছামতি খালের ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্তে। পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা ব্রিজটি ভেঙ্গে দেয়। ঐ সময় মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ড থেকে নির্দেশ আসে পাকবাহিনীকে আত্মসমপর্ণের আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করার। মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে পাকসেনাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য লিফলেট ছাড়া হয়। লিফলেটে জানানো হয় পাকবাহিনীর কমান্ডিং প্রধান আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন স্পিকারের সাহায্যে ‘হ্যালো হ্যালো’ বলে উঠতেই পাকবাহিনীর নিক্ষিপ্ত কামানের একটি গোলা সুবেদার আজিজ ও তাঁর কোম্পানির ওপর এসে পড়ে। এতে ১৫ বছরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম, সুবেদার আজিজ, মুরাদপুর ফকিরহাটের লেদু মিয়া ড্রাইভার ও কুমিরা কাজীপাড়ার সালেহ আহম্মদ প্রাণ হারাণ। আহত হন মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন মারাত্মক আহত অবস্থায় তাঁকেসহ নিহতদের উদ্ধার করে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঘটনাস্থল থেকে দেড় কিমি উত্তরে ইছামতি খাল এলাকায় পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে। মাদামবিবিহাটের ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজটির দক্ষিণ দিক থেকে এক পাকিস্তানি মেজর একটি সাদা পতাকা উড়িয়ে হাঁটতে-হাঁটতে চলে আসে খালের পাড় পর্যন্ত। ১নং সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম এদিক থেকে এগিয়ে যান। মাঝখানে বিধ্বস্ত ব্রিজ ও ইছামতি খাল। পাকিস্তানি ঐ সেনা অফিসার মেজর রফিকুল ইসলামকে নিয়াজির কাছ কাছ থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাওয়ার কথা জানান। এরপর মেজর হাদীসহ এক এক করে পাকসেনারা সবাই আত্মসমর্পণ করে। [জামশেদ উদ্দীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!