You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে কুতুবদিয়া উপজেলা

কুতুবদিয়া উপজেলা (কক্সবাজার) বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী একটি দ্বীপ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে এখানকার মানুষ পূর্ব থেকেই ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার ছিল। ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার হয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণ কুতুবদিয়ার সংগ্রামী জনতাকে মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করে। তাঁর ভাষণে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ এলে এখানেও তা গঠনের তৎপরতা শুরু হয় এবং জনগণ মুক্তিযুদ্ধের অপেক্ষায় থাকে।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগ নেতা নূরুচ্ছফা বিকম-কে আহ্বায়ক করে কুতুবদিয়া থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের এডভোকেট মসলিম খান (কুতুবদিয়া), জালাল আহমেদ (দক্ষিণধুরং), মোহাম্মদ রমিজ এমএ (দক্ষিণধুরং), ছালেহ আহমেদ চৌধুরী (বড়ঘোপ), শামসুল হুদা সিদ্দিকী (ন্যাপ, বড়ঘোপ), ডা. রাখাল চন্দ্র দাস (বড়ঘোপ), ডা. অরুণ বরণ শীল (বড়ঘোপ), মৌলবি মো. তাহের (মুড়ালিয়া), সৈয়দ আহাম্মদ বিকম (লেনচাখালী), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফেজ আহমদ (মনোহরখালী) ও আবুল কাশেম মাতব্বর (বড়ঘোপ), ছাত্রনেতা মীর কাশেম খান (কুতুবদিয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সংগ্রাম পরিষদের সহযোগিতায় কুতুবদিয়া ডাকবাংলো মাঠে ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমকি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেন অবসরপ্রাপ্ত নৌসেনা সদস্য আবুল হাসান (বড়ঘোপ) ও আনসার কমান্ডার জামাল উদ্দিন। এছাড়া বেশ কয়েকজন ছাত্র-যুবক বাঁশখালী থানায় গিয়েও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কুতুবদিয়ায় পাকবাহিনী প্রবেশ না করায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। তবে যুদ্ধের শেষদিকে পাকবাহিনীর সাহায্যার্থে বঙ্গোপসাগর হয়ে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ সপ্তম নৌবহর আসার খবরে কুতুবদিয়ার মুক্তিকামী মানুষ তাদের প্রতিরোধ করার জন্য শাবল, দা, লাঠি-সোঁটা ইত্যাদি নিয়ে সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত যায়। কুতুবদিয়ায় পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটেনি। তবে খোরশেদ নামে একজন বিহারির নেতৃত্বে ৬-৭ জন বিহারি -রাজাকার- কক্সবাজার থেকে কুতুবদিয়ায় এসে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে কুতুবদিয়া থানায় জালাল আহমদ চৌধুরী (মুড়ালিয়া)-কে সভাপতি ও ডা. জাবের আহাম্মদ (কৈয়ারবিল)-কে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি – গঠিত হয়। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে মৌলবি সিরাজুল ইসলাম (মুড়ালিয়া), নূরুল আফসার (বড়ঘোপ), মওলানা মহিউদ্দিন (বড়গোপ), রফিক চৌধুরী (ধুরং), সালেহ খান (কৈয়ারবিল) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়।
রাজাকার খোরশেদের নেতৃত্বে তার সহযোগীরা ৬ই মে বড়ঘোপ গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে সুধন্ধা কৈবর্ত দাশ (পিতা সাচিরাম দাশ)-কে বাড়ি থেকে ধরে স্টিমার ঘাটে নিয়ে কোমর পানিতে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করে। একই গ্রামের অনন্ত বালা দাশের ঘরে অগ্নিসংযোগ করলে তিনি ঘরের ভেতধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। ঐদিন পাকবাহিনীর আক্রমণে ৬ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এটি বড়ঘোপ দক্ষিণ জেলেপাড়া স্টিমারঘাট গণহত্যা নামে পরিচিত একই দিনে আমজাখালী গ্রামের ৭-৮ জন মানুষকে পানসেনারা গুলি হত্যা করে, যা আমজাখালী জেটি গণহত্যা নামে পরিচিত। তারা বড়ঘোপের স্বাধীনতাকামী মানুষের অনেক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা বেশ কয়েকজন নারীর সম্ভ্রম হানি করে। বিশেষত হিন্দুদের খতনা ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। হিন্দুদের সম্পত্তি গনিমতের মাল – এরূপ ঘোষণা দিয়ে তারা লুটতরাজ করে। এছাড়া রাজাকাররা মাঝে-মধ্যে মুক্তিকামী মানুষজনকে কুতুবদিয়া থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতন করত। ১৫ই ডিসেম্বর কুতুবদিয়া হানাদারমুক্ত হয়।
কুতুবদিয়ায় একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। তিনি হলেন নিরান্দ নাথ (পিতা ষষ্ঠিচরণ নাথ, কৈয়ারবিল)। ২৩শে মে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে আসামাত্র রাজাকাররা তাঁর বাড়িতে আক্রমণ চালায় এবং বিহারি খোরশেদ রাজাকার তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। [এনায়েত উল্লাহ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ২য় খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!