You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.15 | কুতুকছড়ি যুদ্ধ (রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা) - সংগ্রামের নোটবুক

কুতুকছড়ি যুদ্ধ (রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা)

কুতুকছড়ি যুদ্ধ (রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা) সংঘটিত হয় ১৫ই ডিসেম্বর। এতে পাকবাহিনীর অনেকে হতাহত হয় এবং বাকিরা মানিকছড়ি হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভৌগোলিক কারণে কিছুটা ভিন্ন রকম ছিল। এখানে মুক্তিবাহিনী যেমন এককভাবে গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন করে, তেমনি ভারতীয় বাহিনী বিশেষ করে এসএফএফ-এর সঙ্গে যৌথভাবেও যুদ্ধ করে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভারতের স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ভারতের দেমাগ্রি ছিল এসএফএফ-এর যুদ্ধকালীন হেডকোয়ার্টার্স। পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীকে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী মিজো বাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে হয়।
১৪ই ডিসেম্বর শেখ ফজলুল হক মনি মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন পেয়ারা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শেষ বর্ষের ছাত্র) এবং মনীষ দেওয়ান (রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে আগত, পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল)-কে দেমাগ্রিতে ডেকে পাঠান। এসএফএফ-এর অধিনায়ক মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান ও শেখ ফজলুল হক মনি ভারতীয় মেজর সুরী, শামসুদ্দিন পেয়ারা ও মনীষ দেওয়ানকে নিয়ে ব্রিফিং-এ বসেন এবং সিদ্ধান্ত নেন ১৫ই ডিসেম্বর ভোর থেকে শুরু হবে মিশন রাঙ্গামাটি।
১৫ই ডিসেম্বর ভোরবেলা মেজর সুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় স্পেশাল ফোর্সের সৈন্য এবং শামসুদ্দিন পেয়ারা ও মনীষ দেওয়ান দুটি হেলিকপ্টার নিয়ে রওনা দেন। হেলিকপ্টার দুটি প্রায় নব্বই মিনিট উড়ে কুতুকছড়ি এলাকার ফুরামোন পাহাড়ের নিকটবর্তী স্থানে এসে নিচের দিকে নামতে শুরু করে। দু-একশ ফুট ওপরে থাকতেই নিচ থেকে পাকসেনারা গোলাগুলি শুরু করে। এর মধ্যেই হেলিকপ্টার দুটি একটু ঘুরে একটি পাহাড়ের আড়ালে আরোহীদের নামিয়ে দেয়। মেজর সুরী, শামসুদ্দিন পেয়ারা ও মনীষ দেওয়ানসহ সৈন্যরা মাটিতে নেমে দ্রুত পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে যান। তখনো পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণ চলছিল। এসএফএফ-এর তিব্বতীয় সৈন্যরা দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত পাহাড় চূড়ায় সবার জন্য ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ফেলেন। চারদিকে কানফাঁটা গোলার আওয়াজ। পাকসেনাদের ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলায় ঝোঁপঝাড় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ফিল্ডগানগুলো স্থাপন করে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় ভারতীয় হেলিকপ্টার দুটি আরো কয়েক ব্যাচ সৈন্য ও গোলাবারুদ নিয়ে আসে। সারারাত ও পরদিন দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এতে পাকসেনাদের অনেকে হতাহত হয়। এক পর্যায়ে পাকসেনারা পিছু হটে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এদিকে মেজর সুরীর নেতৃত্বে মিজোদের সঙ্গে যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে মিজো বাহিনীও পিছু হটে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে। এর মধ্যে মেজর সুরী, শামসুদ্দিন পেয়ারা ও মনীষ দেওয়ান জানতে পারেন যে, ঐদিন (১৬ই ডিসেম্বর) বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। আনন্দে শামসুদ্দিন ও মনীষ দেওয়ান ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। মনীষ দেওয়ান ও শামসুদ্দিন পেয়ারা মেজর সুরীকে বলে রাঙ্গামাটি চলে যান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। পথে চাকমা সম্প্রদায়ের এক স্থানীয় বাসিন্দার বাড়িতে রাত কাটিয়ে ১৭ই ডিসেম্বর ভোরবেলা মনীষ দেওয়ান ও শামসুদ্দিন পেয়ারা কাউখালী গিয়ে পৌছান। সেখান থেকে তাঁরা চট্টগ্রাম রোডে উঠে হাঁটতে শুরু করেন। এর মধ্যে জানা যায় যে, পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় মানিকছড়ি ব্রিজের কিছু অংশ বিস্ফোরক দিয়ে নষ্ট করে যায়। মনীষ দেওয়ান ও শামসুদ্দিন পেয়ারা কিছুদূর যাওয়ার পর একটি পিক-আপ ভ্যানে উঠে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। উভয়ের হাতে তখন এসএলআর, গায়ে ড্রেস ও পায়ে জঙ্গল বুট। খুব ভোরে তাঁরা রাঙ্গামাটি পৌছান। তাঁরা কোর্ট হিল হয়ে ডিসি অফিস (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অফিস)-এর দিকে এগিয়ে যান। তখন ডিসি অফিসের একজন কর্মচারী দ্রুত তার বাসা থেকে বাংলাদেশের একটি পতাকা নিয়ে আসে। শামসুদ্দিন পেয়ারা ও মনীষ দেওয়ান মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলাদেশের সেই পতাকা ডিসি অফিসের সামনে উত্তোলন করেন। [স্বপন কুমার দে]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড