মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা (কুমিল্লা)
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা (কুমিল্লা) একটি রাজনীতি-সচেতন এলাকা। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা সংঘটিত এবং বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে এখানে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। সত্তর সালের নির্বাচনে কুমিল্লা সদর থেকে অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ এবং মো. আবদুল মালেক এমপিএ নির্বাচিত হন। এঁরা দুজনই ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পরপর এর প্রতিবাদে কুমিল্লার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মিছিল বের করে। ২রা মার্চ ঢাকা থেকে কুমিল্লায় কোনো রেল যাতায়াত করেনি এবং কোনো সংবাদপত্রও আসেনি।
১লা মার্চ এ কে এম সামসুল হক খান কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- আহূত হরতাল পালনের উদ্দেশ্যে একই দিন এডভোকেট আহমেদ আলী এমপিএ-এর বাসভবনে তাঁর সভাপতিত্বে জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২রা মার্চ আবদুর রশীদ ইঞ্জিনিয়ার এমপিএ- এর বাসভবনে অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ-এর সভাপতিত্বে একটি সর্বদলীয় সভা হয়। ৩রা মার্চ সকালে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত মিছিল বের হয়। এরপর জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক আবদুল আউয়াল এমএনএ-এর বাসভবনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটি সভা হয়। এ সভায় পরবর্তী দিনগুলোতে হরতাল পালন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে আলোচনা হয়। ৩রা মার্চ কেবল যানবাহন ও ব্যবসায়ী মহল নয়, সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, পোস্ট অফিস ও রেলস্টেশনের কর্মচারীরাও নিজ-নিজ কাজ থেকে বিরত থাকেন। এদিন বিকেলে স্থানীয় টাউন হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রনেতা নবনির্বাচিত সহ-সভাপতি শাহ আলম। সভায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। ৪ঠা মার্চ হরতালের দ্বিতীয় দিন ভোর থেকে যান চলাচল বন্ধ থাকে। বাসা ও ঔষধের দোকান ছাড়া সড়ক সংলগ্ন সকল ঘরের দরজা বন্ধ থাকে। স্কুল-কলেজের ফটকে তালা ঝুলতে থাকে। সারা শহরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৫ই মার্চ কুমিল্লা কোটবাড়িস্থ কারিগরি মহাবিদ্যালয় ও কুমিল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে শাহ আলম মজুমদারকে আহ্বায়ক, মো. ইয়াহিয়াকে সহ- আহ্বায়ক ও আবু বাচ্ছেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ৮ সদস্যের একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় কুমিল্লায়ও একটানা পাঁচদিন হরতাল পালিত হয়। ৬ই মার্চ হরতালের শেষদিন কুমিল্লা শহরে সর্ববৃহৎ মিছিল বের হয়। ঐদিনের মিছিলে স্কুল-কলেজের ছাত্র, বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও সরকারি কর্মচারীরাও অংশগ্রহণ করেন। ঐদিন মহিলা ও ছাত্রীদের দুটি মিছিল শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। ছাত্রীদের মিছিল শেষে ফরিদা বিদ্যায়তন এবং টাউন হলে দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৮ই মার্চ বিকেলে স্থানীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় বিভিন্ন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করেন এবং তাঁরা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো ব্যবসায়ী যাতে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে খাদ্যদ্রব্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য গুদামজাত করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টির পায়তারা না করতে পারে সে ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। কুমিল্লা জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহসভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক আকবর কবির খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত না করার আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। এদিন টাউন হল ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। -অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো কুমিল্লায় ব্যাংকগুলো দৈনিক সংক্ষিপ্ত সময়ে লেনদেন ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করত। ১২ই মার্চ বেলা তিনটায়
ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বামইল স্কুল প্রাঙ্গণে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আবদুল মতিন। বক্তৃতা করেন কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অলি আহমদ, ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আকবর কবির, সহিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ। ১৩ই মার্চ শনিবার বিকেল ৩টায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বেলতলী স্কুল প্রাঙ্গণে এক জনসভা হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ। সভায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন ছাত্রনেতা আকবর কবির, ছাত্রলীগ নেতা সহিদুল হক চৌধুরী এবং শওকত আহসান ফারুক। ১৪ই মার্চ বিকেল ৩টায় আবু তাহেরের সভাপতিত্বে কালিরবাজার স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ। সভায় মুক্তিবাহিনী গঠন করার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার, ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রনেতা আকবর কবির, সহিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ। ১৫ই মার্চ কোতোয়ালি থানার শিমপুর গ্রামে সংগ্রামী জনতার এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুল মজিদ ভূঁইয়া। সভায় বঙ্গবন্ধু আহূত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন সফল করার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করেন অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ, অধ্যাপক আবদুর রউফ, আলী তাহের মজুমদার প্রমুখ। ১৬ই মার্চ শহর আওয়ামী লীগ প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রউফের সভাপতিত্বে কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ কার্যকর সংসদের এক জরুরি অধিবেশনে কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হন অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ। কমিটির সদস্য হন আবদুল মালেক এমপিএ, ডা. সুলতান আহমদ, মোহাম্মদ আবদুর রউফ ও আফজল খান। ১৮ই মার্চ কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি কাজী জহিরুল কাইয়ুম এমএমএ। সভায় অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ-কে জেলা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়। ১৭ সদস্যবিশিষ্ট এ সংগ্রাম পরিষদে তিনটি বিভাগ রাখা হয়। অর্থনৈতিক বিভাগের আহ্বায়ক ডা. সুলতান আহম্মদ, গণসংগ্রাম বিভাগের আহ্বায়ক এডভোকেট মীর হোসেন চৌধুরী এবং সাংগঠনিক বিভাগের আহ্বায়ক হন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রউফ। কুমিল্লা পশুপালন গবেষণাগারের অফিসার এবং কর্মচারীবৃন্দ ১৮ই মার্চ এক সভায় মিলিত হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগ সাহায্য তহবিলে একদিনের বেতন দানের সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে মার্চ কুমিল্লা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে শহরের সকল সরকারি ও বেসরকারি বাড়িতে এবং যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। এদিন ৩টায় ছাত্রলীগ কুমিল্লা জেলা শাখার এক জরুরি কাউন্সিল অধিবেশন জেলা সভাপতি সৈয়দ আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে নগর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। একই দিন কুমিল্লা জেলায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সৈয়দ আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক ও রুস্তম আলীকে সম্পাদক করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ২১শে মার্চ বিকেলে স্থানীয় টাউন হল ময়দানে শহর আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে শহরের প্রতিটি মহল্লার কর্মীরা সমবেত হয়। গোলাম হোসেন কুচকাওয়াজ পরিচালনা করেন। কুচকাওয়াজ শেষে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে কাজী জহিরুল কাইয়ুম এমএনএ, অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ, আবদুল মালেক এমপিএ, ডা. সুলতান আহাম্মদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রউফ ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবক ও জনতাকে উদ্দেশ্য করে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলি ও স্বেচ্ছাসেবকদের কর্তব্য বিশ্লেষণ করে বক্তৃতা করেন। ২৩শে মার্চ প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বিকেলে কুমিল্লা শহর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী ও জাতীয় শ্রমিক লীগের এক সম্মিলিত কুচকাওয়াজ ও মিছিল শহরের বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে। এদিন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রচেষ্টায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি ভ্রাম্যমাণ গণসঙ্গীতের আয়োজন করা হয়। একটি খোলা ট্রাকে চড়ে শিল্পীরা শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ২৪শে মার্চ কুমিল্লা চৌধুরীপাড়া ও গাংচর মহল্লায় ‘সূর্য শিখা সংগ্রামী পরিষদ’ নামে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের সভাপতি ও সম্পাদক পদে যথাক্রমে অধ্যাপক তাজুল ইসলাম ও মো. আবদুন নূর বাচ্চু নির্বাচিত হন। ৯ সদস্যের একটি কার্যকর পরিষদ গঠন করা হয়।
মার্চের প্রথম দিকেই কুমিল্লা জেলার নানা স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরম্ভ হয়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ মাঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মাধ্যমে ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানের উদ্যোগে কুমিল্লা মডার্ন স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আফজাল খানের প্রচেষ্টায় ক্যাডেট রেজা (লেফটেন্যান্ট রেজা নামে পরিচিত) প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমিল্লা মহিলা কলেজ, কুমিল্লা কলেজ-সহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু হয়।
৭ই মার্চের পর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদারের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণ চলে কুমিল্লার সীমান্তবর্তী কোটেশ্বর গ্রামে। ২৬শে মার্চের পর ইপিআর সদস্যদের মধ্যে বিদ্রোহ সংঘটনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ কাজে নেতৃত্ব দেন ওয়াহিদুর রহমান। তাঁর বাড়ির সামনেই ছিল বড়জালা সীমান্ত। বড়জালা-সহ সন্তোষ, খাররা, শালদা নদী, নয়নপুর ও বিবিরবাজার ইপিআর বিওপিতে বাঙালি সেনাসদস্যদের কাছে চিঠি লিখে তাঁদের ক্যাম্পের পাকিস্তানি বা অবাঙালিদের আটক করে কোটেশ্বরে সমবেত হতে আহ্বান জানানো হয়। বিওপিতে সাধারণ সৈন্যরা ছিল বাঙালি, আর হাবিলদার, নায়েক বা সুবেদারদের বেশির ভাগ ছিল অবাঙালি। চিঠি পাওয়ার পর বাঙালি ইপিআর সদস্যরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করে নিজ- নিজ বিওপি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নেন। নির্দেশ অনুযায়ী সব ক্যাম্পের পাকিস্তানি ও অবাঙালি ১৫-১৬ জনকে হত্যা বা আটক করা হয়। তাঁরা সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে কোটেশ্বরে আসেন। কিন্তু বড়জালা বিওপিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ওয়াহিদুর রহমানের নেতৃত্বে ২ জন বাঙালি ইপিআর সদস্য সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যাম্পে ইপিআর সদস্যদের সফল বিদ্রোহ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে কোটেশ্বরে মুক্তিবাহিনীর প্রথম ক্যাম্প স্থাপিত হয়। অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএমএ-সহ রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং প্রতিবাদী ছাত্রজনতা শহরের ৮- ৯ কিলোমিটার উত্তরে কোটেশ্বরে সমবেত হন। ক্যাডেট রেজাকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২রা এপ্রিল তিনি সীমান্তের ওপারে বিএসএফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিএসএফ-এর মেজর চৌহান, মেজর আব্রাহাম, মেজর ভারত ভূষণ, ক্যাপ্টেন আরিফ এবং ক্যাপ্টেন চাওলা সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত এ ক্যাম্প চালু ছিল।
কুমিল্লা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতৃবৃন্দের মধ্যে খলিলুর রহমান ফরিদ ও কাজী মমতাজ উদ্দিনের উদ্যোগে সিপিআই-এর সহায়তায় সীমান্তবর্তী সোনামুড়া গ্রামে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ন্যাপ নেতা ফয়েজউল্লাহ সোনামুড়া ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র-যুবকদের সংগ্রহ করে সোনামুড়া ক্যাম্পে পাঠাতেন। আগরতলা ক্র্যাফট ইনস্টিটিউট হোস্টেলে এ বিশেষ যৌথ গেরিলা বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠার পর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে কেন্দ্ৰীয় ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন, সরদার আবদুল হালিম, কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি আবদুস সালাম, খোকা রায়, অনিল মুখার্জী প্রমুখ নেতা সোনামুড়া ট্রানজিট ক্যাম্পে এসে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন ন্যাপ কুমিল্লা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফয়েজউল্লাহ। কমিটির সদস্য ছিলেন খলিলুর রহমান ফরিদ, আবদুল হাফেজ এবং মাসুদুর রহমান।
যুদ্ধ শুরুর পূর্ব থেকেই কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান ছিল। বাঙালিদের মধ্যে আশংকা ছিল সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করবে। আবদুল মালেক এমপিএ পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কুমিল্লা জেলা প্রশাসক এ কে এম সামসুল হক খান ও পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। ২২শে মার্চ কুমিল্লার সামরিক কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে কুমিল্লা সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। সেনানিবাসের বৈঠকের পর পুলিশ সুপার পুলিশ লাইন্স অস্ত্রাগারের সমস্ত অস্ত্র পুলিশ সদস্যদের মাঝে বণ্টন করার নির্দেশ দেন। একই সময়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউজে অসহযোগ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপিত হয়।
২৩-২৪শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক হামলা হতে পারে এরূপ আশঙ্কা ছিল। সে অনুযায়ী ছাত্রনেতৃবৃন্দ প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজন স্বতঃস্ফূর্ত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ময়নামতি সেনানিবাস থেকে শহরে প্রবেশের রাস্তা এবং শাসনগাছা রেল ক্রসিংয়ে বেরিকেড স্থাপন করে। রাত দ্বিপ্রহরে ছাত্রনেতৃবৃন্দ শহরের বাদুড়তলা, কান্দিরপাড়, রাণীর বাজার ও টমসম ব্রিজ এলাকায় গাছের গুঁড়ি, ইট, ভাঙ্গা পাইপ, ওয়াপদা অফিসের ডজ গাড়ি ও বাস দিয়ে বেরিকেড সৃষ্টি করেন। টমসম ব্রিজের রাস্তার পাশে ফেলে রাখা বাস রাস্তার ওপর নিয়ে ব্যাটারি ফেলে দেয়া হয় এবং চাকা পাংচার করা হয় যেন গাড়িগুলো সহজে রাস্তা থেকে সরানো না যায়। নেতৃবৃন্দ বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এসব কাজে যুক্ত ছিলেন আলী রেজা খুরশিদ রাজু, খলিলুর রহমান ফরিদ, আবদুল মান্নান মজুমদার, জাকির হোসেন, হুমায়ুন কবির মজুমদার, কমরেড আবদুল হাফেজ, এ কে মাইনুল হুদা, নাজমুল হাসান পাখি, রুস্তম আলী প্রমুখ ছাত্রনেতা। কিন্তু ভোররাতে হানাদার বাহিনী রাস্তা থেকে গাড়িগুলো ক্রেন দিয়ে সরিয়ে ফেলে এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে সেগুলো তছনছ করে দেয়। ২৫শে মার্চ বিকেলে ময়নামতি সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা সিলেট ও চট্টগ্রাম যাচ্ছে এ সংবাদ পেয়ে ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, আনসার আহমদ ও রুস্তম আলী ম্যালেয়িরা অফিস থেকে একটি জিপ নিয়ে এসে বালুতুপায় স্থানীয় গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এরপর তাঁরা সুয়াগঞ্জে একটি কালভার্ট ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেন। কালভার্ট ভাঙ্গতে না পেরে চৌয়ারার উত্তর দিকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বিরাট দুটি বটগাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড সৃষ্টি করা হয়। শ্যামবক্সীর ব্রিজে কোরাসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। তবে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই পাকিস্তানি সেনা ইউনিটগুলো সেনানিবাসের সকল বাঙালি সেনা এবং তাঁদের পরিবার- পরিজনকে বন্দি করে ফেলে। রাত সাড়ে ১০টার মধ্যেই পাকিস্তানের পদাতিক ও গোলন্দাজ ইউনিটগুলো কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। ২৫শে মার্চ রাতে ময়নামতি সেনানিবাস থেকে একজন বাঙালি অফিসার টেলিফোনে আবদুল মালেক এমপিএ-কে জানান যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাতে কুমিল্লা শহর আক্রমণ করবে। এ সংবাদ পেয়ে পুলিশ বাহিনী শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৫শে মার্চ বিকেল থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের সংবাদ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সন্ধ্যা থেকে কুমিল্লা পুলিশ লাইনের সকল সদস্য সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেন। এ-সময় কুমিল্লা পুলিশ লাইনে প্রায় ৩০০ পুলিশ সদস্য ছিল।
অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএমএ-এর নেতৃত্বে কুমিল্লা শহরের সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ শহরের বিভিন্ন রাস্তায় গাছ, ইট, ড্রাম ইত্যাদি ফেলে বেরিকেড সৃষ্টি করেন। কুমিল্লা পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন ড. আবদুস সাত্তার, অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএনএ, আহাম্মেদ আলী এমপিএ প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শামসুল হক খানের নির্দেশে পাকবাহিনীকে রেশন প্রদান ও তাদের ব্যবহৃত গাড়িতে পেট্রল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। কুমিল্লা ব্রিগেড কমান্ডার ইকবাল শফির নেতৃত্বে সেনাসদস্যরা পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করতে গেলে এসপি কবিরউদ্দিন ডিসির নির্দেশ ছাড়া স্টোরের চাবি দিতে অপারগতা জানান। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য স্থানীয় সামরিক আইন প্রশাসক জেলা প্রশাসককে ডেকে পাঠায়। কিন্তু তিনি সাড়া দেয়া থেকে বিরত থাকেন। এতে পাকিস্তানি সেনারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়।
কুমিল্লায় অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমএমএ, কাজী জহিরুল কাইয়ুম এমএনএ, ডা. সুলতান আহমদ, আবদুল মালেক এমএনএ, আহাম্মেদ আলী এমপিএ, মীর হোসেন চৌধুরী, ফয়েজউল্লাহ, আবুল কালাম মজুমদার, মোহাম্মদ আবদুর রউফ এবং ছাত্রনেতাদের মধ্যে ওমর ফারুক, নাজমুল হাসান পাখী, রুস্তম আলী, সৈয়দ আবদুল্লাহ পিন্টু, জহিরুল হক দুলাল, আনসার আহমেদ প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক ছিলেন।
যুদ্ধের সময় ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠিত হলে একই সময় এর কুমিল্লা কমান্ড গঠিত হয়। বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিযুক্ত হন মোস্তাফিজুর রহমান। সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব পালন করেন মো. জাকির হোসেন।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ কুমিল্লা সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখে। কুমিল্লার গণসঙ্গীতশিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তী ও কুলেন্দু দাস অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মুক্তিযোদ্ধাদের ও সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক উদ্যোগ ছিল খুবই প্রেরণাদায়ী। ইউনিসেফ-এর। পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপুরার উদয়পুর মহকুমা প্রশাসনের আন্তরিক ইচ্ছায় ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমএনএ-কে প্রধান উপদেষ্টা ও সুখেন্দু চক্রবর্তীকে সভাপতি করে স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ গঠিত হয়। উদয়পুর টাউন হলে এর প্রথম অনুষ্ঠানে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ, ডেপুটি স্পিকার এরশাদ আলী চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও দেশকে স্বাধীন করার দীপ্তমন্ত্রে উজ্জীবনের লক্ষ্যে সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গণসঙ্গীতের এ দল সেদিন সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তাঁরা মেলাঘর, কাকড়াবন শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও মুক্তাঞ্চলে অবিরাম জাগরণী গান পরিবেশন করেন। তখন সুখেন্দু চক্রবর্তীর গীত গানের মধ্যে ছিল ‘যুদ্ধ যুদ্ধ বাংলায় যুদ্ধ’, ‘ইতিহাস জান তুমি/ আমরা পরাজিত হইনি’, ‘ওরা নাকি আমাদের ক্ষেত আর খামারের সবুজের স্বপ্ন কেড়ে নিতে চায়’ ইত্যাদি। ডিসেম্বরের শেষদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- উদয়পুর রাজারবাগ শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সুখেন্দু চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘মুজিব বাইয়া যাও রে/ নির্যাতিত দেশের মাঝে/ জনগণের নাও রে মুজিব বাইয়া যাও রে’ গানটি শুনে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ইন্দিরা গান্ধী ভূয়সী প্রশংসা করেন।
মুক্তিযুদ্ধে আগরতলার নিকটবর্তী পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবিরে গণসঙ্গীতশিল্পী কুলেন্দু দাসের নেতৃত্বে ও তবলাবাদক শেফাল রায়-এর সহযোগে গঠিত হয় স্বাধীনতা সঙ্গীত দল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গণসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান রচনা ও সুরারোপ করে তাঁরা সদলে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও যুব শিবিরে গান পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেন। শিবিরগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির, গোমতী যুব শিবির, দুর্গা চৌধুরীপাড়া যুব শিবির, ইছামতি যুব শিবির ইত্যাদি। কুলেন্দু দাস রচিত ও গীত গানের মধ্যে ‘চল ভাই মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাই’, ‘হায়রে নিদয়া ইয়াহিয়া’, ‘আমাদের বাংলা মা স্বাধীন হল রে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কুলেন্দু দাস প্রায় প্রতিরাতেই শরণার্থী শিবিরে
গানের আসর বসাতেন।
জনমনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশের শরণার্থী শিল্পী-সংস্কৃতি কর্মীদের নিয়ে আগরতলায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে। নৃত্যশিল্পী এ কে এম আজিজুল্লাহ চকলেট ছিলেন এ সংগঠনের আহ্বায়ক। ৫১ সদস্যবিশিষ্ট এ সংগঠনে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সংস্কৃতি কর্মীরাও যুক্ত ছিলেন। সংগঠনটি পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন ক্যাম্প ও যুব শিবিরে উদ্দীপনামূলক সঙ্গীত, নাটক ও নৃত্য পরিবেশন করত। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে মুক্তিফৌজের শিবিরে দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান হতো। ১৭ই জুন বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের এক অস্থায়ী শিবিরে একটি অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আজিজুল্লাহ চকলেট। এ দলে কুমিল্লার সংগীতজ্ঞ অসিত চৌধুরী, তাঁর সন্তান গীতশ্রী চৌধুরী, জয়শ্রী চৌধুরী, রূপশ্রী চৌধুরী, অরুণ চৌধুরী প্রমুখ সম্পৃক্ত ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে ২৫শে মার্চ রাতে কুমিল্লা পুলিশ লাইনের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালায়। পুলিশ সদস্যরা আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। সারারাত ধরে যুদ্ধের পরও পাকিস্তানি বাহিনী প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশ লাইনে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য হতাহত হওয়ায় তাঁদের পক্ষে অবস্থান ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বেশকিছু পুলিশ সদস্য পাশের ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। অনেকে পুলিশ লাইনে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেন।
পুলিশ লাইনের পতনের মধ্য দিয়ে কুমিল্লা শহরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ক্রমে থানা সদর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ময়নামতি সেনানিবাসে পাকবাহিনীর ডিভিশনের প্রধান কার্যালয় ছিল। এখান থেকে পাকবাহিনী এ অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও হত্যাযজ্ঞের পরকল্পনা করত। কুমিল্লা সার্কিট হাউজ ছিল সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর হোসেন আতিফ সেখান থেকে পুরো জেলার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সদর থানার রসুলপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এসব স্থান থেকে তারা হিন্দু ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ওপর হত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করত।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই কুমিল্লায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কুমিল্লা জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিল সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আজিজুর রহমান। কুমিল্লায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্য সহযোগীদের মধ্যে দলিলুর রহমান (পিডিএম), সাজেদুল হক (নেজামে ইসলামী), আবদুল মজিদ, আব্দুল হাকিম, এডভোকেট আলী আকবর, হাসমতুল্লাহ খান, শামসুল আলম, মুজিবুর রহমান, হারুনুর রশীদ, আজিজুর রহমান, নুরুন্নবী চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কুমিল্লায় শান্তি কমিটির অফিস ছিল টাউন হল মাঠের পশ্চিমে।
কোতয়ালি থানা শান্তি কমিটির আহ্ববায়ক ছিল আবুল বাশার। কুমিল্লা জেলার সর্বত্র শান্তি কমিটি ও রাজাকার-দের ব্যাপক তৎপরতা ছিল। তাদের উৎসাহিত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জে. নিয়াজী ১৩ই অক্টোবর কুমিল্লা সফর করে এবং কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকসেনাদের উদ্দেশে চরম উস্কানিমূলক ভাষণ দেয়।
কুমিল্লা জেলায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক, মেজর সুলতান, মেজর মোহাম্মদ ইয়াসিন খন্দকার, মেজর গার্দিজি, ক্যাপ্টেন জাহিদ জামাল, ক্যাপ্টেন ইফতেখার হায়দার শাহ, ক্যাপ্টেন নাসিম মালিক, ক্যাপ্টেন আগা বোখারী এবং সুবেদার মেজর ফয়েজ সুলতান।
২৫শে মার্চ কালরাত থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লায় হত্যাকাণ্ড শুরু করে। তারা থানা হেডকোয়ার্টার্স-সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আক্রমণ চালায় এবং কারফিউ জারি করে। কুমিল্লায় তাদের প্রধান টার্গেট ছিল পুলিশ লাইন্স। এরপর তারা কুমিল্লা শহর ও সদর উপজেলার অন্যান্য স্থানে গণহত্যা এবং নানা ধরনের নির্যাতন চালায়।
২৫শে মার্চের পর পাকিস্তানি বাহিনী ছাত্রনেতা রুস্তম আলীর পৈতৃক বাড়ি এবং আবদুল মালেক এমপিএ-র ভাই আবদুর রশিদের ‘রশিদ মঞ্জিল’ বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। ২৬শে মার্চ সকালে কুমিল্লা শহরের লাকসাম রোডে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে কিশোর আবুল হোসেনের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। আবুলের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় কুমিল্লার সড়ক।
২৫শে মার্চ রাত দেড়টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও মর্টার থেকে পুলিশ লাইনের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশ সদস্যদের কাছে তখন সামান্য অস্ত্র ছিল। তাঁরা এসব অস্ত্র ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। চারদিক অন্ধকার থাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আকাশে ট্রেসার বুলেট ছুড়ে এলাকা আলোকিত করে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান চিহ্নিত করে। পাকসেনাদের অবিরাম গুলিতে পুলিশের ৩১ জন সিপাহি ও কর্মকর্তা শহীদ হন। এ হত্যাকাণ্ড কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স গণহত্যা নামে পরিচিত কুমিল্লার রামমালা সড়কস্থ সার্ভে ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে আনসার-মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এখানে প্রায় ৩৫০ জন বাঙালি আনসার-মুজাহিদ প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিষ্ঠুর গণহত্যা চালায়। সার্ভে ইনস্টিটিউট গণহত্যায় প্রশিক্ষণরত আনসার-মুজাহিদদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর দেড় শতাধিক আনসার- মুজাহিদের লাশ এখানে মাটিচাপা দেয় এবং বাকিদের লাশ ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার কর্নেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার, সৈনিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মচারী, স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, গৃহবধূ, এমনকি মসজিদের ইমামকে পর্যন্ত হত্যা করা হয়। ২৯শে মার্চ সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সংঘটিত ময়নামতি সেনানিবাস গণহত্যায় ৩ শতাধিক লোক প্রাণ হারান। সেনানিবাসে হত্যার শিকার হন কুমিল্লার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এম সি রায় চৌধুরী, অসীম শান্তি রায়, যতীন্দ্রনাথ ভদ্র-সহ অনেকে।
২৯শে মার্চ সন্ধ্যায় মেজর সুলতান আহমদ খানের নেতৃত্বে একদল পাকসেনা বাঙালি আবাসগুলোতে ঢুকে ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলের ১১ জন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে কলেজের উপাধ্যক্ষ-সহ সিনিয়র শিক্ষকরা ছিলেন। পরে পাকবাহিনী উপাধ্যক্ষের ছেলে-সহ আরো ৩ জনকেও আটক করে। এ ১৪ জনকে স্কুলের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল গণহত্যা নামে পরিচিত। নিহতদের লাশ তারা পাহাড়ের গভীরে ফেলে দেয়।
২৭শে মার্চ কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার শামসুল হক খান এবং পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে এনে একটি কক্ষে আবদ্ধ করে। ৩০শে মার্চ সেনানিবাসে তাঁদের হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা থানার বিভিন্ন হাট-বাজার, ঘরবাড়ি, রেলস্টেশন এবং বাস থেকে বহু যুবককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যেত। তাদের অনেকে আর ফিরে আসেনি। ৮ই এপ্রিল কুমিল্লা শহরের বিষ্ণুপুরের আলী আকবরের বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি চালানো হয় এবং এ বাড়ির ৩ বছরের শিশু বাসেতকে হত্যা করা হয়। বাড়ির সমস্ত সম্পদ লুট করে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে নেয়া হয়। এদিন আলী আকবর-সহ ১২ জন নিরীহ মানুষকে আটক করে সার্কিট হাউসে আনা হয়। তাদের ওপর সারারাত অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। পরদিন সকালে চোখ ও হাত বেঁধে ট্রাকে করে তাদের একটি গুদাম ঘরে নিয়ে চোখ খুলে দেয়া হয়। সেখানে আরো অনেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছিল। তাদের মধ্যে শহরের নামকরা আইনজীবী যতীন্দ্র ভদ্রও ছিলেন। তাঁর সারা গায়ে বহু কাটার দাগ ও পোড়ার চিহ্ন। তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন।
৩১শে মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সদর উপজেলার চৌয়ারা বাজারের কাছে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় উলুরচর নোয়াবাড়ি ও নোয়াগ্রামের ৭ জন নিরীহ মানুষকে চৌয়ারা মাদ্রাসার বিপরীত দিকের পুকুরঘাটে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। উলুরচর গণহত্যায় নিহতদের পরে গণকবর দেয়া হয়।
সদর উপজেলার রসুলপুল রেলস্টেশনের সামান্য পূর্বদিকে কয়েকটি বাড়ি নিয়ে কাটানিশা গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে- মধ্যে ছদ্মবেশে এ গ্রামে এসে রসুলপুরস্থ পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে চোরাগুপ্তা হামলা শেষে হাজী আবদুল গফুরের বাড়িতে আশ্রয় নিতেন। ১৬ই জুন এরকম এক হামলা শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাতের আঁধার থাকতেই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল হাজী আবদুল গফুরের বাড়িতে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালায়। তাদের গুলিতে হাজী আবদুল গফুর, আসমত, আবদুল মজিদ ও তাঁর এক শিশুপুত্র নিহত হয়।
১০ই সেপ্টেম্বর সংঘটিত কৃষ্ণপুর যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১১ই সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার আমড়াতলি ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গ্রামে আক্রমণ করে। তারা গ্রামের একটি ঘরে আশ্রয় নেয়া ২৬ জনসহ শতাধিক নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড -কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা নামে পরিচিত।
সদর উপজেলার রসুলপুর রেলস্টেশন থেকে মাইল দেড়েক পূর্বদিকের নিরিবিলি গ্রাম শালুকমুড়া। পাকসেনারা এ গ্রামে হামলা চালিয়ে শিশু-নারী-সহ ১৭ জনকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড শালুকমুড়া গণহত্যা- নামে পরিচিত। গণহত্যার পর তারা গ্রামের প্রায় সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। উপজেলার আনন্দপুর গ্রামে আক্রমণ করে পাকবাহিনী ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। আনন্দপুর গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে ৬ জনের পরিচয় জানা গেছে। কুমিল্লা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরদিকে সীমান্তবর্তী জঙ্গলবাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে পাকবাহিনী একই পরিবারের ৫ জনসহ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ড জঙ্গলবাড়ি গণহত্যা- নামে পরিচিত ১১ই জুন কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ভুবনঘর গ্রামের কাইক্যার চর পাড়ায় পাকবাহিনী এক নির্মম গণহত্যা চালায়। কাইক্যার চর গণহত্যায় একই পরিবারের ৭ জন প্রাণ হারান। এছাড়াও চৌয়ারা গণহত্যা, কাটানিশা গণহত্যা ও তৈলকুপি গণহত্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কুমিল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অনেক বাঙালি নারী নির্যাতনের শিকার হন। পাকসেনারা কোথাও প্রতিরোধের সম্মুখীন হলে ক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। তারা শহরের বিভিন্ন বাসায় ঢুকে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা- পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে যেত।
সেনানিবাসের ইস্পাহানি স্কুলের কক্ষগুলোতে মহিলাদের এনে ধর্ষণ করা হতো। তাদের আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন শিউরে উঠত। পরে মিত্রবাহিনী- এ বন্দিশালা থেকে ৬০-৭০ জন নির্যাতিত মহিলাকে উদ্ধার করে। অনেকে এর আগে সরে যেতে সক্ষম হন। ২৫শে মার্চের পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাকিস্তানি বাহিনী মেয়েদের ধরে এনে ক্যান্টেনেমেন্ট এলাকায় আটক করে রাখত এবং তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাত। প্রথমদিকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শতাধিক মেয়ে গলায় কাপড় বেঁধে আত্মহত্যা করায় পাকিস্তানি বাহিনী মেয়েদের বিবস্ত্র অবস্থায় বন্দি করে রাখত। কুমিল্লা শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে ৭ শত বিবস্ত্র অসহায় মহিলাকে উদ্ধার করে।
কুমিল্লা শহর মুক্ত হওয়ার পরও কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকসেনাদের অবস্থান ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী তখন সেনানিবাস থেকে বাঙালি অফিসারদের ৩০টি পরিবারকে মুক্তি দেয়। কুমিল্লা পুলিশ বাহিনীর একটি ট্রাকে কয়েক দফায় এ ৩০টি পরিবারের লোকজনকে কোতয়ালি থানায় আনা হয়। সেখান থেকে তারা নিজ-নিজ বাড়ি ও আত্মীয়- স্বজনের কাছে ফিরে যান।
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে কুমিল্লা সদর থানাধীন গ্রামগুলোর অনেক শিশু ও নারী নির্যাতনের শিকার হন। আমড়াতলী ইউনিয়নের ১৪-১৫ বছরের মেয়ে আলেয়া রাস্তার পাশে কয়েকটি মেয়েসহ খেলা করছিল। হঠাৎ এক দল পাকিস্তানি সেনা এসে তাদের বাড়িতে ঢোকে। তাদের দেখে শিশু আলেয়া দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকতেই পাকিস্তানি সেনারা তার মুঠি ধরে টান দেয়। কয়েকজন সৈন্য তার ওপর নির্যাতন করতে শুরু করে। দাদা ও চাচি তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে তাদের গুলি করে হত্যা করে। পুরো উঠান রক্তে লাল হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আলেয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য আগরতলার হাসপাতালে পাঠানো হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ময়নামতি সেনানিবাসে আত্মসমর্পণ করলেও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তখনো তারা সম্পূর্ণ নিবৃত্ত হয়নি। আত্মসমর্পণের পর সাড়ে ৪ হাজার পাকিস্তানি সেনাকে কোটবাড়ি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বন্দিশিবিরে রাখা হলে তারা বেপরোয়াভাবে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মূল্যবান জিনিসপত্র ধ্বংস করে। তারা ইনস্টিটিউটের প্রত্যেকটি দরজা ও আসবাবপত্র চুরমার করে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করে। বিভিন্ন মেশিন রুমের যন্ত্রপাতি নষ্ট করে। কমার্স বিভাগের নতুন ও আধুনিক টাইপ রাইটার ও অন্য যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে ফেলে। স্নানাগার ও বাথরুমের মূল্যবান টাব, বেসিন ইত্যাদি নষ্ট করে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত অসংখ্য বই তারা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। কয়েকটি রন্ধনশালার মূল্যবান সেগুনকাঠের চেয়ার-টেবিল তারা ভেঙ্গে ফেলে। এভাবে পলিটেকটিক ইনস্টিটিউটে ২০ লক্ষ এবং টিটার্স ট্রেনিং কলেজে ৭ লক্ষ টাকার সম্পদ তারা নষ্ট করে।
ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল, ময়নামতি সেনানিবাস স্কোয়াশ রুম ও সার্কিট হাউস কুমিল্লায় পাকবাহিনীর প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল এর নিচতলায়। এখানে সশস্ত্র সৈন্যরা থাকত এবং বেসামরিক বন্দিদের রাখা হতো। শেষরাতে ও সকালে তাদের ধরে আনা হতো। তাদের ওপর নানা ধরনের নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। সন্ধ্যায় গাড়িতে করে অনেককে নিয়ে যেত। তাদের আর কোনো সন্ধান মিলত না।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কুমিল্লা সদর উপজেলার সর্বত্র গণহত্যার ঘটনা ঘটে। সৃষ্টি হয় অনেক গণকবর ও বধ্যভূমির। কুমিল্লা সদরের গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো হলো— পুলিশ লাইন্স গণকবর, সার্ভে ইনস্টিটিউট গণকবর, ময়নামতি সেনানিবাস গেইট গণকবর, রূপবান মুড়া গণকবর ও বধ্যভূমি কাইক্যার চর গণকবর এবং ফকিরবাড়ি বধ্যভূমি ময়নামতি সেনানিবাস বধ্যভূমি। সার্ভে ইনস্টিটিউট গণকবরে দেড় শতাধিক আনসার-মুজাহিদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর এ গণকবর আবিষ্কৃত হয়। কুমিল্লা সদর ২ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন ছিল। সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অনেক ছোট-বড় যুদ্ধ হয়। বিবিরবাজার যুদ্ধ, সুবর্ণপুর এম্বুশ, ফুলতলী এম্বুশ, কটকবাজার যুদ্ধ, বাটপাড়া এম্বুশ, ফকিরহাট স্টেশন আক্রমণ, শাহপুর যুদ্ধ ইত্যাদি ছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়।
১০ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৪০০ সেনা গোমতী নদীর উত্তর পাড়ে আমড়াতলী ও পাঁচথুরি গ্রামে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করেন। এতে নেতৃত্ব দেন ২ নম্বর সেক্টরের মতিনগর সাব-সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম। তাঁকে সহায়তা করেন থানা কমান্ডার আব্দুল মতিন ও স্থানীয় কৃষক, যুবক ও ছাত্ররা। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন ৮০-৯০ জন। সকাল ১০টায় শুরু হয়ে সারাদিন যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত হননি।
কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের কংসতলা কংসতলা ঘাঁটিটি মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা দলের যাতায়াতে বিশেষ অসুবিধার কারণ ছিল। এ ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি সেনাদের টহল দল মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়ার পথে তৎপরতা চালাত। তাই এ ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য স্থানীয় কমান্ডের পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে নির্দেশ দেয়া হয়। ৫০ জনের একটি দল ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ৩০শে সেপ্টেম্বর রাত ১টায় ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। তিন ঘণ্টার যুদ্ধে সুবেদার শাহজাহান-সহ ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। কংসতলা পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণের ফলে পাকবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে। এর দুদিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের ডিমোলিশন পার্টি পিপুলিয়া বাজারের কাছে লালমাই-সোনাগাজী সড়কের একটি সেতু বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা এ রাস্তাটিকে ট্যাংক ও ভারী গাড়ি চলাচলের জন্য পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছিল। সেতুটি ধ্বংস হয়ে গেলে তারা রাস্তা মেরামতের কাজ বন্ধ করে দেয়।
১১ই অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টায় মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা সার্কিট হাউস এবং গোমতীর চাঁদপুর ফেরিতে মর্টারের গোলাবর্ষণ করে। সার্কিট হাউসে পাকসেনাদের মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টার্স ছিল। সার্কিট হাউস আক্রমণের ফলে ৩৯ জন পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। শহরের ভেতরে বসে মর্টারের গোলাবর্ষণ করায় পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। টহলরত পাকিস্তানি সেনারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের অস্ত্র ফেলে ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। সার্কিট হাউসে গোলাবর্ষণের সময় সেখানে পাকিস্তানিদের ৯ম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং উপস্থিত ছিল। অল্পের জন্য সে রক্ষা পায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ আক্রমণের খবর পাকিস্তান রেডিও থেকেও প্রচার করা হয়। তবে তারা ৫ জন সৈনিক নিহত ও ৩৯ জন আহত হওয়ার কথা স্বীকার করে।
নভেম্বরের শেষদিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যৌথ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। কুমিল্লাসহ পূর্বাঞ্চলের যৌথ বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডে। যৌথ বাহিনীর ২৩ নম্বর ডিভিশন কুমিল্লার দাউদকান্দি, লাকসাম, চাঁদপুর এবং ফেনীর বিলোনিয়া থেকে যুদ্ধ শুরু করে। ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে নবম বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেয়া হয় কুমিল্লা শহর দখলের। ৫ই ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে নবম বেঙ্গল কুমিল্লা শহরতলীর বালুতুপায় অবস্থান নেয়। শত্রুবাহিনীর একটি কনভয় তখনো শহরের ৭ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে শুয়াগঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। নবম বেঙ্গল তাদের কৌশলে পেছনের ফাঁদে ফেলে শহরে প্রবেশ করে। একই সময়ে শিখ সেনাদের জাঠ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার টম সিংয়ের নেতৃত্বে কুমিল্লা শহরতলীর বিমানবন্দর এলাকা ঘেরাও করা হয়। অন্যদিকে শাহ আলম, রেজাউর রহমান বুলবুল-সহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল উত্তর প্রান্ত দিয়ে শহরে প্রবেশের সিগন্যাল পায়। এভাবে ৬ই ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লা বিমান বন্দর এবং শহরকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধ শুরু হয়। এ-যুদ্ধে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। কুমিল্লা বিমানবন্দর যুদ্ধ-এ উভয় পক্ষের শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। এছাড়াও বেতিয়ারার যুদ্ধ- বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৭ই ডিসেম্বর থেমে-থেমে কিছু গুলি বিনিময় হলেও পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। এদিন রাতে অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনারা বিমানবন্দর এবং শহর এলাকার সকল অবস্থান ত্যাগ করে ময়নামতি সেনানিবাসে চলে যায়। ৮ই ডিসেম্বর ভোররাতে শিখ জাঠ বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা বিনা বাধায় গেরিলা কায়দায় বিমান বন্দরে প্রবেশ করে উল্লাস করেন এবং তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে আশপাশের গ্রাম, শহরতলী এবং শহরের মানুষ ছুটে আসে। ভোর থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পুরো শহর মুখরিত হয়। সকালে শহরের সরকারি অফিস-আদালত, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। স্বাধীন দেশের পতাকা বহনকারী অসংখ্য মিছিলে কুমিল্লা শহর আনন্দ নগরীতে পরিণত হয়। সেদিন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যান জহুর আহমদ চৌধুরী, এডভোকেট আহাম্মেদ আলী এমএলএ, যুব শিবিরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) হাবিবুর রহমান, আবদুল আজিজ খান এমপিএ এবং আবদুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ার এমপিএ-সহ অন্য নেতৃবৃন্দ বিমানবন্দর এলাকায় পৌঁছে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হন। সেখান থেকে তাঁরা শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনকে নিয়ে টাউন হল মাঠে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এদিন এডভোকেট আহাম্মেদ আলী এমএলএ-কে কুমিল্লা জেলার বেসামরিক প্রশাসক ঘোষণা করা হয়।
১৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর কুমিল্লা ব্রিগেডের প্রধান ব্রিগেডিয়ার শেখ মঞ্জুর হোসেন আতিফ ময়নামতি সেনানিবাসে মিত্রবাহিনীর স্থানীয় প্রধান মেজর জেনারেল আর ডি হীরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী ২ সহস্রাধিক পাকিস্তানি সৈন্যের মধ্যে ২ জন ব্রিগেডিয়ার ও ৯ জন অন্যান্য স্তরের অফিসার ছিল। এ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে কুমিল্লা চূড়ান্তভাবে হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম (পিতা আবদুল হক), আকবর হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা হোসেন আলী মোক্তার), বজলু মিয়া, বীর প্রতীক (পিতা ওসমান আলী), আশরাফুল হক, বীর প্রতীক (পিতা হাবিবুল হক) ও বজলুল মাহমুদ, বীর প্রতীক (পিতা এ এস ইসমাইল)। কুমিল্লা সদরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম (৩০শে মার্চ যশোর সেনানিবাসে শহীদ), বজলু মিয়া, বীর প্রতীক (ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর যুদ্ধে শহীদ), আবু জাহিদ আবু ও সাইফুল ইসলাম সাফু।
কুমিল্লায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধগুলো হলো- কুমিল্ল জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামসহ টাউন হল প্রাঙ্গণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ স্মৃতিসৌধ (রাণীর দিঘির পাড়), পুলিশ লাইন্স স্মৃতিসৌধ (পুলিশ লাইনের ভেতরে), রসুলপুর স্মৃতিসৌধ, এম আর চৌধুরী গ্রাউন্ড স্মৃতিসৌধ (ময়নামতি সেনানিবাস), ১১৮ ফিল্ড ওয়ার্কশপ স্মৃতিসৌধ (ময়নামতি সেনানিবাস), ‘যাদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ’ (ময়নামতি সেনানিবাসের প্রবেশ দ্বার)।
কুমিল্লা সদর উপজেলায় কয়েকটি স্মৃতিফলক ও স্মৃতিতোরণ রয়েছে। যেমন, কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ শামসুল হকের সমাধিস্থলে নির্মিত স্মৃতিফলক (কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণ), শহীদ শামসুল হকের স্মৃতিতোরণ (কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রবেশ দ্বার) এবং শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম তোরণ ও ম্যুরাল। ‘যুদ্ধ জয়’ নামে মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাস্কর্য রয়েছে (আলেখার চর বিশ্বরোডস্থ কুমিল্লা শহরের প্রবেশমুখ)। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বেশকিছু সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক (ঝাউতলা ফয়জুন্নেছা স্কুল থেকে কালেক্টরেট), অতীন্দ্রমোহন রায় সড়ক (ধর্মসাগর পশ্চিম পাড় থেকে সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়), শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া সড়ক (কান্দিরপাড় থেকে পুলিশ লাইন্স মোড়), শহীদ সোলায়মান মোস্তফা সড়ক (বাগিচাগাঁও থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতাল রোড), শহীদ কর্নেল মুশতাক আহমেদ সড়ক (রাণীর বাজার থেকে পুলিশ লাইন্স), শহীদ আবু জাহিদ সড়ক (মগবাড়ি-চৌমুহনী- বিষ্ণুপুর), শহীদ খন্দকার কবিরউদ্দিন সড়ক (কান্দিরপাড় থেকে প্রেসক্লাব), শহীদ শামসুল হক সড়ক (পুলিশ লাইন্স থেকে ডিসির বাংলো সড়ক), শহীদ সাইফুল ইসলাম সাফু সড়ক (স্টেডিয়াম থেকে রাজবাড়ি কম্পাউন্ড), বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম সড়ক (অশোকতলা চৌহমুনী থেকে বাদশা মিয়ার বাজার) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান সড়ক (মগবাড়ি চৌমহনী-ছোটরা)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও মিলনায়তন নির্মিত হয়েছে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর (ময়নামতি সেনানিবাস), শহীদ কবিরউদ্দিন ভকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম, শহীদ আবু জাহিদ মিলনায়তন (কুমিল্লা জিলা স্কুল), অতীন্দ্রমোহন রায় মিলনায়তন (কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মুক্তমঞ্চ (টাউন হল প্রাঙ্গণ)। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে দুটি পদক ঘোষিত হয়েছে, যেমন- শহীদ কবির উদ্দিন শিল্ড এবং শহীদ শামসুল হক খান স্মৃতিপদক। [মামুন সিদ্দিকী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড