You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা (কুমিল্লা)

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা (কুমিল্লা) কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের অংশবিশেষ এবং কুমিল্লা সদর ও লাকসাম থানার ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে ২০০৫ সালে গঠিত। এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে এ অঞ্চলের মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ২৩শে জানুয়ারি কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তির কথা উল্লেখ করে ভাষণ রাখার পর এখানকার রাজনৈতিক আন্দোলন আরো বেগবান হয় ও ভিন্ন মাত্রা ধারণ করে। জেলা আওয়ামী লীগ-এর নেতৃবৃন্দ কুমিল্লার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সভা- সমাবেশের মাধ্যমে জনগণকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়।
৭ই মার্চের পর থেকেই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্বে কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণের পর এখানকার মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকবৃন্দ গোমতী নদী পার হয়ে কোটেশ্বর নামক স্থানে একত্রিত হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এরপর কটকবাজার ও ধনপুরে ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সূত্রপাত হয়। যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ছিল ভারতের সোনামুড়া মহকুমার কাঁঠালিয়া, বড়মুড়া, বক্সনগর ও মাছিমা। এসব ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে ২ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স মেলাঘরের যোগাযোগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এ অঞ্চলে যাঁরা ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- জ্যোতি পাল মহাথের (বরইগাঁও-এর বৌদ্ধ পণ্ডিত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বহির্বিশ্বে বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে শুরু করে এরপর শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতে ব্যাপক প্রচার চালান), আবদুল মান্নান চৌধুরী (ঢুলীপাড়া, পূর্বাঞ্চলের মুজিব বাহিনীর সহকারী কমান্ডার ছিলেন; বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক), অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার (পিতা মিয়াজান মজুমদার, মেহেরকুল দৌলতপুর; ষাটের দশকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-এর নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের নির্ভয়পুর ও মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন), অলী আহাম্মদ (পিতা আলহাজ্ব আবদুল গনি, রাজাপাড়া; মুক্তিযুদ্ধ- পরবর্তী সংসদ সদস্য; প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমৃত্যু কোতয়ালী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি; যুদ্ধকালীন সময়ে সোনামুড়া ক্যাম্পে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন), মনিরুল হক চৌধুরী (নোয়াগ্রাম, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা), ক্যাপ্টেন রেজাউল আহমেদ (পিতা সৈয়দ আহমেদ, রামমালার কোটেশ্বর ও কটকবাজার প্রতিরক্ষাব্যূহের প্রধান সংগঠক ও প্রশিক্ষক; পরবর্তীতে মেলাঘর ক্যাম্পে যোগ দেন), আলী তাহের মজুমদার (পিতা চারু মজুমদার, চাঁদপুর, বারপাড়া; হাতিমারা কামালনগর ক্যাম্পের সুপারভাইজার), জহিরুল হক চৌধুরী (ঢুলীপাড়া, হাতিমারা কামালনগর ক্যাম্পের সংগঠক), সৈয়দ মতিউল ইসলাম মন্টু (ধনেশ্বর, বক্সনগর ক্যাম্পের সংগঠক), সিরাজুল ইসলাম (পিতা তোরাব আলী, দিশাবন্দ; ধনপুর ক্যাম্পের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন, বর্তমানে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার), হুমায়ুন কবীর মজুমদার (পিতা সেকান্দার আলী মজুমদার, দক্ষিণ রামপুর; ১৯৭১ সালে ন্যাপ- জেলা কমিটির সদস্য, পূর্বে ছাত্র ইউনিয়ন – জেলা কমিটির সদস্য এবং নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন), সফিউল আহমেদ বাবুল (পিতা সৈয়দ আহমেদ, টমছমব্রিজ; ধনপুর ক্যাম্পের সেকশন প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন, বর্তমানে কুমিল্লা জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার) ও আবু তাহের মজুমদার (পিতা আশরাফ আলী মজুমদার, আশকামতা, বাগমারা বাজার; লাকসাম উপজেলার ৪টি সাব-সেক্টরের ১ নং সেক্টর কমান্ডার)।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণের যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা হলেন- ক্যাপ্টেন রেজাউল আহমেদ (পিতা সৈয়দ আহমেদ, রামমালা, টমছমব্রিজ; কোটেশ্বর ও কটকবাজার প্রতিরক্ষাব্যূহের প্রধান সংগঠক, পরবর্তীতে মেলাঘর ক্যাম্পে যোগ দেন), সফিউল আহমেদ বাবুল (পিতা সৈয়দ আহমেদ, রামমালা, টমছমব্রিজ; প্লাটুন কমান্ডার, ধনপুর ক্যাম্প, বর্তমানে জেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কুমিল্লা), সিরাজুল ইসলাম (পিতা তোরাব আলী, দিশাবন্দ, রাজাপাড়া; আর্মি প্লাটুন কমান্ডার, ধনপুর ক্যাম্প, বর্তমানে উপজেলা কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ), আবু তাহের মজুমদার (পিতা আশরাফ আলী মজুমদার, আশকামতা, বাগমারা বাজার; লাকসাম উপজেলার ৪টি সাব- সেক্টরের ১ নং সেক্টর কমান্ডার)। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে টমছমব্রিজে কাঁটাতারের বান্ডেল, গাছ, ড্রাম, ইট এবং বাস-ট্রাক রাস্তার ওপর ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করা হয়। উপজেলার পদুয়ার বাজারে পিচের ড্রাম দিয়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। ২৬শে মার্চ রাত ১টায় ২৪ ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্স রেজিমেন্ট ও ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের একটি অংশ এবং তাদের সঙ্গে ১২০ মিলিমিটার মর্টারবাহী ৮০ থেকে ১০০টি যানের একটি বিরাট কনভয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শুয়াগাজী ও পিপুলিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নির্দেশে এলাকাবাসী রাস্তার পাশের গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। পরে লালবাগ ও শামুকসারের কাছে ব্রিজের ওপর ব্যারিকেড সৃষ্টির সময় পাক-কনভয় এগিয়ে এলে এলাকাবাসী ব্রিজের নিচে আত্মগোপন করে। এ ব্যারিকেড পাক-কনভয়কে রুখতে না পারলেও প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
পাকবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে সদর দক্ষিণ উপজেলার রামমালায় প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর তারা কুমিল্লা বিমানবন্দর হয়ে পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ দিকে লাকসাম ও নোয়াখালী এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চৌদ্দগ্রাম ও চট্টগ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে।
এ উপজেলার শীর্ষস্থানীয় রাজাকার- ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা বরল গ্রামের অধিবাসী আদম ছফি উল্লাহ ওরফে মোহাম্মদ জাকারিয়া। তার নেতৃত্বে মওলানা আবদুল ওয়াদুদ, রাজাকার মনতাজ, মওলানা আরিফ, সত্তর ও আলী আযম কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে হত্যা, নারীনির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়। রাজাকার মনতাজের সুয়াগাজী-চৌয়ারা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে খুবই দৌরাত্ম্য ছিল। একাত্তরের জুন মাসে ধনপুর থেকে রেকি করতে আসা উপজেলার বামিশা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক আবদুল মতিন মাস্টারকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয় এ রাজাকার।
২৬শে মার্চ সকালে পাকবাহিনীর একটি গাড়িতে ৩-৪ জন সৈনিক পদুয়ার বাজার এলে রাস্তায় পিচের ড্রাম দিয়ে তৈরি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। তারা পার্শ্ববর্তী চায়ের দোকান থেকে তোরাব আলীকে ডেকে ঐ ড্রামগুলো সরাতে আদেশ দেয়। বয়স্ক তোরাব আলী যখন ড্রামগুলো রাস্তা থেকে সরাচ্ছিলেন, তখন পাকহানাদাররা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা রামমালা সার্ভে ইন্সটিটিউট এলাকায় নির্বিচারে গুলি চালালে ৩-৪ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। তাদের লাশ সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভেতরে মাটিচাপা দেয়া হয়। ৮ই এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লালমাই বাজারের বিপরীতে শিবপুর গ্রামে এক গণহত্যা চালায়, যা শিবপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। এতে ১০ জন গ্রামবাসী নিহত হন। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লালমাই যুদ্ধের পর পাকবাহিনী বাগমারা হয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে কাকশাইর গ্রামে একদল মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এটি কাকশাইর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। ১৫ই এপ্রিল আলীশ্বরের যুদ্ধের দিন পাকবাহিনী পনকুছা-ফতেহপুর গণহত্যা চালায়। এতে তারা ৩০ জনের অধিক লোককে হত্যা করে। পাকবাহিনী ৩০শে এপ্রিল শুক্রবার জুমার নামাজের পর উত্তর রামপুরের শ্রীমন্তপুর জামে মসজিদ থেকে ৩০ জন মুসল্লিকে কুমিল্লা বিমানবন্দর টর্চার সেলে ধরে নিয়ে গেলে মাত্র ২ জন সেখান থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। বাকি ২৮ জনকে তারা হত্যা করে। এটি কুমিল্লা বিমানবন্দর গণহত্যা নামে পরিচিত।
৩১শে মে পাকবাহিনী চৌয়ারা পুকুরঘাট গণহত্যা চালায়। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় উলুরচর নোয়াবাড়ি ও নোয়াগ্রামের ৭ জন সাধারণ মানুষকে বর্তমান চৌয়ারা কলেজ সংলগ্ন চৌয়ারা মাদ্রাসার বিপরীতে অবস্থিত পুকুরঘাটে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে চৌয়ারা বাজারের পশ্চিমে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে তারা ১৭ জন ব্যক্তিকে হত্যা করে, যা চৌয়ারা বাজার গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। নভেম্বরের পর থেকে কুমিল্লা- নোয়াখালী সড়কের নিশ্চিন্তপুরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মানুষদের তারা নির্বিচারে হত্যা করে। এটি ছিল নিশ্চিন্তপুর গণহত্যা। পাকবাহিনী কুমিল্লার জেলা প্রশাসক শামসুল হক খানকে হত্যা করে দিশাবন্দের উত্তরপাড়ায় মাটিচাপা দেয় এবং পুলিশ সুপার কবির উদ্দিন আহমেদকে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী রাজাপাড়া দিঘির পাড়ে অবস্থিত চিতাখোলার কাছে ফেলে দেয়।
পাকহানাদার বাহিনী অজ্ঞাত এক কিশোরীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিকট দিশাবন্দের উত্তরপাড়ার মসজিদ সংলগ্ন আয়েত আলীর বাড়িতে ফেলে রাখে। যুদ্ধের পর সেই কিশোরীর লাশটি মুহুরি বাড়ির পুকুরে পাওয়া যায়। ডিসেম্বর মাসে তারা বারপাড়া ইউনিয়নের t ফুলবানুকে ধরে নিয়ে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
কুমিল্লা বিমানবন্দর, বিমানবন্দর সংলগ্ন দিশাবন্দ উত্তরপাড়ার টিলা, নেউরা স্কুল, হরিশ্চন্দ্র স্কুল ও বড়ধর্মপুর (লালমাই ডাকবাংলো) ছিল এ উপজেলায় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এসব নির্যাতনকেন্দ্রে বহু মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো।
বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের ২০ নং ওয়ার্ডের কুমিল্লা বিমানবন্দর সংলগ্ন দিশাবন্দ ছিল পাকবাহিনীর বধ্যভূমি। এটি দিশাবন্দ বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। দিশাবন্দের উত্তরপাড়ার টিলায় স্থাপিত ক্যাম্পে নির্যাতনের পর বহু মানুষকে হত্যা করে লাশগুলো উত্তরপাড়ার ইসহাক মিয়ার বসতভিটা, হাফেজ সিদ্দিকুর রহমানের বসতভিটা ও পাড়া দিয়ে প্রবাহিত খালের মধ্যে, বিমানবন্দরের দক্ষিণে বোমার খাদায় ও পশ্চিমপাড়ার গাজীর পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। কুমিল্লা-লাকসাম সড়কের . নিশ্চিন্তপুরে গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা নিশ্চিন্তপুর গণকবর হিসেবে পরিচিত। অসংখ্য মানুষকে গুলি করে এখানে মাটিচাপা দেয়া হয়।
২ নং সেক্টরের অধীনে যে ছয়টি সাব-সেক্টর ছিল, তার মধ্যে নির্ভয়পুর ও ধনপুর সাব-সেক্টরের অধিকাংশ অপারেশন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় হয়েছিল। কুমিল্লা বিমানবন্দর, ডাকাতিয়া নদী, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-নোয়াখালী সংযোগ সড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন, সর্বোপরি ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ার কারণে এ অঞ্চল পরিণত হয় প্রতিরোধযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে। পাকবাহিনীর সৈন্যদের রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে কুমিল্লা বিমানবন্দর যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও ছিল তা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ হয় এ বিমানবন্দরকে ঘিরে এবং কুমিল্লা মুক্তও হয় বিমানবন্দর এলাকায় যুদ্ধের মাধ্যমেই। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ও কুমিল্লা বিমানবন্দরের মাধ্যমে বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে পাকবাহিনীর যুদ্ধ পরিচালিত ও এতদঞ্চলে তাদের রসদ সরবরাহ হতো বলে কুমিল্লার সঙ্গে সংযুক্ত নানা সড়ক ও মহাসড়ক হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতিরোধ ও আক্রমণের উপযুক্ত কৌশলগত স্থান। এ উপজেলার লালমাই, আলীশ্বর, ফুলতলী, উত্তর রামপুর, হাড়াতলি ও কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়।
৩১শে মার্চ বেলা ৩টায় নায়েক সুবেদার জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা বিমানবন্দরের দক্ষিণে দিশাবন্দ দক্ষিণপাড়ার পানির পাম্প সংলগ্ন ধানক্ষেত থেকে হালকা মেশিনগানের সাহায্যে পাকবাহিনীর মালবাহী কালো রঙের বৃহদাকার বিমানের ওপর আক্রমণ করে। বিমানটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মেরামত করতে দুদিন সময় লাগে। এদিন বিমানবন্দর ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনীর ৪টি গাড়ি রাজাপাড়া ও দিশাবন্দের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। খবর পেয়ে দক্ষিণ দিক (বিজয়পুর-বাগমারা-লালমাই পাহাড় এলাকা) থেকে মুক্তিবাহিনীর বড় একটি দল এসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তর পাশে এবং উত্তর রামপুর স্কুলের পূর্বদিকে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থায়ী উত্তর রামপুর ও হিরাপুর যুদ্ধে দুপক্ষের কয়েকজন সদস্য প্রাণ হারায়। ৮ই এপ্রিল পাকবাহিনীর চাঁদপুরগামী এক রেজিমেন্টকে লালমাইয়ের দুতিয়াপুর ও চন্ডিমূড়া পাহাড় থেকে মুক্তিবাহিনী বাধা দিলে ৪-৫ ঘণ্টা উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। লালমাই যুদ্ধে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। ১৪ই আগস্ট দুপুরে এক কোম্পানি পাকসেনা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিয়া বাজারের উদ্দেশ্যে চিটাগাং রোড দিয়ে যাওয়ার সময় ফুলতলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা স্থায়ী ফুলতলী যুদ্ধে ৫-৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং একটি জিপ ও একটি ডজ গাড়ি পুড়ে যায়। ২১শে নভেম্বর উপজেলার হাড়াতলিতে ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ২০০ পাকসেনার এক কনভয়কে প্রতিহত করার চেষ্টা করলে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থায়ী হাড়াতলি যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৬ই ডিসেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কুমিল্লা বিমানবন্দর মুক্ত হয়। কুমিল্লা বিমানবন্দর যুদ্ধে পাকবাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হয়। ৮ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- গোলাম হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা আফসার উদ্দিন মোল্লা) ও গিয়াসউদ্দিন আহাম্মদ, বীর প্রতীক (পিতা মো. বাদশা মিয়া, চাঁন্দপুর)। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- এ কে এম মোজাম্মেল হক আবু (পিতা আবদুল মজিদ, ঢুলীপাড়া; ১২ই সেপ্টেম্বর ২ নং সেক্টরের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার চারগাছের যুদ্ধে শহীদ), খন্দকার আবু তাহের আবু (পিতা ছমীর উদ্দিন খন্দকার, নেউরা; কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ও কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমকম পাশ করে লালমাই কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন; জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে চৌদ্দগ্রামের মিরশানি বাজারের কাছে এক যুদ্ধে শহীদ), হাবিলদার মুন্সী আবদুল মান্নান (যুদ্ধকালীন সময়ে নায়েক সুবেদার, পিতা মুন্সী আনসার আলী, রাজাপাড়া; ২৯শে মে ৭ নং সেক্টরের নওগাঁর নিডপুরের কাছাকাছি পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মোখলেছুর রহমান আলফু (পিতা আজগর আলী, শাকেরা; পেরুল হাড়াতলিতে ২১শে নভেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), মনোরঞ্জন সিংহ (পিতা বিপনী চন্দ্র সিংহ, দত্তপুর, বাগমারা; হাড়াতলিতে ২১শে নভেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) এবং আবদুল মতিন (পিতা হাজী আকামত আলী, বামিশা; ধনপুর ক্যাম্প ক্যাপ্টেনের নির্দেশে রেকি করতে এলে পাকবাহিনী রাজাকার মনতাজ ও অন্যান্য রাজাকারদের সহায়তায় ১৫ই জুন তাঁর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং তাঁকে ধরে নিয়ে যায়, তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি)।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলার হাড়াতলিতে হাড়াতলি স্মৃতিস্তম্ভ, ঢুলীপাড়ায় শহীদ মোজাম্মেল হক স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতিস্তম্ভ, রামমালায় কুমিল্লা সার্ভে ইনস্টিটিউট স্মৃতিস্তম্ভ এবং পেরুলের হরিশ্চর বাজার সংলগ্ন নিশ্চিন্তপুরে ৭১-এর গণকবর স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী আবদুল মান্নানের নামে তাঁর বাড়ির পাশের সড়কটির নামকরণ করেছে স্থানীয় সংগঠন পথিকৃৎ সমাজকল্যাণ সংস্থা এবং ১৯৯৫ সালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিনের নামে রাজপাড়ার দক্ষিণ চৌমুহনী থেকে পিপুলিয়া পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করেছে উপজেলা প্রশাসন। এছাড়া রাজাপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা অলি আহম্মদের (মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সংসদ সদস্য) নামে একটি তোরণ রয়েছে এবং দত্তপুরে (বাগমারা) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন সিংহের নামে যুব উন্নয়ন পরিষদের নামকরণ করা হয়েছে। [আবুল খায়ের টিটু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!