You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধকালীন কুড়িগ্রাম বেসরকারি হাইকমান্ড - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধকালীন কুড়িগ্রাম বেসরকারি হাইকমান্ড

কুড়িগ্রাম বেসরকারি হাইকমান্ড (কুড়িগ্রাম সদর) মুক্তিযুদ্ধকালীন স্থানীয় প্রশাসন। এর অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র যোগান দেয়া ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
কুড়িগ্রাম জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং মেঘালয়ের সীমান্ত বেষ্টিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রাম ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তা নদীর উত্তর ও পূর্বাংশের বিস্তৃত এলাকাসহ তিস্তা ব্রিজ, তিস্তা ব্রিজের পূর্ব ও উত্তরে লালমনিরহাট-পাটগ্রাম, তিস্তা-চিলমারীর প্রায় ২০০ কিলোমিটার রেলপথ এবং লালমনিরহাট বিমানবন্দর নিজেদের দখলে রাখা ছিল উভয় পক্ষের জন্য জরুরি। তিস্তা ব্রিজের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রৌমারী থেকে বুড়িমাড়ী পর্যন্ত ৫০০ কিমি সীমান্তের প্রায় ২০০ কিমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব ছিল। আর দখল রক্ষার জন্য সামরিক শক্তির বিকল্প নেই তা অনুভব করেই কুড়িগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক যুদ্ধের প্রাথমিক তৎপরতা শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর নির্দেশনার আলোকে জেলায় আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে স্থানীয় রাজনীতিক, আনসার, শিক্ষক, সংস্কৃতিসেবী, সমাজহিতৈষী ও ছাত্র- যুবকদের নিয়ে ১০ই মার্চ মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহম্মদ হোসেন সরকার, যিনি আহম্মদ মোক্তার নামে পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রস্তুতি সম্বন্ধে আহম্মদ হোসেন সরকারের বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি এক সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য ও পাকিস্তান পুলিশের দারোগা ছিলেন। তিনি সংগ্রাম কমিটি গঠনে শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আনসার ও মোজাহিদ কমান্ডারদের সম্পৃক্ত করেন।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও ঢাকায় গণহত্যার খবর পেয়ে কুড়িগ্রামের নেতৃবৃন্দ ২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় আহাম্মদ আলী বকসীর গোডাউনে মিলিত হন। সেখানে আলোচনার পর অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও তিস্তা ব্রিজে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। পাকহানাদেরদের প্রতিরোধের লক্ষ্যে অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি সামরিক কমান্ড গঠন করা হয়। এতে আহম্মদ হোসেন সরকার, রেয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা এমএনএ, মহকুমা আনসার অফিসার মহিউদ্দিন আহমেদ, ব্যবসায়ী ও আনসার কমান্ডার আহাম্মদ আলী বকসী, প্রকৌশলী তাছাদ্দুক হোসেন, অধ্যাপক হায়দার আলী (কুড়িগ্রাম কলেজ) এবং পেট্রোলিয়াম ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ অন্তর্ভুক্ত হন। বেসরকারি ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়ে গঠিত হওয়ায় ৭ সদস্যের এ ইউনিটটি বেসরকারি হাইকমান্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তাঁদের নেতৃত্বেই ২৮শে মার্চ তিস্তা ব্রিজে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বেসরকারি হাইকমান্ড আনসারদের রাইফেল ও থানার অস্ত্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। মহকুমার সকল আনসার মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে হাইকমান্ডের অধীনে আসে এবং তাঁর নেতৃত্বে শহরের ব্যক্তি মালিকানাধীন বন্দুক সংগৃহীত হয়। হাইকমান্ড টগরাইহাট, কুড়িগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ মহকুমার বিভিন্ন থানায় প্রশিক্ষণের আয়োজন করে।
সংগ্রাম কমিটি মিছিল-মিটিং করে জনতাকে উজ্জীবিত করলেও সামরিক বিষয় দেকভালের জন্য বেসরকারি হাইকমান্ড ছিল মুখ্য ভূমিকায়। এ ইউনিটের নেতৃত্বে টগরাইহাট-ছোটপুলের যুদ্ধ, রেলপথ বিচ্ছিন্নকরণ, শহরের শান্তি- -শৃঙ্খলা রক্ষা, ট্রেজারির টাকা রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি কার্য সম্পন্ন হতে থাকে। বেসরকারি হাইকমান্ড জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইপিআর, আনসার, মোজাহিদ ও সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া বা ছুটিতে আসা সৈনিকদের দিয়ে স্থানীয় ছাত্র- যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। হাইকমান্ড শহরের মূল কর্তৃত্ব গ্রহণ করলে ২৮শে মার্চ স্থানীয় সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সংগ্রাম কমিটি ও হাইকমান্ডের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। ফলে জেলার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড বেসামরিক হাইকমান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন নওয়াজিস উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক ইপিআর ও সেনাসদস্য তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। নওয়াজিস উদ্দিনের নেতৃত্বে ৮ই এপ্রিল রংপুর সেক্টর ঘোষিত হলে তিনি এর প্রধান হন। রংপুর সেক্টর চালু হওয়ার পর বেসরকারি হাইকমান্ড রংপুর সেক্টরে অবলুপ্ত হয় এবং এর সদস্যগণ যুবশিবির গঠনসহ ৬ ও ১১ নং সেক্টরের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড