You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুড়িয়ানা বধ্যভূমি (স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর)

কুড়িয়ানা বধ্যভূমি (স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর) স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা আর্য সম্মীলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছন ও কুড়িয়ানা বাজারের পশ্চিমে রাস্তার দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। মে মাসের মাঝামাঝি হানাদার বাহিনী এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে, যা ১২ দিন স্থায়ী ছিল। এ-সময় তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে অগণিত মানুষকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে।
আটঘর-কুড়িয়ানার অধিকাংশ এলাকা জুড়ে পেয়ারা বাগান। ২৫শে এপ্রিল বরিশাল শহর পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে বরিশাল এবং ঝালকাঠি শহর থেকে অসংখ্য মানুষ এসে এখানে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্র এলাকায় পাকসেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের তৎপরতা বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন জেলা থেকেও অসহায় মানুষ এসে এখানে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। আটঘর- কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান পরিণত হয় এক উদ্বাস্তু শিবিরে। রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর পাকসেনাদের কাছে পৌঁছে যায়। শর্ষিনা পীরের বাড়ি তখন হানাদার বাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের আখড়ায় পরিণত হয়। তারা মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে একযোগে পেয়ারা বাগানে নিধন চালায়। তারা ধন-সম্পত্তি লুটসহ নারীনির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। পাকসেনারা এসকল নিরপরাধ মানুষদের ধরে- ধরে কুড়িয়ানা স্কুল মাঠে নিয়ে আসত। মাঠে খেলার রিঙের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে তাদের ঝুলিয়ে রাখত। ২-৩ জনকে একসঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করত।
একদিন কাশীনাথ হালদার ও তার ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র নির্মল হালদারকে ধরে নিয়ে আসে। নির্মলকে দাঁড় করায় গুলি করার জন্য। নির্মল বাবা বলে ডাক দেয়। কাশীনাথ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে প্রিয় ছেলেকে। মুহূর্তেই পাকবাহিনীর বুলেট বিদ্ধ করে বাবা ও ছেলেকে।
পাকসেনারা কুড়িয়ানা স্কুলে অগ্নিসংযোগ করে। স্কুলের দপ্তরি শশীভূষণ মজুমদার (ঠাকুর ভাই হিসেবে পরিচিত) এর প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ করায় পাকসেনারা তাকে ধরে খালপাড়ে নিয়ে যায় এবং গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও এ খালপাড়ে হত্যা করে অগণিত মানুষকে।
মুক্তিযোদ্ধারা এ এলাকায় ক্যাম্প করেন। এ-সময় রাজাকার- পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁরা কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন। পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে তাঁরা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। মুক্তিযোদ্ধরা চলে গেলে হানাদাররা চারদিক থেকে পেয়ারা বাগান আক্রমণ করে এবং বিরতিহীনভাবে চলে অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও ধর্ষণ সুধীর বড়ালকে দেখামাত্র তারা গুলি করে হত্যা করে। মাদ্রা গ্রামের এক ব্যক্তি নিজের নাম সুধীর বলায় হানাদাররা তাকে গুলি করে। পাশের গ্রামের মকসুদুর রহমানের ছেলে মানিক পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়। হানাদাররা মানিকসহ ২৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ২৫ জন শিশুকে হত্যা করা হয় একদিনেই। হানাদাররা কিশোরদের বলত গাছে উঠে ডাব পেড়ে দেয়ার জন্য। গাছে উঠলে উল্লাস করে গুলি করে তাদের হত্যা করত। গৌরাঙ্গ মিস্ত্রীর ৩ মাস ও ২ বছর বয়সী দুই কন্যাকে মা-বাবার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করে। তারা দুই শিশুকে পুকুরে ফেলে হত্যা করে। রমেশ চন্দ্র রায়ের স্ত্রীকে তারা গুলি করলে আহত হয়ে তিনি বেঁচে যান। এ-সময় তারা আটঘর-কুড়িয়ানার অসংখ্য ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
১৬ই ডিসেম্বরের পর কুড়িয়ানা স্কুলের পেছনের ডোবা থেকে কঙ্কালসহ ২৫০টি মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়।
বিবিসি সহ অনেক মিডিয়ার সাংবাদিকরা এ চিত্র ধারণ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক কগিন, অপারেশন ওমেগার দেয়ারসহ কয়েকজন কুড়িয়ানায় আসেন। এ-সময় কয়েকটি খুলি তারা সঙ্গে করে নিয়ে যান। [হাবিবুল্লাহ রাসেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!