You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা ১৯৭০-এর নির্বাচনে কুড়িগ্রাম মহকুমা থেকে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সকল আসনে -আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিজয়ী হন। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পরও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলে কুড়িগ্রামে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ মিছিল করে। ৯ই মার্চ কুড়িগ্রাম পুরাতন পোস্ট অফিস প্রাঙ্গণের লিচুতলায় ছাত্রজনতার এক সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাবিবুল্লা বাহার খান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হলসমূহে পাকবাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনা দিলে উপস্থিত জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১১ই মার্চ কুড়িগ্রাম জেলখানার বন্দিরা মুক্তির দাবিতে বিদ্রোহ করে। ঐ বিদ্রোহে পুলিশের গুলিতে হায়দার আলী নামে একজন বন্দি নিহত হন। ১৭ই মার্চ শহরের শিশুপার্কে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, মঞ্জু মণ্ডল, রওশন উল বারী, রুকুনুদৌল্লা, হারুন অর রশীদ লাল প্রমুখের উপস্থিতিতে ডিএসবি দারোগার শিশুপুত্র মোস্তফা কামাল তুষার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করে। পতাকা উত্তোলন শেষে ছাত্রনেতারা রক্ত শপথ নেন। ১৮ই মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে শহীদদের স্মরণে কুড়িগ্রামে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই দিন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ােেত গিয়ে শ্রমিক নেতা সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, বীর বিক্রম, সুচিত্র ঘোষ খোকন ও জোবেদ আলী সরকার গ্রেফতার হন। ২৩শে মার্চ তাঁরা মুক্তি পান এবং ঐদিন চিলড্রেন পার্কে সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর ১০ই মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের ঘোষপাড়ায় ব্যবসায়ী আহাম্মদ আলী বকসীর গোডাউনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কুড়িগ্রাম মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি আহাম্মদ হোসেন সরকার মোক্তারকে (অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার) আহ্বায়ক ও আহাম্মদ আলী বকসীকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- রেয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা এমএনএ, আবুল হোসেন এমপিএ, সাদাকাত হোসেন ছক্কু এমএনএ, শামসুল হক চৌধুরী এমপিএ, নুরুল ইসলাম পাপ্পু এমপিএ, মোজাহার হোসেন চৌধুরী এমএনএ, আব্দুল হাকিম এমপিএ, আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী এমপিএ, আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ, আমানউল্যাহ, মনির হোসেন, সায়ফুল আলম দুলাল, সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, এটিএম আফজাল হোসেন দুলাল, আব্দুসসামাদ, তাছাদ্দুক হোসেন, প্রফেসর হায়দার আলী, খন্দকার মোস্তফা মূর্তুজা বিন হোসেন, চিত্তরঞ্জন দেব, ফিরোজ মো. ফারুক, আব্দুল জলিল মোক্তার, নির্মল কুমার রুদ্র দেবু, রবীন্দ্র লাল সরকার (খোকন সরকার), ছাত্রনেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম মণ্ডল (মঞ্জু মণ্ডল), মোকাররব হোসেন সাচ্চু, আক্তারুজ্জামান মণ্ডল, রওশনউল বারী, হারুন অর রশীদ লাল, মামনুন এলাহী কাজল, মীর আলী আখতার সাজু, রুকুনুদৌল্লা, শামসুল হক, সিরাজুল ইসলাম টুকু প্রমুখসহ আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), ন্যাপ (ভাসানী) ও কমিউনিস্ট পার্টি-র প্রতিনিধিবৃন্দ।
সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে বাংকার খনন এবং লাঠি, বল্লমসহ দেশীয় অস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি চলতে থাকে। ট্যারাইহাট ও কুড়িগ্রাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কাঠের ডামি রাইফেল এবং বাঁশের লাঠি দিয়ে যুবকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিনা হোসেন, মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা আছিয়া মণ্ডলসহ কয়েকজন মহিলাও ডামি রাইফেলসহ মার্চ পাস্ট করে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেন। যুদ্ধাহতদের ভবিষ্যৎ চিকিৎসা সেবার কথা চিন্তা করে সংগ্রাম কমিটি কুড়িগ্রাম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সোহরাব আলীর তত্ত্বাবধানে ফাস্ট এইড ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন। এ ট্রেনিংয়ে কুড়িগ্রাম কলেজের ছাত্রী সাঈদা খাতুন, পিয়াল হোসেন, অমলা দত্ত, স্মৃতি বণিক টুকটুক, রেখা আমানুরসহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণির অনেক ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে সাঈদা খাতুন, পিয়াল হোসেন, অমলা দত্ত প্রমুখ অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন। ২৫শে মার্চ ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যা এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পর ২৮শে মার্চ কুড়িগ্রাম গরহর পার্কে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় খায়রুল আলম (নজরুল ইসলাম) নামে এক বামপন্থী ছাত্রনেতা হাতে তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উপস্থিত জনতাকে উৎসাহিত করেন।
২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় আহাম্মদ আলী বকসীর বাসায় সংগ্রাম কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন আহম্মদ হোসেন সরকার, রেয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা এমএনএ, আহাম্মদ আলী বকসী, আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ, প্রকৌশলী তাছাদ্দুক হোসেন ও অধ্যাপক হায়দার আলী, আব্দুস সামাদ। এ কমিটিই ছিল কুড়িগ্রামের প্রথম সামরিক কমান্ড। বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত বলে এটি কুড়িগ্রাম বেসরকারি হাইকমান্ড- নামে পরিচিতি লাভ করে। এর নেতৃত্বে সদর থানার অস্ত্র এবং শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বন্দুক সংগ্রাম কমিটির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এ সকল অস্ত্র প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বেসরকারি হাইকমান্ড আনসার কমান্ডারদের সহযোগিতায় মহকুমা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবকদের ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করে। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়ন-এর মণিকৃষ্ণ সেন, জীতেন দত্ত, শংকর বসু, মো. সামসুদ্দোহা, চিত্তরঞ্জন দেব, ডা. কালীপদ বর্মণ, ফিরোজ মো. ফারুক, শাহাদত হোসেন, শামসুল হক, মোহাম্মদ আফজাল, বদরুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে সীমান্তের ওপারে বিভিন্ন এলাকায় যুবশিবির স্থাপন করা হয়। ১৭ই এপ্রিল সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে কুড়িগ্রাম ট্রেজারিতে রক্ষিত ১ কোটি ৬০ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা উদ্ধার করে মুজিবনগর সরকার-এর তহবিলে জমা করা হয়।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দই সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন- সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, বীর বিক্রম, আবদুল হাই, বীর বিক্রম, আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ, তাহমিদুর রহমান চাঁদ, নজরুল আলম ওরফে খায়রুল আলম, আকরাম হোসেন প্রমুখ।
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকবাহিনী উভয়ের জন্যই তিস্তা ব্রিজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি হাইকমান্ডের নেতৃত্বে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ছাত্র-যুবক, আনসার সদস্য ও ইপিআর জওয়ানরা তিস্তা ব্রিজে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ইপিআর রংপুর উইংএর উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজিস উদ্দিন ৩০শে মার্চ রাতে কুড়িগ্রামে প্রবেশ করে সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে মিলিত হন। তাঁর নির্দেশে ইপিআর-এর বিভিন্ন বিওপিতে দায়িত্বরত বাঙালি জওয়ানরা অবাঙালি ইপিআরদের পরাস্ত করে অস্ত্রসহ ৩১শে মার্চ কুড়িগ্রামে সমবেত হন। ফলে আনসার, ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-জনতার এক বিরাট সম্মিলিত বাহিনী গড়ে ওঠে। ১লা এপ্রিল এ বাহিনী তিস্তা ব্রিজে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুললে যুদ্ধ শুরু হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর মেজর এজাজসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়।
তিস্তা ব্রিজ প্রতিরোধ যুদ্ধ-এ আতাহার আলী মল্লিক, বীর বিক্রম (বরিশাল) এবং এরশাদ আলী, বীর উত্তম (নোয়াখালী) শহীদ হন। ৫ই এপ্রিল সংগ্রাম কমিটি চিল্ড্রেন পার্কে জনসভা করে জনগণকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেয়। একই দিনে মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স টগরাইহাট থেকে নাগেশ্বরীতে সরিয়ে নেয়া হয়। ৮ই এপ্রিলের পর পাকসেনাদের প্রতিরোধ করতে জনতা ছোট পুলের পাড় থেকে টগরাইহাট, রাজারহাট ও সিঙ্গেরডাবড়ী রেলপথ উপড়ে ফেলে। ২০শে এপ্রিল পাকবাহিনী শহরের দখল নিতে অগ্রসর হলে ইপিআর সৈন্যদের সঙ্গে ছাত্র- যুবকরা নতুন শহর এলাকায় তাদের প্রতিরোধ করে। ২৬শে মে পর্যন্ত এ প্রতিরোধ কার্যক্রম চলে।
৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী কুড়িগ্রামে প্রবেশ করে জেলখানায় জেল ইনচার্জসহ পাঁচজন পুলিশকে হত্যা করে। ১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী দ্বিতীয়বার কুড়িগ্রামে প্রবেশ করে সিএন্ডবি রেস্ট হাউস, আদালত ভবন ও রিভারভিউ হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা জেলখানা, গণপূর্ত অফিস, পিটিআই, আনসার ক্লাব ও কুড়িগ্রাম কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া অতুল চৌধুরীর বাড়িতে রাজাকার- ক্যাম্প ও সঞ্জীব করঞ্জাইএর বাড়িতে শান্তি কমিটি-র মহকুমা অফিস ছিল।
২৫শে মে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ-এর নেতৃত্বে কুড়িগ্রাম থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। প্রতিটি ইউনিয়নেও শান্তি কমিটির শাখা গঠন করা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটির প্রধান ছিল সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আলহাজ্ব পনির উদ্দিন আহমেদ (মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি), সম্পাদক শামসুল হক খন্দকার, সহ-সভাপতি আবু নছির পীর সাহেব, শামসুল হক পঞ্চু মিয়া, কাউসার উদ্দিন মিয়া, অধ্যাপক সাঈদ আলী, হাজী সাইফুর রহমান, আফসার মোক্তার, আবুল বাশার (বসা মিয়া), সহকারী সম্পাদক মৌলানা বেলায়েত (কুড়িগ্রাম আলিয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট), নাসিমুল্লাহ বিহারী ও কাজী মোশারফ হোসেন। কমিটির সদস্য ছিল জমির উদ্দিন, জহুরুল হক, দেওয়ান আবুল হোসেন, নূরল হক এনটিসিকে, করম আলী বিএ, আব্দুল কুদ্দুস বিএ, নুরুল হুদা, কাজী মাহফুজার রহমান, আফাজ উদ্দিন দারোগা, সেফাত মোহাম্মদ, সোলায়মান চৌধুরী, মনসুর রহমান, আব্বাস আলী বিএ, তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া টাউন কাউন্সিলের সভাপতি আফসার মোক্তারকে চেয়ারম্যান এবং এ হামিদ আলী, কফিল উদ্দিন আহমেদ (বেলগাছা), আমিন মোক্তার, এ সামাদ সরকার, আজির উদ্দিন মুন্সী ও আলহাজ্ব আজিজুল হক (ঝড়ু হাজী)-কে সদস্য করে সদর থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। মহকুমা রাজাকার কমান্ডার করা হয় তৈয়বুর রহমান ওরফে তোরাবুর রহমান (খাজা তোরাব)-কে। কুড়িগ্রাম সদর থানায় তালিকাভুক্ত ৩৭৯ জন রাজাকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ক্যাপ্টেন আব্দুল বারী ফাকু, ফজিয়ত চৌকিদার (বেলগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার), নিয়ামত কসাই, হরিকেশের আফতাব প্রমুখ।
৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী কুড়িগ্রামে প্রবেশ করে রেলপথের আশপাশের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। তারা জেলখানার ইনচার্জ হেদায়েতউল্ল্যাহ, সিপাহি লাল মোহাম্মদ, আনছার আলী ও সাজ্জাদ হোসেনসহ পাঁচজন পুলিশকে হত্যা করে রংপুর ফিরে যায়। ১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী বেলগাছায় গণহত্যা চালায়। বেলগাছা গণহত্যা-য় ডা. ছফর উদ্দিন (চেয়ারম্যান, বেলগাছা ইউনিয়ন)সহ অনেক মানুষ নিহত হয়। ১৫ই এপ্রিল রংপুর যাওয়ার সময় তারা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহম্মদ হোসেন সরকারের (টগরাইহাট) বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ৯ই জুন শান্তি কমিটির সভাপতি পনির উদ্দিন আহমেদের পুত্র তাজুল ইসলাম চৌধুরীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নে গণহত্যা চালায়। কাঁঠালবাড়ি গণহত্যায় ৩৫ জন মানুষ নিহত হয়। গণহত্যার পাশাপাশি তারা কাঁঠালবাড়ি বাজারের শতাধিক দোকান এবং শিবরাম, সর্দারপাড়া, সন্ন্যাসী, ফকিরপাড়া, প্রামানিকটারী ও খামার গ্রামের ৫ শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। ২৭শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হালাবটে মাইন দিয়ে রেললাইন ধ্বংস করায় পাকবাহিনীর রসদবাহী একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকবাহিনী ঐদিন হালাবটের পার্শ্ববর্তী ডাকুয়াপাড়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। ডাকুয়াপাড়া গণহত্যায় মুক্তিযোদ্ধা নুর ইসলাম নুরু ও অনির উদ্দিনসহ ৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হয় এবং আছিয়া খাতুন (পিতা আবদুল বাতেন খোকা) নামে এক শিশুসহ কয়েকজন গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় মরিয়ম বেগম নামে একজন মহিলা নির্যাতনের শিকার হন। ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী তাদের দোসর কৃষ্ণপুরের আবদুর রহমান কন্ট্রাক্টর, আবদুস সাত্তার, মোহাম্মদ আলী. মোজাম্মেল হক খন্দকার এবং নরেন্দ্র ভদ্রের সহায়তায় মোগলবাসা আক্রমণ করে এবং গণহত্যা চালায়। মোগলবাসা গণহত্যায় মুক্তিযোদ্ধা ডোমাস চন্দ্র (নীলফামারী) ও আবদুল করিম (কেতকীরপাড়, মালডাঙ্গা)সহ ১৮ জন গ্রামবাসী শহীদ হয়। মুক্তিযোদ্ধা ডোমাস চন্দ্র এবং আবদুল করিমকে পাকবাহিনী জিপ গাড়ির সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে-হিঁচরে জেলখানায় নিয়ে হত্যা করে। এ সময় তারা মোগলবাসা বাজারের দোকানপাট, বেপারিপাড়া জাহের আমিনের বাড়ি, মালডাঙ্গা, কৃষ্ণপুর ও বকশীপাড়ার শতাধিক ঘরবাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে।
কুড়িগ্রাম সদর থানায় অসংখ্য নারী পাকসেনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের পর তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়। নির্যাতিত নারীরা হলেন— পলাশবাড়ীর তরুবালা, মোছা. ময়না বেগম, নীলকণ্ঠের মোছা. হাজেরা, চিনু, ময়না বেগম, বছিরন বেগম, মোছা. আয়শা বেগম, মুক্তারামের মমেনা খাতুন ময়না, কালের মোছা. সুরুজ্জান বেওয়া, দোলে বেওয়া, রহিমা খাতুন, আবিরন বিবি, মোছা. খোদেজা বেগম, রাহেনা বেগম, খুকি বেগম, গেন্দি বেওয়া, মেহেরজান, আছমা বেগম প্রমুখ।
পাকবাহিনীর ক্যাম্পগুলোই ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি রয়েছে। সেগুলো হলো— কুড়িগ্রাম জেলখানা বধ্যভূমি, চানমারী বধ্যভূমি কাঁঠালবাড়ি বধ্যভূমি, ব্যাপারীপাড়া বধ্যভূমি ও থানাপাড়া বধ্যভূমি।
১৫ই এপ্রিল টগরাইহাটের বড়পুলে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। টগরাইহাট বড়পুলের যুদ্ধ-এ আমজাদ হোসেন ও জয়নালসহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদকে হত্যা করতে মে মাসের শেষের দিকে পাকবাহিনী কালিরহাট অপারেশন চালায়। ২৭শে অক্টোবর আবদুল হাই সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা গ্রুপ কুড়িগ্রাম শহরে পূর্বাশা সিনেমা হল আক্রমণ করে সিনেমা দেখারত কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও রাজাকারকে হতাহত করে। ৯ই নভেম্বর সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রাপুর বাজার অপারেশন করেন। এ অপারেশনে শতাধিক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ২০শে নভেম্বর আব্দুল হাই, বীর প্রতীক-এর নেতৃত্বে তাহমিদুর রহমান চাঁদ ও খায়রুল আলম হালাবট এলাকায় অর্জুনেরডারা রেলপথ অপারেশন করেন। হালাবট রেলপথ অপারেশন-এ পাকসেনাভর্তি ট্রেনে ডেটোনেটরের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটালে ১৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। নভেম্বর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচগাছির যুদ্ধ হয়। কমান্ডার সোলায়মানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রব্বানী (যাত্রাপুর), মো. নুরুজ্জামান (মুন্সীপাড়া), আবদুল জব্বার (টগরাইহাট), দিনাজপুরের আবদুল জলিল, ফজলুল হক, মকবুল প্রমুখ এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাঁচগাছির যুদ্ধে ৯ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। ৪ঠা ও ৫ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী-র কুড়িগ্রাম যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাস্ত হলে ৬ই ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহর হানাদারমুক্ত হয়। ৬ই ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সৈয়দ মনসুর আলী, বীর বিক্রম- (পিতা সৈয়দ শাহাবান আলী), মো. আব্দুল হাই সরকার, বীর প্রতীক- (পিতা রমজান আলী সরকার, মালভাঙা, মোগলবাসা)।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জালাল উদ্দিন (পিতা মৌলভী মো. মাহফুজুর রহমান, টগরাইহাট), গোলাম রব্বানী (পিতা চয়েন উদ্দিন), আবু বকর শেখ (পিতা ইদ্রিস আলী, ভরতেরছড়া, বঙ্গসোনাহাট), মনির উদ্দিন (পিতা মাদার বক্স, বাঞ্ছারাম), প্রফেসর আব্দুল ওহাব তালুকদার (পিতা ছামাদ তালুকদার, গরহর পার্ক), খয়বর আলী (পিতা ফজলার রহমান, মধ্যকুমরপুর), দেলোয়ার হোসেন (পিতা ধনির উদ্দিন মাস্টার, ভোগডাঙ্গা), আবুল কাশেম (পিতা ধনির উদ্দিন মাস্টার, ভোগডাঙ্গা), আ. করিম (পিতা নৈমুদ্দিন, মালভাঙ্গা), মনির উদ্দিন (পিতা জহির উদ্দিন, নিধিরাম) ও আফছার আলী (পিতা নছিয়তুল্ল্যাহ ব্যাপারী, গারুহারা)।
কুড়িগ্রাম সদরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামসহ স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মোড়ে নির্মিত হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক এবং বিজয়স্তম্ভ। ঘোষপাড়ায় নির্মিত হয়েছে ঘোষপাড়া মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলক। জেলা কারাগার প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে জেলা শহীদ স্মৃতিফলক। সাদ্দির মোড় হোসেন খা পাড়ায় স্থাপিত হয়েছে নূর-উন-নবী বাবুর বাড়ির বারুদ ঘর স্মৃতিফলক। শহীদ অধ্যাপক ওহাব তালুকদারের নামে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে। কলেজ মোড়ে স্থাপিত হয়েছে কছিমুদ্দিন মিলনায়তন। সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু, বীর বিক্রম-এর নামে পৌরসভা মিলনায়তনের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ আব্দুল আজিজের নামে কাঁঠালবাড়ির নামকরণ করা হয়েছে আজিজ নগর। তারামন বিবি, বীর প্রতীক-এর নামে হলোখানায় স্থাপিত হয়েছে তারামন বিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। চর কুড়িগ্রাম মোড় থেকে আরাজি পলাশবাড়ি সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে তারামন বিবি সড়ক। এসপি-র বাংলো থেকে কুড়িগ্রাম রেল স্টেশন পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে মহিউদ্দিন সড়ক। ত্রিমোহনী থেকে রাজারহাট সড়কের নামকরণ করা হয়েছে এডভোকেট আহম্মদ হোসেন সরকার সড়ক। ভোকেশনাল থেকে নীলারাম পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আহাম্মদ আলী বকসী সড়ক। ঘোষপাড়া থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু সড়ক। থানাপাড়া থেকে নয়াগ্রাম পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে তাছাদ্দুক হোসেন সড়ক। হরিকেশ মোড় থেকে হলোখানা ইউপি কার্যালয় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে আমান উল্যাহ সড়ক। জেলখানা থেকে জজকোর্ট মোড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে রেয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা সড়ক। বাসস্ট্যান্ড থেকে সার্কিট হাউজ মোড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে কছিমুদ্দিন সড়ক। সার্কিট হাউজ থেকে জেলগেট পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ হেদায়েতুল্যাহ সড়ক। ত্রিমোহনী থেকে কালিরহাট পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ডা. সফর উদ্দিন সড়ক। কাঁঠালবাড়ি জাফর চেয়ারম্যানের মোড় থেকে কুয়েত পল্লী পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে নূরল হক সড়ক। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!